ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়

বুদ্ধ পূর্ণিমা ॥ বুদ্ধের জীবন ধর্ম ও দর্শন

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৩ মে ২০১৫

বুদ্ধ পূর্ণিমা ॥ বুদ্ধের জীবন ধর্ম ও দর্শন

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব। এ দিনটি বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র ও মহিমান্বিত দিন। ভগবান বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার বিশাখা নক্ষত্রে রাজকুমার সিদ্ধার্থ রূপে কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে আলোকপ্রাপ্ত। অর্থাৎ সর্বতৃষ্ণার ক্ষয়সাধন করে বোধিজ্ঞান লাভ করে জগৎ পুজ্য বুদ্ধ হয়েছিলেন। বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে লাভ করেছিলেন মহাপরিনির্বাণ। বুদ্ধের জীবনে মহাপবিত্র ত্রি’স্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের কাছে অতি গৌরবের ও মহাপবিত্র দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। ২৫৫৯ বুদ্ধবর্ষ এ বছরের বুদ্ধ পূর্ণিমা। এ দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে এ পবিত্র দিবসটি উদযাপন করে থাকে। বুদ্ধবর্ষ গণনায় বৈশাখই প্রথম মাস। সেই হিসেবে বৌদ্ধ প্রধান দেশগুলোও তাদের পহেলা বৈশাখ বৈশাখের প্রথম দিনে উদযাপন করে। বিশেষত থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ভারতের কিছু প্রদেশ। বাংলাদেশও বৈশাখ মাসের প্রথম দিবসটি পহেলা বৈশাখ হিসেবে উদযাপন করে। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধের সময়কাল থেকেই বাঙালী জাতি বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে গণনা করতেন। তাঁর কারণ এদেশে বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশে পাল রাজাদের ভূমিকা ছিল। পাল রাজা বাঙালী ও বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের চারশ’ বছরের অসাম্প্রদায়িক শাসন কালকে ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয় থাকে। বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের কারণে সমগ্র এশিয়ায় বৈশাখই বছর গণনায় প্রথম মাস। বুদ্ধের জন্মোৎসবের কারণেই এ ঐতিহাসিক ঘটনা। সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম একজন সাধারণ মানুষের মতো হয়েছিল। পিতা রাজা শুদ্ধোধন ও মা রাণী মহামায়া। শাক্য রাজ্যের রাজধানী কপিলাবস্তু হতে মায়াদেবীর পিতৃগৃহে যাওয়ার পথে বর্তমান নেপাল রাজ্যের রম্মিদের স্থানে লুম্বিনী কাননে। শাক্য বংশে জন্ম হয়েছিল বলে গৌতম বুদ্ধকে শাক্যসিংহ বলা হয়। তাঁর পারিবারিক নাম রাজকুমার সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিন পর মহামায়া মারা যান। বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী লালন পালন করেছিলেন বলে পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ নামে বিখ্যাত হন। সিদ্ধার্থ গৌতম কেন রাজপুত্র হয়েও সন্ন্যাস জীবন বা অনাগরিক জীবন বেছে নিলেন? মানুষ জন্ম, জ্বরা, ব্যাধি, মৃত্যুর অধীন এর কশাঘাতে জর্জরিত মানবের মুক্তির পথ খুঁজতে তিনি রাজসুখ ত্যাগ করে পথে বেরিয়ে ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ঊনত্রিশ বছর। ভরা তারুণ্য তাঁর মধ্যে। এ বয়সেই জগৎকে দেখেছিলেন শুধু দুঃখ আর দুঃখময়রূপে। আর সুখের পরিমাণ সামান্য, তাও মরীচিকাবৎ। বুদ্ধের ভাষায়- দুঃখই উৎপন্ন হয়, দুঃখই বিরাজ করে, দুঃখ ছাড়া অন্য কিছু উৎপন্ন হয় না, দুঃখ ছাড়া অন্য কিছু নিরোধও হয় না। তিনি মহানিষ্ক্রমণ বা সংসার ত্যাগ করে ঋষি আড়ার কালাম ও রাজপুত্র রুদ্রকের কাছে ধ্যান সমাধি করেন। এতে তাঁর চিত্ত রমিত না হলে কৃচ্ছ্র সাধনায় মনোনিবেশ করেন- ইহাসনে শ্যুষ্যতু মে শরীরং ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু, অপ্রাপ্র বোধিং বহ কল্প দুলভং নৈবসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতেজ। এদেহ শুকিয়ে যাক, তক, অস্থি, মাংস প্রলয়ে যাক, বোধিজ্ঞান অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমি এ আসন থেকে উঠব না। এ কঠোর বজ্র দৃঢ় সঙ্কল্পের কারণে সিদ্ধার্থ গৌতমের শরীর-জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেল। চলৎশক্তি হারিয়ে বিষম দুর্বল হয়ে গেলেন। কৃচ্ছ্র সাধনায় যে বিমুক্তিলাভ অসম্ভব, সিদ্ধার্থ গৌতম উপলব্ধি করলেন। পরে জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে মধ্যম পন্থা গ্রহণ করলেন। বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষমূলে চরম ও গরম প্রাপ্তি বোধিজ্ঞান লাভ করলেন। বোধিজ্ঞান লাভ করে যে বাণী তিনি উচ্চারণ করলেন-‘এ দেহ রূপ গৃহ নিমার্তার সন্ধান করতে গিয়ে অনেক জন্ম পরিভ্রমণ করেছি। বুঝতে পেরেছি পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ দুঃখজনক। হে গৃহ নির্মাতা, আমি তোমার সন্ধান পেয়েছি। তুমি পুনরায় এ গৃহ আর নির্মাণ করতে পারবে না। তোমার সমুদয় পার্শ্বক ভাগ্ন ও গৃহকুট ভেঙ্গে দিয়েছি। সংস্কারমুক্ত চিত্ত সমুদয় আমি তৃষ্ণার ক্ষয়সাধন করেছি।’ এটা বুদ্ধত্ব লাভের পর আনন্দোচ্ছ্বাসে উদান বাণী পরিবেশন করেছিলেন। বোধিলাভের পর দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরব্যাপী বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচার করেছিলেন। বুদ্ধের ধর্ম প্রচারের বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষের বাহ্যিক আচরণের ওপর নয়, অন্তর জগৎকে পূর্ণতায় ভাসিয়ে দিতে। ইন্দ্রিয় সংযম, বাক সংযম, চিত্তের সংযম, আহারে-বিহারে মাত্রা জ্ঞান বা সংযম-এগুলোই ছিল তাঁর উপদেশ। আসব ক্ষয় না হলে কেবল শীল ও ব্রতসম্পন্ন হলে বা বহু শাস্ত্র জ্ঞান লাভ করলে, এমন কি নির্জনে বাস ও সমাধি লাভ করলেও যে নির্বাণ লাভ করা যায় না, বুদ্ধ এ কথা বারবার বলেছেন তাঁর শিষ্যম-লীকে। বুদ্ধ বলতেন-অত্তা হি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরো সিয়া-তুমিই তোমার নাথ বা প্রভু তুমিই তোমার আশ্রয়। তুমি ছাড়া তোমার অন্য কোন আশ্রয় আছে? সুতরাং-তুমহেহি কিচ্চং আতপ্্পং-তোমার মুক্তির পথ তোমাকেই রচনা করতে হবে। বুদ্ধ কেবল পথ প্রদর্শক। নিজের শ্রদ্ধা (ঋধরঃয) বা আত্মশক্তির ওপর ভর করেই নিজের মুক্তির পথ নিজের প্রজ্ঞাদৃষ্টি দিয়েই করতে হবে। সংসারে যা কিছু অবলম্বন করে মানুষ নিশ্চিত হতে চায়, সব কিছুই অনিত্য, এমন কি স্বর্গলাভ। যতদিন না আমি আসক্তিহীন হতে পারিনি, নির্বাণ তার জন্য দুরূহ। এ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বিমুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। মহাপ-িত রাহুল সাংকৃত্যায়ন, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ, পৃষ্ট-৩৬ এ তথাগত বুদ্ধের ধর্ম সম্পর্কে লিখেছেন- “বুদ্ধ ছিলেন কালবাদী- দেশ, কাল, ব্যক্তি দেখে তিনি তাঁর সম্পদ দান করতেন, বাতাসে তলোয়ার চালনা পছন্দ করতেন না তিনি। বুদ্ধের নগণ্য শিষ্য রাহুলেরও নীতি তাই। বুদ্ধের শিষ্যত্বের যে অধিকার যেটা আমি ছেড়ে দিইনি। বুদ্ধ বলেছিলেন, আমার উপদেশিত ধর্ম নৌকার মতো, পারে পৌঁছানোর জন্য, ঘাঁড়ে করে বয়ে চলার জন্য নয় (মজঝিম নিকায়)। তাঁর উপদেশ অনুসরণ করেই আমি ক্ষণিক (দ্বন্দ্বমূলক) অনাত্মবাদ থেকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে এসে পৌঁছেছি।’ প-িত রাহুলজি বুদ্ধের জীবন ও দর্শনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে বুদ্ধের দর্শনে অনুরণিত হয়েছিলেন। মাঘী পূর্ণিমার দিনে তাঁর মহাপরিনির্বাণ লাভের দিন সন্নিকট বুদ্ধ বুঝতে পেরে বৈশালীর চাপাল চৈত্রে শিষ্যদের ডেকে বলেছিলেন-বৈশালীতে এ আমার শেষ অবস্থান। তিন মাস পরেই তথাগতের দেহবসান হবে। তোমরা কাতর হয়ো না। যে ধর্ম তোমাদের কাছে প্রকাশ করলাম, অনুরাগের সঙ্গে সেই ধর্ম অনুশীলন করে নির্বাণ লাভের জন্য আয়াস করো। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের কথা জেনে বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দ খুবই কাতর ভারক্রান্ত হয়েছিলেন। আনন্দের মনে সংশয় ছিল, বুদ্ধের অবর্তমানে তাকে কে অহত্ত্ব লাভের পথ দেখাবেন? আনন্দের মনের কথা জেনে বুদ্ধ বলেছিলেন, ‘আনন্দ! প্রিয়জন থেকে আমাদের বিচ্ছেদ এবং সংহত পদার্থের (দেহের) বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। এ জন্য শোক করা ঠিক না। অপ্রমাদের সাথে আপন কর্তব্য সম্পাদন করো।’ আজ হিংসা উন্মত্ত পৃথিবীতে বুদ্ধের বাণী নতুন করে অনুরণিত হচ্ছে। লেখক : সম্পাদক, সৌগত ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন, ঢাকা
×