ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চাল আমদানির ওপর শুল্ক ॥ এগোতে হবে সাবধানে

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১ মে ২০১৫

চাল আমদানির ওপর শুল্ক ॥ এগোতে হবে সাবধানে

বেশ কিছুদিন ধরে খবরের মাঠ দখল করে আছে নির্বাচনী খবর। প্রার্থীদের পরিচিতি, সিটি কর্পোরেশনগুলোর পরিচিতি, মনোনয়ন, প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার, পাস ফেলের সম্ভাবনা ইত্যাদির খবরই ছিল মুখ্য। ছিল নগরীর সমস্যার ওপর অনেক খবর। খবরের পর নির্বাচনও শেষ। আমি যখন এই কলাম লিখছি তখন নির্বাচনের ফল ঘোষিত হচ্ছে। অপরদিকে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এসব খবরের মধ্যেই কিছু অর্থনৈতিক খবর আছে। অবশ্য বড় খবর গেল আরেকটি। আর সেটা হচ্ছে ভূমিকম্প। বাংলাদেশে ভূমিকম্প আঘাত করেছে গত শনিবার ও রবিবার। বড় আঘাত যদিও ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। কিন্তু ভূমিকম্প নেপালকে ধসিয়ে দিয়ে গেছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। নেপালের দর্শনীয় সব জায়গা বিনষ্ট হয়েছে। নেপাল অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, মানবিক দিক দিয়ে যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের অর্থনৈতিক খবর এসব নয়। আমাদের খবর আছে শেয়ার বাজারের। শেয়ারের সূচক বিগত দেড় বছরের মধ্যে আবার সর্বনিম্ন। এই বাজারকে চাঙ্গা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা বলেছেন, সঞ্চয়পত্র ও মেয়াদী আমানতের ওপর সুদের হার কমাতে। তার মতে, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের হার নাকি বাংলাদেশ ব্যাংককে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাধা দিচ্ছে। একই অপবাদ নাকি মেয়াদী আমানতের ওপর সুদের হার। তার মতে, এসবের সুদের হার কমানো দরকার। আমি এ ব্যাপারে আজ কোন মন্তব্য করব না। শুধু এইটুকু বলব যে, উপদেষ্টা মহোদয় খুব সরলীকৃত করছেন জটিল এই সমস্যাটিকে। শেয়ার বাজারের সমস্যাকে শুধু সঞ্চয়পত্র ও আমানতের সুদের হারের সঙ্গে সম্পর্কিত করা উচিত হবে কি-না তা গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা দরকার। শেয়ার বাজারের সমস্যা কি কি করলে ওই বাজার আবার চাঙ্গা হবে সেই ব্যাপারে ওই বাজারের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কথা বলা দরকার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে। তার পরই এই জটিল ইস্যুতে মন্তব্য করা সঙ্গত হবে। দ্বিতীয় যে খবরটি গত সপ্তাহে ছাপা হয়েছে তা চাল আমদানি সম্পর্কিত। বলা হয়েছে, চাল আমদানির ওপর শুল্ক বসানোর চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। আমরা জানি দেশে পর্যাপ্ত ধান চাল উৎপন্ন হয়। বলতে গেলে বাংলাদেশ এখন চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিছু পরিমাণ চাল এখন রফতানিও হয়। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কায় চাল রফতানি করেছে। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে বেসরকারী খাতে কিছু ব্যবসায়ী ভারত থেকে চাল আমদানি করছে। এতে দেশীয় চাল উৎপাদক কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চালের দাম নিচের দিকে স্থিতিশীল। দেশীয় কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার্থে সরকার চাল আমদানির ওপর শুল্ক বসানোর চিন্তা-ভাবনা করছে। এখানে বিবেচ্য বিষয় অনেক। প্রথমত. কি ধরনের চাল ভারত থেকে আমদানি হয়। এটা জানা যাচ্ছে যে, ভারত সরকার কিছু দিন পর পর তাদের চালের গুদাম খালি করে। তা করে কয়েকটি কারণে। চাল গুদামে থেকে নষ্ট হয় নিয়মিত। চালের গুণ নষ্ট হয় প্রধানত। দ্বিতীয়ত. নতুন চালের জায়গা করার জন্য পুরনো চাল বিক্রি করে দিতে হয়। এসব কারণে যে চাল বিক্রি হয় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কি ওই চাল আমদানি করেছে? এটা ঠিক হলে এই চালের বাজারমূল্য খুব কম। কিন্তু তা মানুষের খাবার উপযোগী থাকে বলে মনে হয় না, অথবা কিছু অংশ থাকতেও পারে খাবারযোগ্য। এমতাবস্থায় প্রথমেই দেখা দরকার কি ধরনের চাল আমদানি হচ্ছে। ওই চাল কি পশুখাদ্য হিসেবে আনা হচ্ছে? আমার বিষয়টির ব্যাপারে কোন ধারণা নেই। অতএব প্রশ্ন, যদি সত্যি সত্যি খাবারযোগ্য চাল বেসরকারী খাত ভারতীয় বাজার থেকে আমদানি করে কম পয়সায়, তাহলে উদ্বেগের বিষয়। কারণ এটা উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে জড়িত। যদি খাবারযোগ্য চাল কম দামে ভারত থেকে আমদানি হয় তাহলে আমাদের চালের মূল্যের সঙ্গে একটা সংঘর্ষ বাধে। কারণ আমাদের কৃষকদের জন্য চালের উৎপাদনমূল্য বেশি। এটা কি ভারতের তুলনায় আমাদের ভর্তুকি কমের কারণে হচ্ছে? ভারতে কি সেচের জল, সার, বীজ, কীটনাশক, শ্রম ইত্যাদি সস্তা? এসবের খবর নিতে হবে আবশ্যিকভাবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের খবর নয়, সারা ভারতের খবর নিতে হবে। তবে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। আমরা এখন ‘বোরো’ নির্ভর দেশ। বোরোই আমাদের প্রধান ধান্য ফসল। তারপর আমন আউশের স্থান শেষে। এক সময় আমনই ছিল প্রধান ফসল। আউশ ছিল দ্বিতীয়। বোরো ছিল না। বোরো ফসল স্বাধীনতার পরের ঘটনা। বোরো খুব ‘কস্টলি’ ফসল। এতে প্রচুর সেচের জল লাগে, বিদ্যুত খরচ আছে। কীটনাশক ইত্যাদির খরচ আছে। আছে সারের খরচ। সেই তুলনায় আউশ ও আমনে জলের খরচ খুবই কম। এ কারণে কৃষকদের কাছে বোরো দামী ফসল। ধান চালের দাম কমাতে হলে আমাদের আবশ্যিকভাবে আবার আউশ ও আমনের দিকে নজর দিতে হবে। এসবে জলের খরচ খুবই কম। তাছাড়া বোরোর জন্য যে জলের দরকার তা মাটির নিচে আজকাল পাওয়া যায় না। নদী-নালার জলেও টান পড়েছে। অতএব সরকারের উচিত আউশ আমনের দিকে নজর দেয়া। এতে সেচের জলের খরচ কম হবে। সারের খরচ কম হবে, বিদ্যুতের খরচে সাশ্রয় হবে এবং ভারতের সঙ্গেও আমরা প্রতিযোগী হতে পারব। আশা করি, সরকার এসব বিষয় ভাববে। পরিশেষে একটা কথা। আমদানির ওপর শুল্ক বসানোর বিষয়টা কিন্তু স্পর্শকাতর। কৃষককে বাঁচাতে গিয়ে যদি বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পায়, তাহলে কিন্তু সরকারের জন্য এটি ভাল খবর হবে না। উভয়কূল রক্ষা করেই সাবধানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বৈকি। আরেকটি খবর চোখে পড়ল গত সপ্তাহে। আর সেটা চাকরিচ্যুতির ওপর। ঘটনাটি ঘটেছে ‘গ্রামীণফোন’ কোম্পানিতে। গ্রামীণফোনের শ্রমিক ইউনিয়ন অভিযোগ করেছে, সেখানে ৩০জন কর্মীকে বেআইনীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কোন আইনই মানা হয়নি। কর্মীদের ডেকে বলা হয়েছে চাকরি ছাড়তে। নতুবা তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে এই হুমকি দেয়া হয়। বলা বাহুল্য, ‘গ্রামীণফোন’ এর আগেও একই কাজ করেছে। তখন বড় প্রতিবাদও হয়েছে। শুধু গ্রামীণফোন নয়, আজকাল বেসরকারী খাতের এক শ্রেণীর মালিক এবং তাদের বশংবদ উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে লোকের চাকরি খাওয়াটা একটা পেশায় পরিণত হয়েছে। চাকরি খেতে পারলেই তাদের আনন্দ। ঐ টাকা তারা তাদের বেতন বৃদ্ধিতে কাজে লাগান। ‘দক্ষতার’ নামে এটা ঘটানো হয়। আবার ঐ ধরনের মালিক এবং তাদের বশংবদ কর্মকর্তারা আউটসোর্সিংয়ের নামে কর্মীদের ঠকায়। বাইরের কোম্পানি থেকে লোক আনা হয়। ঐ সব কোম্পানি লোকদের মজুরি দেয় খুবই কম। এসব চোখের সামনেই ঘটছে। সরকার চোখ বুজে আছে। উন্নত দেশে চাকরি গেলে সরকার বেকার ও চাকরিচ্যুত লোকদের খাওয়ায় এবং পরায়। বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত শ্রমিকদের স্বার্থ দেখা। কথায় কথায় যাতে কর্মী এবং অফিসারদের চাকরি না যায় এটা দেখার দায়িত্ব সরকারের এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সি বা বিভাগের। গ্রামীণফোন ভীষণ লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। কাজেই লোকসানের কথা বলে দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলে তারা লোকজনকে পত্রপাঠ বিদায় করবে এটা গ্রহণযোগ্য নয় কোনমতেই। সরকার চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে না। অথচ যারা চাকরি পেয়েছে তাদের চাকরি যাচ্ছে ঠুনকো অভিযোগে, তা কাম্য নয়। কঠোর হস্তে তা দমন করা দরকার। এই সমস্যা বেসরকারী খাতের সেবা কোম্পানিতে আছে। ম্যানুফেকচারিং কোম্পানিতে আছে। ব্যাংকে আছে, বীমা কোম্পানিতে আছে, আশা করি এই সমস্যার সমাধান হবে। মালিকদের স্বার্থ দেখা দরকার। কিন্তু তা দেখতে গিয়ে কর্মীদের রাস্তায় নামিয়ে দিতে হবে, অফিসারদের ৪০-৫০ বছর বয়সে কর্মহীন করতে হবে, এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। নিয়ন্ত্রণী কর্তৃপক্ষকে এসব ব্যাপারে নিয়মনীতি প্রণয়ন করতে হবে। বিদেশী কোম্পানিগুলো যাচ্ছেতাই করবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কিছুদিন পূর্বে দেখলাম একটি বিদেশী বীমা কোম্পানি দেশের কোন আইনই মানছে না। কি করে তা সম্ভব? আমরা কি বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য জিম্মি হয়ে পড়েছি? লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×