ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আনিসুর রহমান দিপু

ঢাকার চারপাশের নদী দূষণ

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৭ মে ২০১৫

ঢাকার চারপাশের নদী দূষণ

পরিবেশগত কারণে বর্তমানে ঢাকা ও চার পাশের পরিবেশ ভয়াবহ ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলের নগর ও গ্রামীণ জীবনে দেখা দিয়েছে পরিবেশ দূষণের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। অতিরিক্ত মানুষের চাপে এই অঞ্চল হয়ে পড়েছে পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি, বিদ্যুত ও গ্যাসসহ নানাবিধ মৌলিক সমস্যা প্রবলভাবে সামনে চলে আসে। একদিকে মানুষের চাপ অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠতে থাকে বাড়িঘর এবং শিল্প কারখানা। বিশেষ করে ঢাকার পাশের শহর নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে বাড়িঘরের পাশাপাশি ক্ষুদ্র-মাঝারি এবং ভারি শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার ফলে খুব দ্রুত কর্মজীবী লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে যে খ্যাতি একসময় বাংলাদেশের ছিল তা আজ স্মৃতির পাতায় ঠাঁই করে নেয়ার অপেক্ষায় যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আর এ পরিস্থিতির জন্য শুধু কল-কারখানা দায়ী তা নয়, এর জন্য কিছু ভূমিখেকো মানুষও দায়ী যারা নদীর জায়গা দখলের জন্য সারাক্ষণ থাকে মরিয়া। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন নদীর জায়গা দখলে নিয়ে অবৈধভাবে নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছে, গড়ে তুলেছে অট্টালিকা, মিল-ফ্যাক্টরি। ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ হয়ে পড়েছে গতিহীন এবং সেসব নদী আজ ধুঁকে ধুঁকে ধাবিত হচ্ছে শীর্ণতার দিকে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের চারপাশজুড়ে একসময় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী ছিল প্রমত্ততায় প্রবহমানÑ সেসব নদীর মধ্যে শীতলক্ষ্যা ছাড়া বাকি তিনটি নদীই মৃতপ্রায়। আর খুব অচিরেই যে শীতলক্ষ্যার অবস্থাও করুণ থেকে করুণতর হয়ে উঠবে তার নিদর্শন ইতোমধ্যে দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে অথচ গত কয়েক বছর আগেও শীতলক্ষ্যা ছিল এক প্রাণচঞ্চল স্রোতস্বিনী নদী। সেই শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষেই গড়ে ওঠা অসংখ্য কলকারখানার বর্জ্যসহ ঢাকার একাংশের পয়ঃবর্জ্য এবং ডিএনডি বাঁধের ভেতর ও বাইরের ডায়িং ফ্যাক্টরি থেকে নির্গত কেমিক্যালের কারণে শীতলক্ষ্যার পানি আজ হয়ে উঠেছে দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত। যদিও এই পানিতেই নি¤œ আয়ের মানুষজন এখনও গোসল সারে, কাপড়, জামা, থালা, বাসন হাঁড়ি, পাতিল ধোয়ার কাজ সারে। যার দরুন মারাত্মক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া শীতলক্ষ্যায় চলাচল করা শ্যালো ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা, বালিসহ অন্যান্য মালবাহী ট্রলার ও জাহাজ থেকে নিঃসৃত তেল ও তৈলাক্ত পদার্থ নদীর পানিতে পড়ার কারণেও নদীর পানি ভয়াবহভাবে দূষণের শিকার হচ্ছে। সেই সঙ্গে ডিএনডি বাঁধের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা কলকারখানার, জনবসতির অপরিশোধিত বর্জ্য, পয়ঃবর্জ্য সরাসরি শীতলক্ষ্যায় এসে পড়ে নদীর পানি যেমন দূষিত করছে। তেমনি নাব্যও বিনষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকার চারপাশের নদীসমূহে অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যত নেমে আসার দরুন-মাছ এবং গুল্ম-উদ্ভিদের পরিমাণ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও বিনষ্ট হচ্ছে। একদিন শীতলক্ষ্যাসহ চারপাশের এই নদীগুলোতে ভেসে বেড়াত অসংখ্য জেলে নৌকা কিন্তু নদীতে বর্তমানে মাছ শূন্যতার ফলে সেই সব জেলে নৌকা এখন আর নদীতে চোখে পড়ে না। পাশাপাশি একদিন যারা মাছ ধরে বিক্রির টাকায় জীবিকা নির্বাহ করত, তারা প্রায় সকলেই পিতৃপেশা বদল করে বাঁচার তাগিদে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে পড়েছে। নদীর তীরে গড়ে ওঠা জেলেপল্লীগুলোও যেন আজ উধাও। অন্যদিকে শীতলক্ষ্যার এক সময়কার টলটলে পান উপযোগী পানির কল্যাণে নদীসংলগ্ন কৃষি জমিতে সেচ যন্ত্রের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করে যে ফসলী জমি হয়ে উঠত উর্বরা সেসব জমিও স্বচ্ছ আর প্রাকৃতিক পানির অভাবে ক্রমশ চাষ সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা থেকে শীতলক্ষ্যা ও অন্যান্য নদীর স্বাভাবিক অবস্থা রক্ষাকল্পে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহর ও জেলার বিভিন্ন থানা ও উপজেলা শহর এবং গ্রামে যেমন নদী রক্ষা আন্দোলন করে যাচ্ছেন পরিবেশকর্মীরা, তেমনি ঢাকার চারপাশের উল্লিখিত চার নদীকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জননেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটির উদ্যোগে দূষণমুক্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই উদ্যোগকে সফল করার ক্ষেত্রে বিরাট সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছেন দেশের প্রখ্যাত পরিবেশবিদ। এই উদ্যোগের জোরালো কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা, বালু ও তুরাগ নদী অপেক্ষা এখনও কোন রকমভাবে বেঁচে থাকা শীতলক্ষ্যাকে পরিপূর্ণ জীবন্ত করার ক্ষেত্রে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে শীতলক্ষ্যাও একসময় ব্যবহারতুল্য নদীর তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবে, হারাবে নাব্য। এখনও বর্ষা মৌসুমে শীতলক্ষ্যা যে পরিচ্ছন্ন জলধারা নারায়ণগঞ্জ থেকে গাজীপুর অবধি গিয়ে পরিবেশকে উজ্জীবিত করছেÑ সেই ধারাটা ক্রমশ হয়ে পড়বে স্থির, অবিচল আর শীতলক্ষ্যা হয়ে পড়বে নিষ্প্রাণ। মাননীয় উচ্চ আদালতের কঠোর নির্দেশ রয়েছে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর স্বচ্ছতা বজায় রেখে, ভূমিদস্যুদের হাত থেকে নদী রক্ষার। তার পরেও নদী দখল, দূষণ থেমে থাকেনি। এক সময় যে শীতলক্ষ্যা নদী ছিল হাওয়া বদলের স্থানÑ সে নদীতে শুষ্ক মৌসুমে অক্সিজেনের মাত্রা এতটাই হ্রাস পায় যে, এ সময়ে নদী থাকে সম্পূর্ণ মাছশূন্য। যারা রোজ শীতলক্ষ্যা নদীতে খেয়া পারাপার হনÑ নদীর পানির দুর্গন্ধ সয়ে তাদের প্রতিদিন এই পারাপার হতে হয়। দেখা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে শীতলক্ষ্যার পানি যারা বাধ্য হয়ে ব্যবহার করেন, তারা নানা ধরনের মারাত্মক চর্ম রোগের শিকার হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় শীতলক্ষ্যা ও ঢাকার চারপাশের সকল নদীর স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখতে কঠোরভাবে নদী দূষণ রোধ, বর্জ্য ফেলা বন্ধ এবং ভূমিদস্যুদের প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরী। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও এক্ষেত্রে এদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কোন বিকল্প নেই। তাহলেই পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে মুক্ত হতে পারবে নদীসমূহ। লেখক : আইনজীবী
×