ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশ রায়

সিটি নির্বাচন ॥ বিএনপির ড্র’র চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৩০ এপ্রিল ২০১৫

সিটি নির্বাচন ॥ বিএনপির ড্র’র চেষ্টা

ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগ জিতেছে। বিএনপি নির্বাচনের দিন এ নির্বাচন বর্জন করেছে। মিডিয়ার কিছু অংশ এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অনেক তথ্য হাজির করছে। এ নির্বাচনকে ঘিরে প্রধানত এই তিনটি বিষয় সামনে আসছে। এখন প্রথমে দেখা যেতে পারে কেন আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে জিতল? কয়েকজন বিদ্রোহী কমিশনার প্রার্থী কিছু গোলযোগ করেছে বলেই কি ধরে নিতে হবে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কারচুপি করে জিতেছে? ঢাকা সিটির মানুষ কি একেবারে অন্ধ ও অবিবেচক? তারা কি ঢাকার উন্নয়নের দিকটি একটু বিবেচনা করেনি? যারা বলতে চাচ্ছেন, শুধুমাত্র কারচুপি করে আওয়ামী লীগ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন জিতেছে- তারা কি বলতে পারেন সিটি নির্বাচনের প্রচারে বিএনপি ভোটারদের কাছে আওয়ামী লীগের কোন ব্যর্থতার কথা বলতে পেরেছিল? অন্যদিকে আওয়ামী লীগের গত ছয় বছরের উন্নয়নের ফিরিস্তিটি কতটা লম্বা ছিল? শুধু হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন কি ঢাকা সিটি নির্বাচনের উইনিং ফ্যাক্টর হিসেবে যথেষ্ট নয়? হাতিরঝিলের রাস্তায় এখনও বিকেলে হাজার হাজার মানুষ থাকে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর খুলে দেয়া হলে লাখ লাখ মানুষ দিন ও রাতে দেখতে আসত। তাদের মন্তব্য ছিল, এখানে এলে মনে হয় উন্নত কোন দেশের শহরে এসেছি। ওই লাখ লাখ মানুষ কাকে ভোট দেবেন? যাঁরা আওয়ামী লীগের ঢাকা সিটির বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মুখে ফেনা তুলছেন, তাঁরা কি শুধু এই একটি প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। আর ওই লাখ লাখ মানুষের ৫০ ভাগ যদি কেন্দ্রে যায় তাহলেই কি একটি নির্বাচনে তারা উইনিং ফ্যাক্টর নন? মিডিয়ার যে অংশটি এ বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে, তাদেরও নিশ্চয়ই মনে আছে হাতিরঝিল প্রকল্প খুলে দেবার কিছুদিন পরে খালেদা জিয়া তাঁর গুলশান অফিস থেকে রাতে বেরিয়ে কিছু নেতা ও স্টাফ নিয়ে হাতিরঝিল প্রকল্প দেখতে এসেছিলেন। সেদিন তিনি প্রকল্প ঘুরতে ঘুরতে বলেছিলেন, এরা কত ভাল কাজ করে আর আমাদের লোকজন নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। খালেদা জিয়া যদি বিএনপিপ্রধান না হতেন, তাহলে নিজের বিবেকের দায়ে তিনিও কি ঢাকা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দিতেন না? আর সেদিনই কি খালেদা বুঝতে পারেননি, আর যাই হোক ঢাকা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জেতা যাবে না। শুধু হাতিরঝিল নয়, ঢাকায় গত ছয় বছরে কতগুলো ফ্লাইওভার হয়েছে? ঢাকা তো এখন অনেক উন্নত দেশের নগরীর মতো ফ্লাইওভারের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এই নির্বাচনের দিন কয়েক আগে দীর্ঘদিন পরে মিরপুরের কয়েকটি এলাকায় যেতে হয়েছিল। কোথাও কোথাও তো মনে হয় যেন আগের সেই ধানম-ি। তাই যাঁরা ফ্লাইওভারের সুবিধা পাচ্ছেন, যাঁদের নিজ নিজ এলাকা বদলে গেছে, উন্নত হয়েছে তাঁরা ভোটে কী করবেন? সবাই কি দলীয় বিবেচনায় ভোট দেন? বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট আছে। কিন্তু তার বাইরে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁরা ভোট দেন বাস্তবতা বিচারে। তাঁদের মাথায় কি ভোট দেবার আগে এই হাতিরঝিল, ফ্লাইওভার, নিজ এলাকার উন্নয়নÑ এগুলো মনে আসবে না। আর সর্বোপরি সারাদেশের সঙ্গে ঢাকাও আজ বিদ্যুত সমস্যামুক্ত। জামায়াত-বিএনপির আমলে দিনে-রাতে মিলে ১২ ঘণ্টার ওপরে লোডশেডিং হতো। এখন লোডশেডিং বিষয়টি মানুষ ভুলে গেছে। খাবার পানির হাহাকার নেই। এসব কি ঢাকা সিটি নির্বাচনে কাজ করেনি? এরপরে আসে ঢাকা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর তুলনা। মানুষের সঙ্গে মানুষের তুলনা করে কখনই কোন মানুষকে ছোট করতে নেই। এটা শালীনতা নয়। কিন্তু কেউ যদি নির্বাচনের মাঠে নামেন বা কোন কাজে নামেন তখন কিন্তু তাঁর যোগ্যতা, তাঁর স্বভাব এমনি অনেক কিছুই বিচার হয়। ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আনিসুল হক। ঢাকার নাগরিক সমাজের সবাই আনিসুল হককে এক নামে চেনেন। এছাড়া ঢাকার সাধারণ মানুষও আনিসুল হককে চেনেন। তরুণ বয়স থেকে নানা পর্যায়ের সাফল্যের ভেতর দিয়ে আনিসুল হক আজকের এখানে এসেছেন। যেমন আজকের আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি আওয়ামী লীগের কোন বড় নেতা নন। ছাত্রলীগে, আওয়ামী লীগে তাঁর কোন অবদান নেই। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। কিন্তু তিনি নিজগুণে এখানে এসেছেন। তাঁর প্রথম নাগরিক সমাজে পরিচিতি আসে মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে, তারপরে বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের ভেতর দিয়ে। ওই বিপুল পরিচিতি নিয়ে স্বাধীনতার সপক্ষ মানুষ, উদার চেতনার মানুষ- তাই তিনি আওয়ামী লীগে আসেন। মানুষ তাঁকে গ্রহণ করে। আনিসুল হকও আসাদুজ্জামান নূরের মতো তরুণ বয়সে বিটিভির মাধ্যমে বিপুল পরিচিতি পান। সে সময়ে তাঁর উপস্থাপনার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘এখনই’ একপর্যায়ে অন্যতম জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। ওই সময়ে যেমন ঢাকার তরুণীদের মনোজগতে একটি বিষয় কাজ করত যে, আমাকে সুবর্ণা মুস্তাফার মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। আবার ওই সময়ে তরুণদের ভেতরও কিন্তু কাজ করত আমাকে আনিসুল হকের মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। এরপরে তিনি এ জগত ছেড়ে ব্যবসার জগতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি কতটা সফল তা এই নির্বাচনের আগে শুধু নয়, অনেক আগে থেকে ঢাকার মানুষ জানেন। তিনি বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই, সার্ক চেম্বার এসব কিছুর প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ব্যবসায়ী সমাজে তিনি জনপ্রিয়। তাছাড়া মিডিয়ায় একজন চমৎকার টকার হিসেবে সুনাম তিনি ধরে রেখেছেন। সর্বোপরি, ঢাকার শাহবাগে যখন তারুণ্যের বসন্ত এসেছিল ওই শাহবাগ বসন্ত বা গণজাগরণেÑ যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ এই তরুণদের সমর্থনে তিনি একাত্মতা ঘোষণা করে প্রায় এক ঘণ্টা বক্তব্য রেখেছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। পাশে দাঁড়ানো তরুণদের রোমাঞ্চিত হতে দেখি তাঁর ভাষণে। তাঁদের গায়ের লোমকূপগুলোর জেগে ওঠা লক্ষ্য করি। এই সফল মানুষটিকে আওয়ামী লীগ ঢাকার পশ এলাকার মেয়র প্রার্থী করে। এর বিপরীতে বিএনপি প্রার্থী ছিলেন তাবিথ আউয়াল। যার একমাত্র পরিচয় সফল ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে এবং যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ভাই জামায়াত নেতা মীর ইস্কান্দার আলীর জামাতা। নির্বাচনের আগে এটাও প্রকাশ পেয়ে যায়, ঢাকার দুটি মেয়র পদ জামায়াত ও বিএনপির ভেতর ভাগাভাগি হয়েছে। জামাতা কোটায় ঢাকার উত্তর পেয়েছে জামায়াত। এরপরে আসে ঢাকা দক্ষিণ। ঢাকা দক্ষিণের আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাঈদ খোকন ছিলেন তরুণ। তবে তিনি রাজনৈতিক নেতা। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এছাড়া তাঁর আর দুটি বড় পরিচয়, এক তিনি মোহাম্মদ হানিফের ছেলে ও ঢাকার অন্যতম সর্দার মাজেদ সর্দারের নাতি। পুরান ঢাকা সম্পর্কে যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা জানেন এখনও পর্যন্ত পুরান ঢাকার অধিবাসীদের মনোজগতে ঢাকার সর্দারদের প্রভাব কতখানি। আর এই সর্দারদের পরোপকারের ইতিহাস তো অনেকটা উপকথার মতো। এছাড়া মোহাম্মদ হানিফ শুধু ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র নন, তিনি শুধু ঢাকা নন, সারাদেশের একজন জনপ্রিয় রাজনীতিক ছিলেন। মোহাম্মদ হানিফ প্রায় ৮ বছর ঢাকার মেয়র ছিলেন। তারপরেও সাঈদ খোকন তাঁর প্রতিটি নির্বাচনী পথসভায় জোর গলায় বলেছেন, মেয়রের সন্তান হিসেবে কেউ যদি তাঁর কোন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা বলতে পারেন তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। আরও যে ঘটনাটি তাঁর নির্বাচনে প্রার্থী হবার আগে পত্রপত্রিকায় আসে তা হলো, নিজ বাড়ি বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ শোধ করে তাঁকে নির্বাচন করতে হয়। এর বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন মির্জা আব্বাস। তিনি মন্ত্রী ও মেয়র থাকাকালীন কী সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সেটা বিএনপির লোকেরাই ভালমতো জানেন। কবরখানা দখল করে মার্কেট করা থেকে শুরু করে কী অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে! ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁর পরিচয় ছিল মিস্টার টোয়েন্টি পারসেন্ট। তাছাড়া বেগম জিয়া আজ যে বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারছেন এর শুরুটি তিনিই করেন এদেশে। তবে হ্যাঁ, ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির একটা ভাল ভোটব্যাংক আছে। কারণ, ১৯৮৬’র নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান মতিঝিল সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচন করে ৩৬ হাজারের মতো ভোট পেয়েছিলেন। এরপরে দীর্ঘ সময় পার হয়েছে, জামায়াত এর ভেতর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ও ছিল। তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। প্রচার মাধ্যম বেড়েছে। তাই তাদের এ ভোটের সংখ্যা এখন নিঃসন্দেহে বেড়েছে। এর পাশাপাশি বিএনপির অন্ধ সমর্থক তো আছেই। তাই মির্জা আব্বাস কেন, ওখানে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ হয়ে যিনি দাঁড়াবেন, তিনি কিছু ভোট তো পাবেন। নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সাঈদ খোকনের পক্ষে ড. রাজ্জাক সব সময়ই আওয়ামী লীগের গত ছয় বছরের উন্নয়ন ও বিএনপির ধ্বংসযজ্ঞের কথা, পুড়িয়ে মানুষ হত্যার কথা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যানবাহন আগুন দিয়ে ধ্বংস করার কথা বলেছেন। এর পাশাপাশি মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসকে কিন্তু বিএনপি আমলের কোন উন্নয়ন এ আমলে থেমে গেছে এমনটি বলতে কেউ শোনেনি। এমনকি বিএনপি আমলে তাঁরা কি উন্নয়ন করেছিলেন তাও বলেননি। তিনি বার বার বলেছেন, তাঁর নির্বাচনী প্রচারে হামলা হচ্ছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ তিনি নির্বাচন কমিশনে করেননি। ঠিক তেমনিভাবে ঢাকা উত্তরে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হকের পক্ষে সর্বক্ষণিক নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগ নেতা কর্নেল ফারুক খান আওয়ামী লীগের ছয় বছরের উন্নয়ন ও বিএনপির গত তিন মাস ও ২০১৩-এর মানুষ হত্যার কথা তুলে ধরেছেন বার বার। এর বিপরীতে তাবিথ আউয়াল জনগণের কাছে কিন্তু কিছুই বলতে পারেননি। বাস্তবে তাবিথ আউয়াল ও আফরোজা আব্বাসের নির্বাচনী প্রচার সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র তাদের প্রতীক সম্মিলিত লিফলেট বিতরণের মধ্যে। আর বস্তিতে, দরিদ্র এলাকায় ভোটারদের কাছে টাকা বিতরণের মধ্যে। অন্যদিকে চট্টগ্রামে বিএনপির প্রার্থী মনজুর আলম। তিনি গত পাঁচ বছর মেয়র ছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতাকে পরাজিত করে তিনি মেয়র হয়েছিলেন। যাঁদের ওই নির্বাচন সম্পর্কে মনে আছে তাঁরা নিশ্চয়ই বলবেন, ওই নির্বাচনে মনজুর আলমের মূল ইস্যু ছিল তিনি চট্টগ্রাম সিটির জলাবদ্ধতা দূর করবেন। বাস্তবতা হলো, এ নির্বাচনের আগেও চট্টগ্রামের অনেক রাস্তা এত জলবন্দী ছিল যে, মনজুরের গাড়িও অনেক রাস্তায় যেতে পারেনি। অন্যদিকে আমাদের মিডিয়া আ জ ম নাছিরকে ঠিকমতো চেনে না বলে তাঁকে অনেক দুর্বল প্রার্থী বলেও মন্তব্য করেছিল। আ জ ম নাছির ’৭৫-পরবর্তী ছাত্রলীগ প্রজন্ম। এই প্রজন্মের ইতিহাস হয়ত কোনদিন এ দেশে লেখা হবে না। কিন্তু এ প্রজন্মের ইতিহাস ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে। তবে মিডিয়ার লোকদের মনে থাকার কথা, আ জ ম নাছিরকে যেদিন চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি করা হয় সেদিন রেলস্টেশনে তাঁর সংবর্ধনায় উপচে পড়া মানুষের কথা। তাছাড়া তাঁকে মনোনয়ন দেবার পরে শেখ হাসিনা একটি মন্তব্য করেছিলেন, তাঁকে দীর্ঘদিন রাজনীতিতে বঞ্চিত করা হয়েছে। বাস্তবে ’৭৫-পরবর্তী ওই প্রজন্মের অনেকেই রাজনীতিতে এখন বঞ্চিত। সেটা তাঁদের যোগ্যতার ও জনপ্রিয়তার অভাবে নয়। তাঁদের একমাত্র অযোগ্যতা তাঁদের সততা ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। যে কারণে, তাঁদের অর্থবিত্ত হয়নি। তাই মেয়র প্রার্থী অনেক বেকার যুবক থেকেও আ জ ম নাছিরের সম্পদ কম। কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী প্রজন্মের এই সৎ ছেলেগুলোর এলাকায় খোঁজ নিলে জানা যাবে তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছে, এমনকি সব দলের মানুষের কাছে ভাল ছেলে হিসেবে কত জনপ্রিয়। এই ছিল কিন্তু মোটামুটি নির্বাচনে প্রার্থী ও সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার মতো বক্তব্যে দুই প্রতিপক্ষের প্রকৃত অবস্থান। তাই এ ধরনের একটি নির্বাচনের ফল কী হতে পারে, সেটা সাধারণ মানুষ তাদের বুদ্ধি দিয়েই বুঝতে পারে। বিএনপিও বুঝতে পেরে বাংলাদেশে সফররত পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অবস্থানে না গিয়ে একটি ড্র করার চেষ্টা করেছে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে। এটা তাদের পরিকল্পনায় ছিল তাও ইতোমধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে তাঁর বিশ্বস্ত কর্মীর টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হওয়ায়। এখন আমাদের মিডিয়ার একটি অংশ বিএনপির এই ড্র করার চেষ্টাকে জায়েজ করার জন্য নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মাঠে নেমেছে। আরেকটি অংশ শুধুমাত্র তাদের দর্শক বা পাঠক বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কারণ, তাদের মাথার ভেতর এখনও ধারণা নেগেটিভ নিউজই একমাত্র নিউজ। পৃথিবীতে নিউজের ধারণা যে অনেক বদলে গেছে তা তারা জানেন না। আফ্রিকার কোন দরিদ্র দেশের দারিদ্র্য এক শতাংশ কমলে যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় লিড নিউজ হয় এই নিউজ জ্ঞানটি এখনও তাঁদের কাছে পৌঁছেনি। তবে হ্যাঁ, তাঁরা বলতে পারেন, কিছু অনিয়ম তো হয়েছে। অনিয়ম হয়েছে মোট ২৭০০ কেন্দ্রের ভেতর ৫৫টিতে। ইত্তেফাকের হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় গোলযোগ হয়েছিল এমন কেন্দ্রগুলোর ভোটার সংখ্যা এক লাখ। আর ঢাকার মোট ভোটারের সংখ্যা ৬০ লাখ। চট্টগ্রামে ১০ থেকে ১২ হাজার ভোটার আছে এমন ৭টি কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে। তারপরেও নির্বাচনে যে কোন অনিয়মই অনিয়ম। এটা প্রচার পেতেই হবে। এগুলো প্রচার করাই মিডিয়ার কাজ। কারণ, গণতন্ত্র কোন দেশে একদিনে গড়ে ওঠে না। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। মিডিয়া গণতন্ত্র বিকাশে সাহায্য করবেই। কিন্তু কোন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ২৭০০ কেন্দ্রের ভেতর ৫৫টিতে গোলযোগ হলে কেউ কি বলতে পারে ‘হারল গণতন্ত্র’? ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে থেকে পশ্চিমবঙ্গে পৌরসভা ও সিটি নির্বাচন হচ্ছে। গণতন্ত্র কি হেরে যাচ্ছে সেখানে? তাদের তো নির্বাচনী সংঘর্ষে মারা গেছে কয়েকজন। আমাদের তো এবার কেউ মারা যায়নি। ২০০১-এ বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন পৌরসভা নির্বাচনে কত লোক মারা গিয়েছিল? কিভাবে হয়েছিল সে নির্বাচন? সে অবস্থান থেকে বর্তমানের এই ধারাবাহিক উন্নতি কি দেখা হবে না? তবে সত্য কথা বলতে কী আমাদের দেশের নিরপেক্ষতা বলে যে অবস্থানটি তৈরি হয়েছে তা হলো আওয়ামী লীগের সবকিছুতে বিরোধিতা করা ও জামায়াত-বিএনপিকে সমর্থন করা। এর মূল কারণ পুঁজি। দেশী ও বিদেশী পুঁজি। এই পুঁজিই কিন্তু এদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজকে কিনে ফেলেছে। আর সুশীল সমাজের কারণে মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হন এখানে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরা। তবে এবারের সিটি নির্বাচনে অবশ্য ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের বক্তব্য নিয়ে অনেকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে আমার মনে হয়, তিনি তাঁর দেশের বাস্তবতায়, তাদের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা থেকেই সঠিক বলেছেন। কারণ একদিকে তিনি এই নির্বাচনের প্রশংসা করেছেন, বিএনপির নির্বাচন বর্জনকে দুঃখজনক বলেছেন, আবার যে অনিয়মগুলো হয়েছে তার সুষ্ঠু তদন্ত করতে বলেছেন। বার্নিকাট কিন্তু এমনটি বলতে পেরেছেন তাঁর দেশের গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতার কারণেই। কারণ, তিনি তাঁর দেশের বিশাল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডার সন্ত্রাস দেখেছেন, নির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টের একপক্ষীয় রায় দেখেছেন আবার এও দেখেছেন নির্বাচন থেকে কেউ সরে যায় না। অনিয়মগুলো তদন্ত করে ভবিষ্যতের দিকে এগোতে চায় তারা। তিনি দেখেছেন, এখানে নির্বাচনে ফ্লোরিডার থেকে সন্ত্রাস অনেক কম হয়েছে। প্রশাসনের কেউ যদি কোন সাহায্য কাউকে একটু-আধটু করে থাকে তবে তাদের মত বিচার বিভাগ পর্যন্ত একটি দলকে সাহায্য করতে নেমে আসেনি। তাই সব মিলিয়ে তিনি সত্য কথা বলেছেন। এখন সিটি নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা দেশের অনেকের মধ্যে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে। খালেদা আবার কী করবেন এতে অনেকে উদ্বিগ্ন। উদ্বেগের কোন কারণ নেই। কারণ সিটি নির্বাচনের সুযোগে ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ও শওকত মাহমুদ মিলে খালেদাকে কিছুটা অক্সিজেন দিয়েছেন ঠিকই। তবে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র থেকে বের করতে পারেননি। ড. এমাজউদ্দীনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে জানেন, খালেদা যেখানে চলে গেছেন তাতে তাঁকে আর বের করা সম্ভব নয়। খালেদাও কিন্তু তাঁর ভবিষ্যত বুঝতে পেরেছেন ঢাকার রাজপথে বের হয়ে। কারণ, বাঙালী তার শৌর্যের ঐতিহ্য লাঠি দিয়েই খালেদাকে জানিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে তাঁকে প্রতিরোধ করা হবে। বাঙালীর লাঠির ইতিহাস দীর্ঘ। আর বাঙালী যার বিরুদ্ধে লাঠি ধরে তার ভবিষ্যত কী হবে তা ইতিহাস পড়লেই বোঝা যাবে। তাছাড়া ২০১৩’র ৭ মাস ও গত ৯২ দিন খালেদা যখন তথাকথিত আন্দোলন করেছেন তখন ঢাকায় কোন কমিশনার ছিল না। তৃণমূলে মানুষ কিছুটা অসংগঠিত ছিল। এই সিটি নির্বাচনের ভেতর দিয়ে এখন তৃণমূল সংগঠিত। তাদের হাতের লাঠিই আগামী তিন বছর নয় মাস ঢাকা শহরকে তথাকথিত আন্দোলন ও নরহত্যা থেকে নিরাপদ রাখবে। এ কারণে আগামী দিনের স্বস্তি নষ্ট হবে এমন উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নাগরিকদের নেই। এখানেই লেখা শেষ করলে ভাল হতো, তবে নির্বাচন কমিশনকে এখনই একটা ধন্যবাদ না দিলে বিষয়টি বাসি হয়ে যাবে, কারণ এই প্রথম কোন নির্বাচন কমিশন সুজনসহ বেশ কিছু দুর্বৃত্ত সংগঠনকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এই ছদ্মবেশী জামায়াত সমর্থকরা বাদ পড়া অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্য অগ্রগতি। দেশে সত্য ও মিথ্যেকে গুলিয়ে এক করতে দীর্ঘদিন ধরে এরা যে ভূমিকা রেখে আসছে তা সত্যিই জঘন্য। [email protected]
×