ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

‘শত্রুপক্ষের অবস্থানে শূন্যাবস্থা মঙ্গলজনক নয়’

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৬ মে ২০১৫

‘শত্রুপক্ষের অবস্থানে শূন্যাবস্থা মঙ্গলজনক নয়’

সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বের একক পরাশক্তি হয়ে দাঁড়ায় তখন ব্রিটেনের সাবেক টোরি প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমা জগতের জন্য একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “শত্রুপক্ষের অবস্থানে শূন্যাবস্থা মঙ্গলজনক নয়। এই শূন্যাবস্থা অজানা এবং আরও ভয়াবহ শত্রু পূর্ণ করতে পারে।” থ্যাচারের এই সতর্কবাণী উচ্চারণের একটা মাত্রই উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিমা শক্তি শিবির সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনে শত্রু নিশ্চিহ্ন হল মনে করে যেন আনন্দে গা না ভাসায়; বরং নতুন একটি শত্রু চিহ্নিত করে নিজেদের শক্তি ও যুদ্ধ প্রস্তুতি অক্ষুণ্ণ রাখে। এই উক্তি করার কিছুদিন পর মিসেস মার্গারেট থ্যাচারে নিজেই এই শত্রুপক্ষ আবিষ্কার করেছিলেন। বলেছিলেন, কম্যুনিস্ট শিবিরের পতন হয়েছে বৈকি, কিন্তু স্বাধীন বিশ্বের (পশ্চিমা বিশ্ব) জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে ইসলাম ও কোন কোন ইসলামী গোষ্ঠী থেকে। এই নতুন শত্রুর মোকাবিলায় পশ্চিমা বিশ্বকে প্রস্তুতি নিতে হবে। মিসেস থ্যাচারে যা-ই বলুন, পশ্চিমা শক্তি শিবির এবং তাদের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে ইসলামী সন্ত্রাসী নামে এই নতুন শত্রুপক্ষ নিজেরাই সৃষ্টি করেছিলেন। ‘কম্যুনিজম’ একটি দানবীয় ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থায় আধিপত্য থেকে মানব-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষার নামে আমেরিকা যে ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলে বিশ্বময় যুদ্ধ সৃষ্টি করে ওই অস্ত্র বিক্রির ব্যবসায়ের মুনাফার ওপর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের সৌধ গড়ে তুলেছিল, সোভিয়েট ইউনিয়নের আকস্মিক পতনে তা বাধাগ্রস্ত হয়। শত্রু না থাকলে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণই বা কিসের জন্য? যুদ্ধ না থাকলে বিভিন্ন যুদ্ধরত দেশ আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র কিনবেই বা কেন? আর অস্ত্র বিক্রি করতে না পারলে আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক ধসই বা ঠেকানো যাবে কিভাবে, এসব চিন্তা-ভাবনা থেকেই তথাকথিত ইসলামিক টেরোরিস্টদের জন্মদান এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা আমেরিকা গ্রহণ করে। যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবসায়ের মুনাফা-নির্ভর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম তাতে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী দুটি বড় ক্রাইসিস থেকে রক্ষা পায়। বৈজ্ঞানিকের গবেষণাগারে জন্ম নিয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যেমন তার স্রষ্টা বৈজ্ঞানিককেই হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, তেমনি ‘কম্যুনিস্ট শত্রু’ নিধনের জন্য আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে যে ইসলামী টেরোরিস্টদের জন্ম দিয়েছিল, এখন সেই টেরোরিস্টদের সঙ্গেই তারা যুদ্ধরত। এই যুদ্ধে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সৃষ্টিকর্তারা জয়ী হবে, না ফ্রাঙ্কেনস্টাইন জয়ী হবে তা বলা কষ্টকর। তবে এই যুুদ্ধের বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে সুপার পাওয়ার আমেরিকা এবং তার দোসর পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত। অর্থনৈতিক ধস থেকে আমেরিকাকে রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামা একটার পর একটা পরিকল্পনার নক্সা আঁকছেন। বিশ্ব পরিস্থিতির এই চিত্রটি আজ এ জন্যই আঁকলাম যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এক ধরনের শূন্যাবস্থা সৃষ্টির আভাস দেখা যাচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। বিশ্ব ধনবাদ নিজের স্বার্থেই শত্রুপক্ষ তৈরি করে বিপদে পড়েছে; কিন্তু কোন দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে গণতন্ত্রের শত্রু নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও একটি সবল প্রতিপক্ষ প্রয়োজন। নইলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই শূন্যাবস্থাটি কোন অজানা ও অশুভ শক্তি পূর্ণ করতে পারে। বাংলাদেশে এবং পাকিস্তানে এই অশুভশক্তির মাথা তোলার উদাহরণের তো অভাব নেই। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক শ্রেণীর বন্ধুকে বলতে শুনছি, বিএনপি সংগঠন হিসেবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তার মাথা তোলার আর সুযোগ নেই। এই বন্ধুদের কমপ্লাসেন্সি বা আত্মসন্তোষ প্রকাশ সঠিক হলে বলতে হবে, তাতে দেশের মঙ্গল হবে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শত্রুদের অবশ্যই নিপাত করতে হবে। এই শত্রুটি হচ্ছে জামায়াত, হেফাজত প্রভৃতি দল। বিএনপি গণতন্ত্রের শত্রু নয়, দলটিকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বলা চলে। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বের দুর্বলতা, অদূরদর্শিতা ও ক্ষমতালোভের জন্য গণতন্ত্রের শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ও পরিচালিত। বিএনপি নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও অমিতাচার সত্ত্বেও দলটিকে উপেক্ষা করা যায় না, কারণ তার জনসমর্থন আছে, এই দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তার শূন্যস্থান পূর্ণ করবে জামায়াত কিংবা অনুরূপ কোন অশুভ শক্তি। এ জন্যেই বিএনপিকে ধ্বংস করা নয়, তার সংশোধন প্রয়োজন। দলটিকে জামায়াতের গ্রাস এবং তারেক রহমানের ক্ষমতালোলুপতা থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের ভেবে দেখা উচিত, তারা এ ব্যাপারে কি করতে পারেন। বিএনপি এখন কেবলমাত্র জামায়াতের আলিঙ্গনে বন্দী নয়, একটি তথাকথিত সুশীল সমাজের দ্বারাও প্রভাবিত। জামায়াতের মতো এই সুশীল সমাজও গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু জামায়াতের যেমন লক্ষ্য গণতন্ত্রকে অনুসরণ করা নয় বরং একটি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, তেমনি বর্ণিত সুশীল সমাজেরও লক্ষ্য, গণতন্ত্র নয়, দেশে বিগ এনজিও’র তাঁবেদার একটি অনির্বাচিত এলিট সরকার গুড গবর্নেন্সের নামে প্রতিষ্ঠা করা। এই সুশীল সমাজ রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে অহরহ অভিযোগ তোলেন। কিন্তু দেখা গেছে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা যতো দুর্নীতিপরায়ণ হোক, বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে যে সব দেশে মিলিটারি বা সিভিল অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বসেছে, তাদের দুর্নীতি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের দুর্নীতির রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। নির্বাচিত সরকারকে তবু এক সময় শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা থেকে অপসারণের উপায় থাকে, অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের সেই সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচাইতে বড় দুর্বলতা এই যে, এই ব্যবস্থায় কোন গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে ওঠেনি। যে বিকল্পগুলো গড়ে উঠেছে তা অধিকাংশই অগণতান্ত্রিক। জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের বিকল্প গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো বিএনপি। কিন্তু জনসমর্থনের ওপর নির্ভরতার চাইতে সামরিক ছাউনির ওপর নির্ভরতা এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্য দলের দরোজা উন্মুক্ত হওয়ায় দলটি শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে অসামরিক স্বৈরাচারী দলে পরিণত হয়। স্বৈরাচারী দল হিসেবে বিএনপি ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে থাকার লোভে জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে বিএনপির যে আস্থা নেই তার প্রমাণ মেলে ক্রমাগত বিভিন্ন অজুহাতে সংসদ বর্জন ও নির্বাচন বর্জন অথবা আধা-বর্জন থেকে। শেষ পর্যন্ত তারা জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী রাজনীতিতেও নেমেছিল। যদি গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বিএনপির সরে যাওয়ার দরুন যে শূন্যাবস্থাটি দেখা দেয় তা কোন ডান বা বাম দল পূর্ণ করতে পারতো, তাহলে বিএনপি সংগঠন হিসেবে অস্তিত্ব হারালে ক্ষতি ছিল না, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। দেশে বিকল্প বড় রাজনৈতিক দল গড়ে না ওঠায় বিএনপি এখনও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং তার পেছনে জনসমর্থনও আছে। গণতন্ত্র-বিমুখতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে। এই অচলাবস্থায় বিএনপি যত বেশি সামরিক ছাউনি, ব্যুরোক্র্যাসি ও টেকনোক্র্যাসির সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে, সেই পথে আওয়ামী লীগকেও ততটা টেনে নিয়েছে। এখন দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলই যতটা রাজনীতি-নির্ভর, তার চাইতে বেশি মিলিটারি বুরোক্র্যাসি-টেকনোক্র্যাসির সিন্ডিকেটের ওপর নির্ভরশীল। দেশ চালিত হয় এই সিন্ডিকেট দ্বারা। রাজনীতি দ্বারা নয়। তার ওপর বিএনপি রাজনীতিতে নতুন একটা মাত্রা যুক্ত করেছে, তা হলো গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের নামে গণতন্ত্রের শত্রু ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগ এই আঁতাত গড়ে তুলতে না পেরে এই ধর্মান্ধ অপশক্তির প্রতি এপীজমেন্টের নীতি গ্রহণ করেছে। মাঝখানে একটি সুশীল সমাজ অযথাই গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না কাঁদছেন। দেশে গণতন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠা চাইলে সরকারের গণতান্ত্রিক বিরোধিতার ক্ষেত্রে শূন্যাবস্থা বিরাজ করতে দেয়া যায় না। সন্ত্রাসী বা স্বৈরাচারী অপশক্তি সেই শূন্যাবস্থাটির দখল নিতে পারে। সেজন্যে একটি সবল সুস্থ বিরোধী দল চাই। এই মুহূর্তে বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। অতীতে তিনবার তারা সরকার গঠন করেছে। এই দলকে সন্ত্রাসী ও স্বৈরাচারীদের প্রভাবমুক্ত করে কি করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় সে চেষ্টা চালানো দেশের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগেরও কর্তব্য। আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না, থাকা উচিতও নয়। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকবে না, তখন যেন স্বাধীনতার মূল আদর্শে বিশ্বাসী অপর একটি গণতান্ত্রিক দলই দেশের শাসন ক্ষমতায় বসে সেটি নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগেরও কর্তব্য। ভারতে কংগ্রেস এই কর্তব্যটি পালন না করায় অর্থাৎ সর্বভারতীয় একটি দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে গড়ে উঠতে সাহায্য না করায় আজ দিল্লীর মসনদে বিজেপি সমাসীন। এই অবস্থার পুনরাবৃত্তি যেন বাংলাদেশে না ঘটে। লন্ডন, ৫ মে মঙ্গলবার ২০১৫।
×