ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যে নালে উত্থান সে নালেই বিনাশ

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৯ এপ্রিল ২০১৫

যে নালে উত্থান সে নালেই বিনাশ

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন শুরু হওয়ার মাত্র সোয়া তিন ঘণ্টা সময় গড়ানোর মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে বিএনপি সমর্থিত ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন মনোনীত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। এরপর ঢাকায় বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের বিএনপি সমর্থিত দুই প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মেয়র পদে বিএনপি সমর্থিত এই তিন প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণাকে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে সাজানো একটি নাটক বলে দাবি করলেও চট্টগ্রামে মনজুর আলমের সরে দাঁড়ানোর নেপথ্যে নানা আলোচনা ও গুঞ্জন চলছে। ইতোপূর্বে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে এম মনজুর আলম বিএনপির সমর্থনে মেয়র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত হ্যাটট্রিক বিজয়ী মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে প্রায় ৯৬ হাজার ভোটে পরাজিত করে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। তিনিই আবার এ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে ভোটগ্রহণের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে চমক সৃষ্টি করলেন। নিজ নির্বাচনী প্রধান কার্যালয়ে সরে দাঁড়ানোর এ ঘোষণা দানকালে তাঁর সঙ্গে ছিলেনÑ বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও দলীয় অন্য নেতৃবৃন্দ। এ সময় ২০ দলীয় জোটের কাউকে দেখা যায়নি। তড়িঘড়ি করে এ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয় এবং তড়িঘড়ি করেই তা শেষ করে মনজুর আলম নিজ বাসভবনে চলে যান। বিএনপি নেতারাও ফিরে যান স্ব স্ব গন্তব্যে। মনজুর আলমের আকস্মিক এ সরে দাঁড়ানোর ঘটনার নেপথ্যে যেসব বক্তব্য পাওয়া গেছে তারমধ্যে রয়েছে তার প্রার্থিতা নিয়ে দলে চরম বিভক্তি ও কোন্দল। এছাড়া চট্টগ্রামে দলের হাতেগোনা কয়েকজন নেতা ছাড়া নির্বাচনী প্রচারে তিনি তেমন কাউকে সঙ্গে পাননি। চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে মনজুর আলম ও তাঁর পরিবারের খ্যাতি রয়েছে। টাকার কুমির হওয়ায় তাঁর পক্ষে অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরাও নির্বাচনী প্রচারকাজে যথাযথ ভূমিকা পালন করেননি বলে দলীয় বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের অভিযোগ রয়েছে। নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডাঃ শাহাদাত হোসেন ছিলেন এবারের সিটি নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে মেয়র প্রার্থীর অন্যতম দাবিদার। তিনি মনজুর আলমকে বিএনপির পক্ষ থেকে সমর্থনদানের পর থেকেই বেঁকে বসেন। সঙ্গে তাঁর সমর্থকরাও। মাঝপথে নির্বাচনের কয়েক দিন আগে শুধুমাত্র একদিন ডাঃ শাহাদাত হোসেন মনজুর আলমের সঙ্গে বাকলিয়া এলাকায় নির্বাচনী গণসংযোগ করে গা ঢাকা দেন। তাঁর এ গা ঢাকা দেয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে ইতোপূর্বে ২০ দলীয় জোটের অবরোধ ও হরতালে নাশকতামূলক কর্মকা-ের আসামি হিসেবে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাটি ঝুলে আছে। তাই তিনি আবার গা ঢাকা দেন। এছাড়া মনজুর আলম ২০১০ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে চেয়ারে বসলে তাঁর মেয়াদকালীন তিনি একদিকে নগর উন্নয়নে যেমন তেমন কোন সাফল্য দেখাতে পারেননি, পাশাপাশি বিএনপির দলীয় কর্মকা-েও তেমন কোন অংশগ্রহণ করেননি। এ নিয়ে একদিকে নগরবাসীর যেমন তার প্রতি ক্ষোভ রয়েছে, তেমনি দলীয় কর্মকা-ে যথাযথ ভূমিকা না রাখায় দলের বড় একটি অংশও তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। মনজুর আলম মূলত তিন তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর হলেও ২০১০ সালে বিএনপি তাঁকে কাছে টেনে সমর্থন দিয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়ে দলের সফলতা অর্জনে সাফল্য দেখায়। মূলত মনজুর আলম ও তাঁর পরিবার দীর্ঘ সময়েও আওয়ামী ঘরানার। এছাড়া তিনি হ্যাটট্রিক বিজয়ী মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর একান্ত কাছের লোক। মহিউদ্দিনের কার্যকালীন বিতর্কিত কিছু কর্মকা- ও দাম্ভিকতা প্রদর্শনের সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিল বিএনপি। ওই সময়ে তিনি আওয়ামী ঘরানার হওয়ার পরও আকস্মিকভাবে বিএনপির সমর্থন নিয়ে তাঁর গুরু হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে যে জয়লাভ করেছিলেন তা যেমন এক ধরনের বিস্ময়ের ছিল, এবার নির্বাচনের দিন মাঝপথে সরে গিয়ে ব্যথিতকণ্ঠে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণাটিও হয়েছে চমক। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁকে নিয়ে আলোচনায় সবচেয়ে বেশি যেটি প্রাধান্য পাচ্ছে তা হচ্ছে বিএনপি তাঁকে ঠিকমতোই দু’বার ব্যবহার করেছে। একবার তাঁকে বিজয়ের মুকুট পরাতে সমর্থ হলেও দ্বিতীয়বার অর্থাৎ এবার তাঁকে মনের থেকে দূরে রেখে ভিলেন বানিয়ে ছেড়েছে। এর পাশাপাশি ধনাঢ্য এ ব্যবসায়ীর অর্জিত মোটা অঙ্কের অর্থের ক্ষতিসাধন করেছে। মেয়র প্রার্থী হিসেবে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা খরচ করার নির্বাচনী আইন থাকলেও মনজুর আলমের খরচের পরিমাণ কত কোটিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা একমাত্র তিনি ছাড়া অন্য কারও বলা সম্ভব নয়। বিএনপি নেতাকর্মীদের তাঁর কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি অর্থ গ্রহণ করার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিএনপি নেতাদের পরামর্শে তিনি অতীতে প্রতিদ্বন্দ্বীর এজেন্টদেরও অর্থ দিয়ে কিনে ফেলার বহু আলোচনা রয়েছে। এবার এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অর্থ নিয়ে বেশিরভাগই কেন্দ্রে যাননি। যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁরা জোরালোভাবে তৎপর হননি। অন্যদিকে আবার এটাও ঠিক যে, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তার গুরু হ্যাটট্রিক বিজয়ী মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরামর্শের বাইরে কখনও পা দেননি। চট্টগ্রামে বলা হয়ে থাকে, নামে মেয়র মনজুর হলেও কাজ চলেছে সবই মহিউদ্দিনের ইশারা-ইঙ্গিতে। এসব নিয়ে বিএনপির বড় একটি অংশ তাঁর প্রতি ছিল সাংঘাতিকভাবে ক্ষুব্ধ। এরপরও এবারের নির্বাচনে বিএনপি তাঁকেই পুনরায় মেয়র পদে দলীয় সমর্থন প্রদান করায় দলের বড় একটি অংশ বেঁকে বসে। অপরদিকে, অতীতে দলীয় কোন্দল অন্যতম বড় একটি কারণ হয়ে থাকায় মহিউদ্দিন চৌধুরী হেরে গিয়েছিলেন। এবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কড়া নির্দেশে দলের নেতাকর্মীরা একমঞ্চে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা কাজ করেছেন দিবারাত্রি নাছিরের পক্ষ হয়ে। শুধু চট্টগ্রামের নয়, ঢাকা থেকেও ডাকসাইটের বহু নেতা চট্টগ্রামে এসে নাছিরের পক্ষে অলিগলি চষে বেড়িয়েছেন। ফলশ্রুতিতে বিএনপিতে মনজুরকে নিয়ে বিভক্তি ও কোন্দল এবং বিএনপির সাম্প্রতিক সময়ের নাশকতার আন্দোলন তাঁর জয়ের পথে বড় ধরনের অন্তরায় হয়েছে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের কোন্দলের অবসান ঘটিয়ে নাছিরের জন্য একমঞ্চে নেতাদের সমবেত হওয়ার ফলে তা তাঁর জন্য বিজয়ের পথকে প্রশস্ত যেমন করেছে, তেমনি দলের জন্য বড় ধরনের সম্মান বয়ে এনেছে। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই মূলত বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট এ নির্বাচনে তাদের যোগ্য কোন ব্যক্তি খুঁজে পায়নি। ২০১০ সালেও এমনটি হয়েছিল বলে তারা আওয়ামী ঘরানার মনজুর আলমকে টোপ দিয়ে কাছে টেনে নেয়। এবারও আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির সঙ্গে মেয়র পদে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য তাদের ভাল কোন প্রার্থী ছিল না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে মনজুর আলমকেই আবারও সমর্থন দিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামিয়ে দেয়। বেচারা মনজুর আলম হয়তোবা বুঝতে পারেননি এবার তাঁকে মাঝপথে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে হতে পারে। মঙ্গলবার সকালে তিনি যথারীতি তাঁর ভোটকেন্দ্রে নিজের ভোট দিয়ে অন্যান্য কেন্দ্র সফরের উদ্দেশে বের হন। এ সময় দলীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাঁর কাছে নেতিবাচক খবর আসতে থাকে। বহু কেন্দ্রে তাঁর নিজস্ব এজেন্টও অনুপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আ জ ম নাছির সমর্থকদের ছিল আধিপত্য। এ আধিপত্য পর্যবেক্ষণ করে মনজুরের পক্ষে বিভিন্ন কেন্দ্রে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা কেউ ভোট দিয়ে কেউ না দিয়ে দ্রুত কেন্দ্র ছেড়ে চলে যান। ফলে ইতোপূর্বে বিএনপির কেন্দ্র পাহারা দেয়ার ঘোষণাটি ঘোষণাই থেকে যায়। তাঁর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সকাল এগারোটার মধ্যেই নিজ বাসভবনে ঢুকে যান। আবদুল্লাহ আল নোমানও কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে চলে যান মনজুর আলমের নির্বাচনী কার্যালয়ে। এগারোটার মধ্যে দলীয় নেতারা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। সোয়া এগারোটায় মনজুর আলম তাঁর প্রচারের প্রধান কার্যালয়ে এসে দলের এ ঘোষণাটি বাস্তবায়ন করেন। এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত ছিলেন এবং ঘোষণাই দিলেন শুধু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো নয়, রাজনীতি থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার কথা। বললেন, অতীতের মতো সমাজসেবায় তিনি নিয়োজিত থাকবেন। রাজনীতিতে অতীতে এবং এরপরে যারা তাঁর পাশে থেকে সহযোগিতা দিয়েছেন তাঁদের সকলের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বেচারা মনজুর আলমের এ ঘোষণা মিডিয়ার কল্যাণে যাঁরাই দেখেছেন তাঁরাই ব্যথিত হয়েছেন। তবে বিএনপি তাকে ভালই ব্যবহার করেছে। অতীতে যে গুরুকে তিনি হারিয়ে দিয়ে বিজয়ের মুকুট পরেছিলেন এবার সেই গুরুর শিষ্যের কাছে পরাজয়ের ঘোষণা আসার আগেই নিজেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। একেই বলে নিয়তি। আর নিয়তির অমোঘ বিধান মনজুর আলমকে এবার দূরে ঠেলে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ঘরানা থেকেই ফুলেফেঁপে মোটা হয়েছিলেন। বিএনপি ঘরানায় এসে ব্যবহৃত হয়ে ছিটকে পড়লেন। এ ধরনের ছিটকে পড়া তাঁর জন্য ছিল অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।
×