ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতে মাওবাদী আন্দোলন কোন্্ পথে

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৮ এপ্রিল ২০১৫

ভারতে মাওবাদী আন্দোলন কোন্্ পথে

মাওবাদী আন্দোলন ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বাধিক গভীরে ব্যাপ্ত এক সংঘাত, যা দেশটির নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান রূপের এই সংঘাতের সূত্রপাত ২০০৪ সালে বিভিন্ন নক্সাল বা মাওবাদী গ্রুপের সমন্বয়ে সিপিআই (মাওবাদী) গঠনের মধ্য দিয়ে হলেও, বেশ আগে থেকেই ওই গ্রুপগুলোর তৎপরতা চলে আসছিল। আজ মাওবাদী বা নকশালীরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে কেরল, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সেখানে তাদের নিজস্ব প্রশাসন আছে, আইন আছে, আদালত আছে। তবে মাওবাদী বিদ্রোহ দমনে সরকারের অভিযানও থেমে নেই। বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন স্থানে সরকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে মাওবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যাপক ক্ষতিও হয়েছে। কোথাও কোথাও মাওবাদীরা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। অনেক ঘাঁটি তাদের হাতছাড়া হয়েছে। কোবাদ গান্ধীসহ ওপরের সারির অনেক নেতা ধরা পড়েছেন। নিহত হয়েছেন প্যাটেল সুধাকর রেড্ডী ও চেরুকুরি রাজকুমারের মতো শীর্ষস্থানীয় নেতারা। গত এক দশকে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৬ সদস্য গ্রেফতার হয় এবং এনকাউন্টারের নামে তাদের চারজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সিনিয়র নেতাদের সংখ্যা কমে এলেও বিদ্রোহীদের সামরিক শক্তি-সামর্থ্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। তথাপি সামগ্রিক বিচারে বলতে গেলে বেশিরভাগ এলাকায় বিপ্লবী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ও দ-কারণ্য ছিল সিপিআই এমএল-এর পিপল’স ওয়ার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে ঝাড়খন্ড ও বিহারের অংশবিশেষ ছিল মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টারের (এমসিসি) দুর্গ বিশেষ। ২০০৪ সালে দুই গ্রুপ একীভূত হওয়ার পর সংযুক্ত সিপিআইয়ের (মাওবাদী) তৎপরতার ব্যাপক প্রসার ঘটবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো বরং তাদের তৎপরতার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়। ধরপাকড় ও হত্যাকা-ের কারণে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যে ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে, সংগঠনটি সম্ভবত তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সিপিআই (মাওবাদী) সাধারণ সম্পাদক গণপতি নিজেই সে কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সর্বস্তরের বেশকিছু কমরেডকে হারিয়েছি। এ অতি মারাত্মক আঘাত। গত দশ বছরে আমরা গেরিলা অঞ্চলের অভ্যন্তরে অকৃষক ব্যাপক জনসাধারণকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। এটা এক মস্ত ব্যর্থতা।’ তবে সাম্প্রতিককালে মাওবাদীদের সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো, কেরল, কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর সংযোগস্থলে পশ্চিমঘাট বিশেষ আঞ্চলিক কমিটি গঠন। এর মাধমে তাদের ওই অঞ্চলে জোর রাজনৈতিক সামরিক কর্মকা- চালানোর কথা। অবশ্য তেলেঙ্গানায় বেশ মারও খেয়েছে তারা। এককালে বিপ্লবের দুর্গ হিসেবে পরিচিত তেলেঙ্গানায় বিশেষ অঞ্চল কমিটি নয় বরং স্রেফ তেলেঙ্গানা রাজ্য কমিটি কাজ করছে। দ-কারণ্যে মাওবাদী সরকার ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় সত্ত্বেও মাওবাদীরা তাদের লড়াই জারি রেখেছে। তারা বলে যে, এই আন্দোলন প্রগতির উন্নততর মডেলের জন্য। তারা এই সরকারের বিকল্প একটি সরকার দাঁড় করিয়েছে দ-কারণ্যে। সে আরেক জগত- অনুন্নত ভারত। এটাই মাওবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে সক্রিয় ভূখ-। দ-কারণ্যের ৩৫ বর্গমাইল অরণ্য এদের অভয়াশ্রম যুগিয়েছে। এই অরণ্য ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা ও মহারাষ্ট্রের অংশবিশেষজুড়ে বিস্তৃত। এই দ-কারণ্যের প্রায় এক কোটি অধিবাসীর কাছে মাওবাদীরা এক বিকল্প প্রশাসন এবং উন্নয়নের এক বিকল্প মডেল তুলে ধরছে। অর্থাৎ গড়ে উঠেছে সমান্তরাল কর্তৃত্ব। সেখানে গণআদালত আছে, সশস্ত্র ক্যাডার আছে। দ-কারণ্য মাওবাদীদের জন্য অভয়ারণ্য বিশেষ এবং তার মধ্যে আবুজমার হলো রীতিমতো দুর্গের মতো। এটা আসলে অরণ্যের মধ্যে আরেক অরণ্য। অতি দুর্গম একটা এলাকা। ভারতের প্রথম মাওবাদীরা অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যবিত্ত কমিউনিস্ট র‌্যাডিকেলরা আবুজমারে আসে ১৯৮৯ সালে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দমন অভিযান থেকে বাঁচতেই তারা এখানে পালিয়ে আসে। আবুজমারের এই অরণ্য না থাকলে তাদের আন্দোলন কবেই শেষ হয়ে যেত। এই অরণ্য তাদের নতুন প্রাণশক্তি যোগায়। এখানে অরণ্যের গভীরে আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে তারা নিজেদের আদর্শ ও সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রসার ঘটায়। যে দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারেরও কম এবং সেখানে শহরের এলিট শ্রেণীর একজন মানুষ দিল্লীর বারে বসে এক রাতে মদের পেছনে যে টাকা ওড়ায়, তা একজন কৃষকের মাসিক রোজগারের বেশ কয়েকগুণ বেশি, সেখানে আদিবাসী অধ্যুষিত অবহেলিত অনুন্নত এলাকায় জঙ্গী কমিউনিস্ট মতাদর্শের যে প্রসার ঘটবে, তাকে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অথচ অবাক ব্যাপার হলো যে, বর্তমানে মাওবাদী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড় হলো ভারতের সবচেয়ে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এক অর্থে এই খনিজ সম্পদ, বিশেষত কয়লাই বলা যেতে পারে এ অঞ্চলের মাওবাদী আন্দোলনে ইন্ধন যুগিয়েছে। মাওবাদীরা কি চায় মাওবাদীদের নিকষিত লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী আমলা, বুর্জোয়া ও বৃহৎ ভূস্বামী শ্রেণীকে সমূলে উৎখাত করে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্যে গণবাহিনী গড়ে তুলেছে তারা। এই বাহিনীর যোদ্ধারা তাদের ভাষায়, বুর্জোয়া-সামন্ত রাষ্ট্রের পাহারাদার পুলিশ ও সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়ছে। মাওবাদী সহিংসতায় ১৯৮৯ থেকে শুরু করে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১২ হাজারেরও বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। তার মধ্যে সিভিলিয়ান ৬৬১৫, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় আড়াই হাজার এবং মাওবাদী যোদ্ধা ৩ হাজারের ওপর। গণবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১০ হাজারের ওপর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে হাল্কা অস্ত্র। ২০০৭ সালে মাওবাদীরা ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রাজ্যে তৎপর ছিল, যা ভারতের ভূখ-ের প্রায় ৪০ ভাগ। এর মধ্যে ৯২ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০০৯ সালে তারা ১০টি রাজ্যের প্রায় ১৮০ জেলায় সক্রিয় ছিল। ২০১১ সালে মাওবাদী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে আসে- ৯টি রাজ্যের ৮৩ জেলায়। পরে তা আরও বেশি সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। সূত্র : দি হিন্দু এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক (চলবে)
×