ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা জিয়ার নীরব বিপ্লবের প্রতিফলন ঘটেনি ভোটকেন্দ্রে

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৯ এপ্রিল ২০১৫

খালেদা জিয়ার নীরব বিপ্লবের প্রতিফলন ঘটেনি ভোটকেন্দ্রে

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ঘোষিত ‘ভোট কেন্দ্র পাহারা দিবে,’ ‘কারচুপি হতে দেবেন না, ‘নিরব বিপ্লব’ ঘটিয়ে ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার প্রতিফলন দেখা গেল না কোন ভোট কেন্দ্রে, কোথাও। জনগণ তো সাড়া দিলই না, এমনকি ভোট কেন্দ্রের প্রার্থীদের এজেন্টও উপস্থিতি নেই, নেতাকর্মীদেরও সরব তৎপরতা হতে দেখা গেল না। শ্যামপুর, গে-ারিয়া, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, হাটখোলা, ওয়ারী, ধানম-ি, আজিমপুর, এ্যালিফেন্ট রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, খিলগাঁও, সিদ্ধেশ্বরী, শান্তিনগর, মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকার আরও অনেক ভোট কেন্দ্রে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পক্ষের নেতাকর্মী, সমর্থকরা কোথায় যেন হতাশায় নিঃসঙ্গ হারিয়ে যেতে দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন, ভোটারদের উপস্থিতি, ভোটদান প্রক্রিয়া, দেখার জন্য ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনের সময়েই খবর পেলাম, ঢাকা দক্ষিণের বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস বলেছেন, তাঁর সমর্থকরা ভোট দিতে না পারায় তিনিও ভোট দিবেন না। তখন সকাল প্রায় এগারোটা। খিলগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের সময় ভোট না দেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। এরই মধ্যে খবর এলো, চট্রগ্রাম, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের বিএনপির প্রার্থীরা একযোগ নির্বাচন বর্জন করেছেন। তখনও রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন কিছু ভোট কেন্দ্রে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটা ছাড়া তেমন কোন বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনকালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষের সমর্থক ও ভোটারদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে মির্জা আব্বাস ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে সাঈদ খোকনের বাবা মেয়র হানিফের কাছে পরাজিত হয়। এখন আবার সাঈদ খোকনের কাছে পরাজিত হওয়ার আগেই মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে আরেক নাটক শুরু করে দিয়েছে। ভোটাররা প্রশ্ন করেছেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়ে এলাম, কোথাও কোন গ-গোল দেখলাম না। ১৯৯৪ সালে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন মোহাম্মদ হানিফ। আর সেই নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বিজয় মিছিলে গুলি চালিয়ে ৭ জনকে হত্যা করেছিল বিএনপি! ঢাকাবাসী কী মঙ্গলবারের ভোটে লালবাগের সেই সাত খুনের বদলা নিল। ভোটকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, একযোগে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিএনপির প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের ঘটনাটি ‘পূর্বপরিকল্পিত’। বর্তমান সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে আবারও পেট্রোলবোমার সহিংস সন্ত্রাসে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি জানান, ভোটের আগের দিন সোমবারও মির্জা আব্বাসের জামিনের শুনানি ছিল উচ্চ আদালতে। কিন্তু তার আইনজীবী প্রস্তুতি নেই বলে আরও সাত দিন সময় নিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি নির্বাচনের প্রচারে নামতে ইচ্ছুক নন এবং নির্বাচনী প্রচারে নামলেনও না। আর বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করলেন, সরকার তাকে নির্বাচনের প্রচারে নামতে দেননি। তারা কি ধরনের মিথ্যাচার করতে পারেন, তা বুঝেন ? বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গত ২৬ এপ্রিল দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ভোট কেন্দ্র পাহারা বসাবেন, কারচুপি হতে দেবেন না, গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে আপনারা কেন্দ্র ত্যাগ করবেন। শুধু তাই নয়, নিরব ভোট বিপ্লব ঘটিয়ে উপযুক্ত জবাব দিবেন। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম-তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে একযোগে নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বান ও তার কথা রাখলেন না বিএনপির নেতৃবৃন্দ ও তিন মেয়র প্রার্থীরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, বেগম জিয়া বলেছেন, ভোটকেন্দ্র পাহারা দেবে, কোথাও কারচুপি হতে দেবেন না, এমন ঘোষণার পর মাত্র কয়েকটি ভোট কেন্দ্রের অনিয়মকে কেন্দ্র করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে তারা সকাল এগারোটার মধ্যেই। এতে প্রমাণ হয়েছে, জনগণতো দূরের কথা, তার দলের নেতাকর্মী, এমনকি ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরাও নির্বচনী মাঠে নেই। ভোটে তাদের জনবিচ্ছিন্নতাও চিহ্নিত হয়েছে তাদের। জন সম্পৃক্ততা থাকলে কেউ কাউকে কোথাও ঠেকাতে পারে কী ? যে দলের এজেন্টরা টাকায় বিক্রি হয় অথবা জানের মায়ায় দায়িত্ব পালনে আসে না, কেউ ভয় দেখালেই দায়িত্ব ফেলে চলে যায়, এমন লোকজন নিয়ে কী করে একটা দল চলতে-টিকতে পারে? বোঝা গেল আবার জ্বালাও-পোড়াও লাইনেই ফিরে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া! সে সামর্থ্য তার আর আছে কী? নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমন বড় ধরনের কোন অঘটন ঘটেনি যে নির্বাচন বর্জন পর্যন্ত গড়াতে পারে। যদি কোন ভোট কেন্দ্রে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা বা অভিযোগ থাকে তাহলে তারা নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করতে পারেন। ভোট কেন্দ্রগুলো পাহারার দায়িত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কর্মকর্তা তাদের অভিযোগ আমলে না নিলে উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করতে করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে লিখিত সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ না দিয়েই নির্বাচন বর্জন করলেন তারা। অতীতের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক চিত্র সন্তোষজনক ছিল বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নির্বাচন কর্মকর্তা। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকতে অতীতে অনেক কলঙ্কময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেমন মাগুরার ভোটারবিহীন নির্বাচন, রমনা-তেজগাঁও এলাকায় ফালু মার্কা নির্বাচন, বিএনপির সরকারের সময়ে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইত্যাদি। বিএনপি গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সরকারকে অবৈধ দাবি করে তিন মাসব্যাপী অবরোধ-হরতালের নামে পেট্রোলবোমার সহিংস সন্ত্রাস চালিয়ে দেড় শতাধিক জনকে হত্যা ও সহস্রাধিক জন আহত ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। সরকারের পতন ঘটাতে না পেরে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বড় বড় বুলি আওড়িয়ে, হুমকি দিয়ে নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে পূর্বপরিকল্পিত নীল নক্সার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। তবে যতই চেষ্টা করুন না কেন আগের মতো সহিংস সন্ত্রাস করার ক্ষমতা বিএনপি-জামায়াত বা তাদের ২০ দলীয় জোটের নেই বলে জানিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বুঝা গেল, ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’।
×