ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রমিকরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত

শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীলে যাওয়ার বিধান নেই

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৪ মে ২০১৫

শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীলে যাওয়ার বিধান নেই

বিকাশ দত্ত ॥ শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপীল করা যায় না অথচ প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা যায়। সমপর্যায়ের দুটি ট্রাইব্যুনালে দুই ধরনের আইন থাকায় বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপীল বিভাগে আপীল না করার ফলে শ্রমিকরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শ্রম আইন ২০০৬ দীর্ঘদিন পূর্বে প্রণীত হলেও অদ্যাবধি এই আইনের কোন বিধিমালা হয়নি। ট্রাইব্যুনালের বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন জরুরী ভিত্তিতে বিধিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এদিকে শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামছুল হুদা ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর তা সরাসরি আপীল বিভাগে যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন তার প্রয়োজন নেই। শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ই চূড়ান্ত। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ শ্রমিকের অধিকার আদায়ের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু আইনের দুই-একটি ধারার অস্পষ্টতার জন্য শ্রমিকদের মামলা উচ্চ আদালতে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। কয়েকটি ধারা সংযোজন হলে প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের মতো শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়েও সরাসরি উচ্চতর আদালতে লিভ টু আপীল করা যাবে। এতে বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে। এ বিষয়ে শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামছুল হুদা বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল দুটির গঠন ও শ্রেণী সমপর্যায়ের ও সমমর্যাদার হওয়ায় শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে এর অসঙ্গতি ও বৈপরিত্য দূর করা সম্ভব। শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামছুল হুদা জনকণ্ঠকে বলেন, নিষ্পত্তি শতভাগ হলেও শ্রমিক কল্যাণে আইনের এ্যামেন্ডমেন্ট প্রয়োজন। শ্রম দফতরকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে জজ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ট্রেনিং প্রযোজন। দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অদ্যাবধি শ্রম আইনে বিধি প্রণীত হয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন জজসাহেব ছাত্রজীবনে লেবার ল পড়েন, কিন্তু পরবর্তীকালে আর লেবার ল পড়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু লেবার ল একটি ব্যতিক্রমধর্মী আইন, যার সঙ্গে শ্রমিক-মালিকের রুটি-রুজি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমি এই অঙ্গনে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করি। শ্রমিক কল্যাণসহ অন্যান্য বিষয়ের সমাধান একমাত্র তিনিই দিতে পারেন। তিনি আরও বলেন, শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালে মামলার রায় সরাসরি আপীল বিভাগে যাওয়া উচিত। এর উত্তরে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, না, কোনভাবেই শ্রমিকগণ বঞ্চিত হবেন না। আইনের কিছু উদ্দেশ্য থাকে। শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এখানে এসেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। অর্থাৎ শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল যেটা সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই চূড়ান্ত। সেটা নিয়ে কেউ আপীল করতে পারবে না। সেজন্য (আপীল করার জন্য) এটা করা হয়েছে। হাইকোর্টে গেলে মালিক আর শ্রমিক সমপর্যায়ে থাকবে না। মালিক করতে পারবে। আর শ্রমিক কোন আপীল করতে পারবে না। সেই কারণেই এই প্রভিশনটা থাকবে। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের স্বার্থে শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল ঢেলে সাজানো হবে। ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের আপীল বিভাগ একজন বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত। সেখানকার কোন আদেশের বিরুদ্ধে কেউ আপীল করতে হলে তা হাইকোর্ট বিভাগে করতে হয়। এতে শ্রম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের মর্যাদাও ক্ষুন্ন হয় বলে জানা গেছে। এ ছাড়া শ্রমিক কোন আর্থিক রোয়েদাদ প্রাপ্ত হলে মালিক পক্ষ ইচ্ছাপূর্বকভাবে শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার জন্য সংবিধানের ১০২ ধারা মতে হাইকোর্ট বিভাগে রিট করে স্থগিত আদেশ নিয়ে বছরের পর বছর শ্রমিককে ঘোরাতে পারে। তাই প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের এ্যাক্টের সেকশন (৬এ) এর অনুরূপ ২১৭(ক) ধারা সংযোজনের মাধ্যমে শ্রম আইন-২০০৬ সংশোধন করে এই অসঙ্গতি দূর করা সম্ভব। শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, শ্রম আইন-২০০৬ দীর্ঘদিন পূর্বে প্রণীত হলেও অদ্যাবধি এই আইনের কোন বিধিমালা হয়নি। তাই জরুরী বিধিমালা প্রণয়ন করা একান্ত আবশ্যক। বর্তমানে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের মামলা দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । ফলে এখতিয়ারভুক্ত ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের প্রায় ৫ হাজার মামলা জট হয়েছে। একজন বিচারকের পক্ষে এই বিপুলসংখ্যক মামলা স্বল্প সময়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। ফলে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের জন্য সুপ্রীমকোর্টের একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন, স্বল্প আয়ের মানুষ তথা শ্রমজীবীদের আইনগত অধিকার ও বিচার প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই শ্রম আইন, শ্রম আদালত, শ্রম আপীল আদালত সৃষ্টি হয়েছে। পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে বিচার প্রার্থীদের দীর্ঘ ভোগান্তি পোহাতে হয়; যা কখনও কখনও বিচারহীনতার নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপীল বিভাগে পরবর্তী আপীল দায়েরের অনুমতির বিধান হওয়া যুক্তিসঙ্গত। এটা না হওয়ার ফলে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা কার্যত বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। সমগ্র বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নানাভাবে পদক্ষেপ গৃহীত হলেও বাংলাদেশে এই বিচার পদ্ধতির সংস্কার না হওয়ায় বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আইনগত কাঠামো অনেকটা শুভঙ্করের ফাঁকির মতোই রয়ে গেছে। শ্রম আইন-২০০৬ এর ২(৬৩) ধারাতে বলা আছেÑ ১৪ বছরের নিচের সকল ব্যক্তি শিশু। একই আইনের ৩৪(১) ধারায় বলা হয়েছেÑকোন পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে ১৪ বছর বয়সের কম বয়স্ক কোন শিশুকে নিয়োগ দেয়া যাবে না। অথচ একই আইনের ৪৪ (১) ধারায় বলা আছেÑ ১২-১৪ বছরের শিশুদের হালকা কাজে নিয়োগ করা যাবে। যদি তা শিশুর স্বাস্থ্য ও উন্নতির পক্ষে বিপজ্জনক না হয়। অথচ এই আইনের ২ নং ধারায় হালকা কাজ বলতে কোন্ ধরনের কাজ বোঝায় তা সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। ফলে আইনের ৪৪ নং ধারা এবং ৩৪ নং ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক অবস্থানে রয়েছে। সেজন্য এটাও সংশোধনের প্রয়োজন বলে অনেকেই মনে করছেন। ্এ ছাড়া শ্রম আইনের ২০০৬-এর ৩৯, ৪০, ৪২ ও ৮৭ নং ধারা অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্র্ণ কাজে মহিলা, কিশোর এবং শিশুদের নিয়োগ দেয়া নিষিদ্ধ । অথচ এই আইনের কোথাও ঝঁকিপূর্র্ণ কাজের সংজ্ঞায়ন নেই। সে কারণে এরও সংশোধন হওয়া প্রয়োজন । শ্রম আইন-২০০৬ প্রণীত হওয়ার পর থেকে ট্রাইব্যুনালে আপীল বিভাগের বিচারপতিদেরই নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। শ্রম আইন-২০০৬-এর ২১৭ ধারা মোতাবেক শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল রায় চূড়ান্ত করে থাকে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায়ের বিরুদ্ধে প্রায় মামলায়ই হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট দায়ের করা হয়। প্রতিক্ষেত্রেই রুলনিশি জারির সময় ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেন। শ্রম আইনে উল্লেখ আছে, ২ মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করবে। আবার শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন আপীলের আদেশে দেখা যায় যে, মামলা এ্যাডমিট করার পর সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। দেখা যায়, শ্রম আদালত এবং আপীল ট্রাইব্যুনালের দ্রুত নিষ্পত্তির ফল শ্রমিকরা ভোগ করতে পারে না। কারণ হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ দেয়ার পর শ্রমিকরা মামলা আর চালায় না।
×