ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ২৮ এপ্রিল ২০১৫

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

দেশীয় সুশীল সমাজের একাংশসহ রাজনীতিবিদদেরও কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে গোলটেবিল, লেখালেখি, সাক্ষাতকার ও টকশোতে সেনাবাহিনী ও সেনাশাসনের সমর্থনে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে থাকেন। চলমান ধারাবাহিকে এরই কিছু প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ২৫ এপ্রিলের পর আজ পড়ুন... জিয়াকে সিভিল সমাজের রাজনীতিবিদরা ও সিভিল সমাজের অনেকেই সমর্থন করেছেন। মঈনের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। ড. কামাল হোসেন সক্রিয়ভাবে, পরোক্ষভাবে সব রাজনৈতিক দলের কিছু সদস্য, সিভিল সমাজের ড. ইউনূস, মতিউর রহমান, আসিফ নজরুলের মতো তরুণ সবাই সমর্থন করেছিলেন। জিয়া রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন ডিএফআইয়ের সাহায্যে, মঈন ডিজিএফআইয়ের সাহায্য নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দল করতে পারেননি, পার্থক্য এখানেই। সুতরাং বলা যেতে পারে, সামরিক বাহিনী পরিকল্পিতভাবে সিভিল সমাজের কিছু ব্যক্তির সমর্থনে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু বিশ্বে যেহেতু সামরিক শাসনকে জংলি শাসন হিসেবে দেখা হয়, সে জন্য সামনে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি আবরণ তৈরি করে। কিন্তু ক্ষমতা ছিল সেনাবাহিনীর হাতেই। ফর্ম এবং কৌশলটা বদলে ছিল। এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন জেনারেল মঈন এপ্রিলের গোড়ায় ঘোষণা করেন দেশ আর নির্বাচনের গণতন্ত্রে ফিরে যাবে না। বিএনপি-জামায়াত সরকারকে যেহেতু সেনাবাহিনীই ক্ষমতায় এনেছিল, সেহেতু বিএনপির প্রতি তাদের মধ্যে একটি সহানুভূতি ছিল। উপদেষ্টা নির্বাচনে সেটি পরিষ্কার। আন্দোলন আরো কিছুদিন চললে, বিএনপি দল হিসেবে ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হতো। সেনাবহিনী এটা চায়নি। তারা চেয়েছে বিএনপি থাকুক। তবে তা থেকে অতি পরিচিত সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজরা হটে যাক। তাহলে একটি ক্লিন বিএনপি সেকেন্ড ফ্রন্ট হিসেবে থাকবে, প্রয়োজনে যাকে ব্যবহার করা যাবে। দু’বছরের তাদের কর্মকাণ্ড, সে কথাই প্রমাণ করে। ॥ ৬ ॥ পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসকরা যে ধরনের বাক্যবাগধারা ব্যবহার করতেন বা প্রত্যয়ের ব্যাখ্যা দিতেন এবং দেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সে ধরনের বাক্যবাগধারা বা প্রত্যয়ের ব্যাখ্যা করেছেন সামরিক শাসকরা তো বটেই, পরবর্তীকালের রাজনৈতিক শাসক এবং মিডিয়া। বিশেষ করে মিডিয়া এমনভাবে এসব বাক্য ব্যবহার করেছে যে, জেনারেশনের পর জেনারেশন একই ধরনের বাক্য ব্যবহার করছে বুঝে না বুঝে। তাদের চিন্তার অন্তর্গত হয়ে গেছে এ সব এবং তারা তা স্বাভাবিক মনে করে। আমি এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেব। সেনাবাহিনী যে ভাষা ব্যবহার করে, তার ধরন পাকিস্তানের। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী একটি আদর্শ সৃষ্টি করার জন্য কিছু শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করে, যা শুধু সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। আবার তাদের কিছু ভাষা ও শব্দ রাজনীতিবিদরা ব্যবহার শুরু করেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। পাকিস্তানী কায়দায় ১৯৭৫ সালের পর সেনাবাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি নতুন বাক্য চালু করা হয় প্রচারমাধ্যমে, যা পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদরাও তোতাপাখির মতো আওড়ে যাচ্ছে। যেমন- ১. সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা সার্বভৌমত্বের প্রতীক। অর্র্থ : অন্যরা বিশৃঙ্খলা ও অধস্তনতার প্রতীক। ২. সেনাবাহিনীর উল্লেখ করলেই বলা হয়- ‘এ স্মার্টলি ড্রেসড কনটিনজেন্ট।’ অর্থ : সেনাবাহিনী স্মার্ট, অন্যরা নয়। পৃথিবীতে পাকিস্তান ছাড়া বোধহয় আর কোথাও সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে এ ধরনের বাক্য উচ্চারিত হয় না। ৩. সৈনিকরা সরল ও সৎ। উদাহরণ, প্রচারণায় জিয়ার ছেঁড়া গেঞ্জি ও ভাঙা স্যুটকেসকে গুরুত্ব দেয়া। এরশাদের সাইকেল চালানো। অর্থ : অন্যরা নয়। ৪. জাঁকালোভাবে সেনা প্যারেড প্রদর্শন। সামরিক জাদুঘর নির্মাণ- লক্ষ্য করুন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নয়। যদিও এ সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ৫. রাজনীতিবিদরা সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী। তারা দুর্নীতিবাজ। জিয়ার আমল থেকে এ পর্যন্ত এ ধরনের বাক্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। এরশাদ আমলের কথা আগে উল্লেখ করেছি। এখানে আর তা ব্যাখ্যা করছি না। জিয়ার সামরিকীকরণের বিষয়টিকে তিনি শুধু আরো এগিয়ে নিয়েছিলেন। লক্ষ্য করবেন, মিডিয়াও সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে ঐ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে। এসবের সংকলন করলে তার নাম হতে পারে প্রতিক্রিয়াশীল শব্দকোষ। আইয়ুব খান যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করা হচ্ছিল। এ নৈরাজ্য কারা সৃষ্টি করে? কেন, সিভিলিয়ানরা। জিয়া এরশাদও তাই বলেছিলেন। এবং জেনারেল মঈনও সে ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। তাঁরা বলেন, এই নৈরাজ্য সৃষ্টি দেশকে নিয়ে যায় ধ্বংসের পথে। এবং দেশকে সেই ধ্বংস থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব কার? দেশপ্রেমিকদের এবং সেই দেশপ্রেমিক কারা? কেন, সেনাবাহিনী। জেনারেল মঈন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম ব্যাচের ছাত্র। তাঁর সঙ্গে জিয়াউর রহমান ও আরও আগে পাকিস্তানী জেনারেলদের সময়ের পার্থক্য অনেক। তারপরও দেখুন তাদের ভাষার কোন পরিবর্তন হয়নি। দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর ফ্লোরিডা থেকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন- “একজন সৈনিকের কাছে তার দেশের স্বার্থ সবসময় বড় হয়ে দেখা দেয়। ওই সময়ে আমিও সৈনিক হিসেবে দেশকে রক্ষায় এগিয়ে যাই। ... সে সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা দেশকে বিপজ্জনক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিচ্ছে বলে সকলে আশঙ্কা করেছিলেন। হানাহানি-সংঘাতে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। সে দুঃসহ স্মৃতি যাদের হৃদয়ে আছে, তারা উপলব্ধি করবেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাহসের সঙ্গে ওই পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। জেনারেল মঈন বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সকল সদস্যকে কৃতজ্ঞতা জানান।” [দৈনিক আমাদের সময়, ২৭.৭.২০০৭] জেনারেল মঈন-উ-আহমেদ আরেকটি বক্তৃতায় বলেন- “বন্যাদুর্গত মানুষের দিক থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা করেছিল। সরকার তা প্রতিহত করেছে।” [আমার দেশ, ২৬.৮.০৭] ‘নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র’ এ শব্দ তিনটি সব আমলে সরকার (তা নির্বাচিত, অনির্বাচিত যাই হোক না কেন) থেকে বলা হতো প্রতিবাদকারীদের। সেনাপ্রধানের বাক্যটিকে দেখা যাক। ২১/৮ ঘটনার আগে বন্যা, মহামারী মানুষকে কাবু করে ফেলেছিল, মৃত্যু হচ্ছিল। মৃত্যুর সংখ্যা জানানো হচ্ছিল না। জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে, শেখ হাসিনার গ্রেফতার নিয়ে অসন্তোষ, টিভি চ্যালেনগুলোতে টকশোতে খোলাখুলি সেনা ও উপদেষ্টাদের সমালোচনা, বিভিন্ন কলামে ক্ষোভ প্রকাশ শঙ্কিত করে তুলেছিল সেনাপ্রধানকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা তাদের সুযোগ এনে দিল। সেনা ক্যাম্প তুলে নেয়ার মধ্যে দিয়েই ব্যাপারটির সমাপ্ত হচ্ছিল। কিন্তু দেখা গেল, রাতে যখন ছাত্ররা আনন্দ করছে, তখন পুলিশ বেধড়ক আক্রমণ করছে। পরদিনও ক্যাম্পাসে মিছিল সেরে ছাত্রছাত্রীরা ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশি আক্রমণে আবার দাঙ্গা বেঁধে যায়। এটি ছিল প্ররোচনা, যেটি কেউ বিবেচনার মধ্যে আনেননি। প্রথমে নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্রটা করেছে এ সরকারপ্রধান। তার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভাংচুর হয়েছে। এবং তারপর সব ধরনের সরকারবিরোধী সমালোচনা, প্রায় এক লাখ লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে যাকে যখন খুশি গ্রেফতারের অজুহাত, ছাত্রদের পেটানো, আতঙ্ক সৃষ্টিতে ডিজিএফআই ও তাদের সংশ্লিষ্ট পত্রিকাগুলোর আধিপত্য, সবই করা হলো। ডিজিএফআইর (যদিও উল্লেখ করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা) খবরটি প্রাধান্য দিয়ে ছেপেছিল আমাদের সময়, আমার দেশ, ইনকিলাব, দিনকাল। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ নেতারাও প্রায় সময় ঠিক একই ধরনের বাক্য ব্যবহার করেছেন বিরোধীদের মোকাবেলায়। এটি ঠিক, অনেক সময় এতে সত্যতা থাকে। কিন্তু কোনটি সত্য, কোনটি নয় সেটি আমাদের পক্ষে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। মঈন-উ-আহমেদের সময় প্রবলভাবে শিক্ষক-ছাত্রদের লাঞ্ছনা ও নির্যাতন করা হয়। এরশাদ জিয়া আমলে ছাত্ররা লাঞ্ছিত বা নির্যাতিত হয়েছেন কিন্তু শিক্ষকদের গ্রেফতার বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনা পরবর্তীকালে সরকারের পতন ডেকে আনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভায় অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম লাঞ্ছনার কথা তুলে ধরেন। একই দিন সাংবাদিক ও সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী চ্যানেল আইএ মধ্যরাতে আমাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এটি তুচ্ছ ঘটনা। অনেক দায়িত্বশীল সংবাদপত্র ঘটনাটিকে তাই বলেছে। সেনাপ্রধানও ত্রাণ বিতরণকালে শরীয়তপুরে বলেন, “২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত একটি তুচ্ছ ঘটনার সুযোগ নিয়ে একটি অপশক্তি দেশে নৈরাজ্যকর পরস্থিতির সৃষ্টি করতে চেয়েছিল... কিন্তু আমরা সতর্ক থাকায় তাদের নীল নকশা বাস্তবায়ন হয়নি...” (আমার দেশ, ২৩.৮.০৭)। ‘অপশক্তি’ কে বা কারা, কখনও তা উল্লেখ করা হয় না। ‘নীল নকশা’ কী এবং কার করা তাও বলা হয় না। এখানে তো বলা যেতে পারে, সেনাবাহিনীই নীল নকশা করে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেছে ও ড. ফখরুদ্দীনের মতো মেরুদণ্ডহীন এক আমলাকে খুঁজে বের করেছে যার গুণাবলী পিএইচডি অর্জন করা ও বিশ্বব্যাংকে মাঝারি মাপের চাকরি। এবং বেছে বেছে তারা বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের নিয়ে পুতুল উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছে। (চলবে)
×