ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৪ এপ্রিল ২০১৫

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

(২২ এপ্রিলের পর) উল্লেখ্য যে, সামরিক শাসন উৎখাত হলেও এ ধারণাগুলো দীর্ঘদিন বলবত থাকে। কারণ নিয়তিবাদ থেকে পরিত্রাণ দুরূহ যদি-না দেশের অর্থনীতি সচ্ছল হয় এবং তাই হঠাৎ কোন প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক দুর্যোগে নিয়তিবাদী মানুষ ধর্মকে আঁকড়ে ধরে এবং ধর্মের রক্ষক হিসেবে আবার সামরিক-কর্তৃত্ব মেনে নেয়। এভাবে, সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি মানুষের মনে এক মনস্তাত্ত্বিক ভীতি সৃষ্টি করে এবং তা সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পটভূমি সৃষ্টি করে। এ অবস্থা বা চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে রাজনীতিবিদদের বেসামরিক কর্তৃত্ব স্থাপনে দৃঢ়তা ও সাহস থাকলে। এ কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের কার্যকলাপ সংসদ কমিটির অধীনে নিয়মিত পর্যালোচনা করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিয়ে আসতে হবে বেসামরিক কর্তৃত্বের অধীনে। পার্লামেন্টে আলোচনা করতে হবে সামরিক বাহিনীর বাজেট এবং যে কোন অভ্যুত্থানের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে অভ্যুত্থানের নায়কদের। সম্প্রতি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে শেষোক্ত বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ॥ ৫ ॥ আগেই উল্লেখ করেছি বেসামরিক শাসন যাতে দৃঢ় ভিত্তি না পায় সে জন্য বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে নানা ধরনের হাঙ্গামার বা অরাজকতার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবিমিষ্যকারিতার কথা আমি এখানে অস্বীকার করছি না। কিন্তু এই অবিমিষ্যকারিতাকে উস্কে দেয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। সিভিল সমাজেও ব্যক্তি, গ্রুপ, মিডিয়ায় তাদের সমর্থনকারী নানাভাবে সৃষ্টি করা হয়। পাকিস্তানে বার বার এ ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশেও। এর একটি উদাহরণ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। এখানে রাজনীতিবিদদের অবিমিষ্যকারিতা ছিল। কিন্তু এটি কি সৃষ্টি করা হয়েছিল? উস্কে দেয়া হয়েছিল? এখানে আরও উল্লেখ্য যে, যেভাবে এই সরকার ক্ষমতায় আসে এবং যেসব কার্যক্রম নেয় তাতে বোঝা যায় যে, তারা একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে এবং পুরো বিষয়টি পরিকল্পিত। তারা আড়ালে থেকে সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার [সিভিল] রেখে কাজ চালিয়েছেন। পরিকল্পনাটা ছিল ভবিষ্যতে অবস্থা অনুকূল মনে হয় সামরিক-সিভিল মিলে একটি মিশ্র সরকার হবে কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা থাকবে সেনাবাহিনীর হাতে। পুরো বিষয়টি যে পূর্ব পরিকল্পিত তা বোঝা গেল যখন সিভিল সমাজের অতি পরিচিত কয়েকজন এই সরকারকে সমর্থন দেয়া শুরু করলেন অথচ যাদের এটি করার কথা নয়। সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রশংসায় এবং শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিনাশে দৈনিক প্রথম আলো এক রকম মুখপাত্র হয়ে ওঠে। মতিউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রভূত প্রংশসা করে লেখেন, “দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা যদি দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করতে পারেন, তা’হলে দেশের সঙ্কটকালে কেন ভূমিকা রাখতে পারবে না।” [১৪.১.২০০৭] এখানে বলে রাখা ভালো যে জরুরী ক্ষমতা অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল তার সঙ্গে সামরিক আইনের বিধি বিধানের খুব একটা অমিল ছিল না। ড. মোহাম্মদ ইউনূস এক সাক্ষাতকারে জরুরী অবস্থাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ক্ষমতা দখল নিয়ে প্রধান দুই দলের লড়াই ... কারণ, ক্ষমতায় থাকলে অর্থ বানানো যায়। এখানে কোনো আদর্শিক বিষয় নেই। মালামালের বড় অংকের মালিক কে হবে সেটাই হচ্ছে মূল বিষয়।’ [ঐ] প্রথম আলো, দেশের পরিস্থিতি ও জরুরী আইন ও করণীয় বিষয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে যেখানে উপস্থিত ছিলেন ৮ জন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও তার উর্ধ পদধারী। তাদের আলোচনার নির্যাস ছিলÑ “১. বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দিয়ে পরিবর্তন আনতে হবে, ২. সেনাবাহিনী ব্যবহারে বিচক্ষণতা ও পরিমিত বোধের প্রয়োজন এবং ৩. বর্তমান সরকারকে আরো সহায়তা দিতে হবে।” [ঐ] ড. কামাল হোসেন বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন নানা রকম দায়িত্ব পালন করছে। তাদের বিভিন্ন রকম দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। এখন এখানে একটা সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে কাজ করছে, সামরিক বাহিনী যে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছে, এখানেও সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে। অসাংবিধানিক কোনো কাজ যেন তাকে করতে না হয়। এ কারণে আমি মনে করি একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত। এটা জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল বা জাতীয় সমন্বয় পরিষদ নামেও করা যেতে পারে। আমি সতর্ক করতে চাই যে, এটা যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সামরিক বাহিনী মিলেই করে।’ [প্রথম আলো, ২৮.১.২০০৭] মঈনুল হোসেন বলেন, “আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা ভূমিকম্প হয়ে গেছে। অনেক কিছু ভেঙ্গে গেছে। আগুন লাগালে ফায়ার ব্রিগেড যে ভূমিকা পালন করে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।” [প্রথম আলো, ১২.৪.২০০৭] ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সমর্থক, ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা জিডব্লিউ চৌধুরীর স্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী ঘোষণা করেন “১৯৯১ সাল থেকে এ দেশে গণতন্ত্র যাত্রা শুরু করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলি তাকে সুসংহত করার জন্য কোনো কাজ করেনি। ... অনির্বাচিত সরকারের কাছে জনগণের আশা দিন দিন বাড়ছে। এটি এই সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। ... দেশে এখন বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করছে।” [প্রথম আলো, ১১.৪.২০০৭] তিনি জাহাঙ্গীরনগরে বসে কীভাবে দেশের আশা ভরসার কথা জানলেন তা অবশ্য উল্লেখ করেননি। আসিফ নজরুলের মতো বিএনপিপন্থী কলাম লেখকও লেখেন “এটি হোক দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অনেকের অপকর্মের বহু সংবাদ ১৫ বছরের গণতান্ত্রিক আমলে আমরা পেয়েছি। যারা বাকি আছেন তাদেরও অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।” সেনাবাহিনীর সমর্থক দেশীয় নেটিভ ছাড়া প্রাক্তন পাকিস্তান প্রশিক্ষিত সেনা কর্মকর্তারা গোলটেবিল, লেখালেখি, সাক্ষাতকার বিবৃতির মাধ্যমে সেনাশাসনকে সমর্থনের জন্যে এগিয়ে এলেন। সেনা স্টাবলিশমেন্ট তাদের পুরস্কৃত করেছিল। কয়েকটি উদাহরণ দিইÑ ১. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনÑ ‘এটা কোনো সামরিক টেকওভার নয়। ... যদিও জরুরী অবস্থা দেশে আছে। একটা পার্লামেন্ট নেই, কোনো কেবিনেট নেই। সে জন্য সামরিক বাহিনীর একটা রোল আছে এবং সেটা থাকবে।’ দেশের প্রধান সমস্যা কী? সাখাওয়াতের মতে, ‘আমরা গত ১৫ বছরের কোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি শক্তভাবে গড়তে পারিনি এবং দু’টি প্রধান দলে এখন দেশটি ভাগ হয়ে গেছে সেখানে প্রতিযোগিতার রাজনীতি না হয়ে সংঘাতের রাজনীতি হয়েছে।... গণতন্ত্র একটা ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পারলে যা প্রয়োজন সেগুলির সংঘাতের আগে নির্বাচন করা হবে জনগণের সঙ্গে হঠকারিতা।’ [প্রথম আলো, ৫.১.২০০৭] (চলবে)
×