ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কুষ্টিয়ায় নির্মিত হচ্ছে ‘মুক্তিমিত্র’

বীর শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ- দেশে এই প্রথম

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৪ মে ২০১৫

বীর শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ- দেশে এই প্রথম

এমএ রকিব ॥ মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে পাকি হায়েনাদের কবল থেকে কুষ্টিয়া শহর মুক্ত করতে গিয়ে ঘটে এক রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধ। এতে ঝরে পড়ে ‘মুক্তিমিত্র যৌথ বাহিনী’র বহু তাজা প্রাণ। সেই সব বীর শহীদের স্মরণে ও তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর নির্মাণ করা হচ্ছে ‘মুক্তিমিত্র স্মৃতিস্তম্ভ’। শহরের প্রবেশমুখ কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়কের চৌড়হাস মোড়ে স্থাপন করা হচ্ছে এটি। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী জাতীয় নেতাদের ম্যুরাল এবং যুদ্ধবিমান ও ট্যাঙ্ক সংবলিত এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কুষ্টিয়া জেলা ইউনিট কমান্ডের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং কুষ্টিয়া এলজিইডি, কুষ্টিয়া পৌরসভা, বিআরবি কেবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ঢাকার আরমা গ্রুপ এবং বিভিন্ন ব্যক্তির আর্থিক সহযোগিতা রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে। তবে মুক্তিমিত্রের নির্মাণ কাজ শেষ করতে প্রয়োজন আরও অর্থের। সম্প্রতি এলজিইডির অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভের বর্ধিত কাজের উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন। এলজিইডি কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন জানান, মুক্তিমিত্রে ম্যুরাল স্থাপনসহ এটির সৌন্দর্যবর্ধনে এলজিইডির ব্যয় হচ্ছে প্রায় আট লাখ টাকা। দৃষ্টিনন্দন এই স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ মে মাসেই সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। মুক্তিমিত্র স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশ ঘিরে রয়েছে মোট সাতটি ম্যুরাল। যার প্রথমেই রয়েছে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিকৃতি। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের চিত্র, মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতি, শেখ ফজলুল হক মনিসহ বিএলএফের আঞ্চলিক চার নেতার প্রতিকৃতি, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের চিত্র, কুষ্টিয়া শহর হানাদার দখলমুক্ত করার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ট্যাঙ্কের ওপর বিজয়োল্লাসিত জনতার ছবি, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানসহ সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি, বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীসহ সেক্টর কমান্ডারদের প্রতিকৃতি ও পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক চিত্র। দীর্ঘদিন ধরে জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে অনেকটা নীরবেই কাজ করে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কুষ্টিয়া জেলা ইউনিট কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহমেদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পরিচয় ও তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে জেলা ইউনিট কমান্ড কুষ্টিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণার্থে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য যুদ্ধক্ষেত্র, বধ্যভূমি ও গণকবরগুলোতে বিশেষ নিদর্শন রাখতে স্মৃতিস্তম্ভ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় জেলার অন্যতম বৃহৎ যুদ্ধক্ষেত্র চৌড়হাস মোড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে এই ‘মুক্তিমিত্র স্মৃতিস্তম্ভ’। যেখানে মুক্তিমিত্র বাহিনীর শতাধিক সৈন্য শহীদ হন। নাছিম উদ্দিন আহমেদ দাবি করেন, সারাদেশে ১২ থেকে ১৮ হাজার মুক্তিমিত্র বাহিনীর ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারালেও দেশের কোথাও এ পর্যন্ত মুক্তিমিত্র স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। কুষ্টিয়াতেই প্রথম ও একমাত্র ‘মুক্তিমিত্র স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মিত হচ্ছে। তিনি বলেন, একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া শহর দখল নিয়ে সংঘটিত ওই যুদ্ধে এখানে মুক্তিমিত্র বাহিনীর শতাধিক সৈন্য শহীদ হন। প্রাণ হারানো সৈন্যদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল ভারতীয় সেনা। মুক্তিযুদ্ধকালে এককভাবে কোন যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক এই ভারতীয় সেনার মৃত্যুর ঘটনা দেশের আর কোথাও ঘটেনি বলেও তিনি জানান। নাছিম বলেন, ডিজাইন অনুযায়ী মুক্তিমিত্রের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে আরও অর্থের প্রয়োজন। সরেজমিন চৌড়হাস মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তিমিত্রের নতুন রেলিং জুড়ে সাঁটানো রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যানার ও বাস সার্ভিসের সময়সূচীর ব্যানার। পাশেই গড়ে উঠেছে বাস টিকেট কাউন্টার ও পান-বিড়ির স্টল। এতে মুক্তিমিত্র স্মৃতিস্তম্ভের সৌন্দর্যহানি ঘটছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তাই সেখান থেকে এসব সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেদিন মুক্তিমিত্র বাহিনীর তীব্র হামলার মুখে অত্র অঞ্চলে একের পর এক জেলা শহর হানাদারমুক্ত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় যশোর, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত হবার পর অবশেষে পাক হানাদারদের কবল থেকে কুষ্টিয়া শহর দখলমুক্ত করতে ‘মুক্তিমিত্র যৌথ বাহিনী’র (মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী) সৈনিকরা অগ্রসর হতে থাকে। ভারতীয় বিমানবহরের কভারে ‘মুক্তিমিত্র বাহিনী’র আর্টিলারি গ্রুপের সৈনিকরা ট্যাঙ্ক ও কামানসহ ভারি অস্ত্রসজ্জিত হয়ে শহরটির উপকণ্ঠে পৌঁছে। এদিকে পাকি সেনারা মুক্তিমিত্র বাহিনীর কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হবার বিষয়টি আগেই টের পেয়ে যায়। ফলে শত্রুকে মোকাবেলায় হানাদার সৈন্যরা শহরের প্রবেশমুখে গোপনে এ্যাম্বুশ করে। তারা কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়কে শহরতলীর কুমারগাড়া এলাকায় তৎকালীন বিটিসির সামনে জিকে ক্যানেলের ব্রিজ এবং চেঁচুয়া ও মোল্লা তেঘড়িয়া ব্রিজসহ তিনটি ব্রিজে ডিনামাইট সেট করে এবং ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ আশপাশে পজিশন নিয়ে মুক্তিমিত্র বাহিনীর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহমেদ সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর। পূর্বাকাশে সবেমাত্র উঁকি দিয়েছে সূর্য। কুষ্টিয়া শহর দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসরমাণ মুক্তিমিত্র বাহিনীর একটি বৃহৎ অংশ সকাল আটটার দিকে কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকি হানাদারদের পেতে রাখা ফাঁদে ঢুকে পড়ে। এ সময় পাকি সেনারা ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তিনটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। এতে মুক্তিমিত্র যৌথবাহিনীর সৈনিকদের সামনে অগ্রসর কিংবা পিছু হটার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচ- যুদ্ধ। সকাল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে উভয়পক্ষ ট্যাঙ্ক, কামানসহ ভারি অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। ভারতীয় বিমানবাহিনী একের পর এক বোমাবর্ষণ করতে থাকে। দুই ঘণ্টার এ যুদ্ধে মুক্তিমিত্র বাহিনীর শতাধিক সৈন্যর প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় আরও দুই শতাধিক। ভারতীয় একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়। উভয় পক্ষে ৭/৮টি ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিহত ভারতীয় সৈন্যদের পরে বিসিক মাঠে সৎকার করা হয়।
×