ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

গড় আয়ু বৃদ্ধি পরিণতিতে কী হতে পারে?

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ২৪ এপ্রিল ২০১৫

গড় আয়ু বৃদ্ধি পরিণতিতে কী হতে পারে?

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ বা পার্টিশনের পরের ঘটনা। আমরা তখন ছোট। আমাদের গ্রাম, পার্শ¦বর্তী গ্রামগুলোতে লোকের বসন্ত রোগ হচ্ছে। জলবসন্ত নয়, গুটিবসন্ত। আজকে এই বাড়ির লোক মারা যায় তো কালকে ঐ বাড়ির লোক। কবিরাজ মহাশয় ব্যস্ত। নিমপাতা নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ি বাড়ি। সারা গ্রাম নিস্তব্ধ। এক বাড়ির লোক আরেক বাড়িতে যায় না। কিছুকাল পরে দেখা দিল কলেরা। ওতে আমার নিজের ঠাকুরমা মারা যান। চেয়ে চেয়ে দেখলাম অসহায়ের মতো। পুুরো গ্রাম এই রোগে আক্রান্ত। কবরের সংখ্যা বাড়ছে, শ্মশানের নিস্তার নেই। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হচ্ছে। আমরা বাচ্চারা কিছুই বুঝি না। ডাক্তার নেই, চিকিৎসা নেই। থানা হেডকোয়ার্টারে একজন-দুইজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, একজন ‘এলএমএফ’ ডাক্তার। একজন সদ্য পাস করা ‘এমবিবিএস’ ডাক্তার এসেছেন। কিন্তু তার পেশার পসার নেই। চারদিকে ভীতিকর পরিবেশ। কলেরার চিকিৎসা কী কেউ জানে না। নিয়তিই ভরসা। বড় হচ্ছি, হয়েছি এসব দেখতে দেখতেই। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখেছি। ডায়রিয়া দেখেছি। দেখেছি, কিন্তু চিকিৎসা কী আমরা জানতাম না। ডায়রিয়ার চিকিৎসা কত সহজ আজকাল। সস্তা স্যালাইন। এটা আমাদের যুবক বয়সে কয়জন জানতাম। বিনা চিকিৎসায়, বিনা ওষুধে কত শত শত, হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। কলেরা, বসন্ত ,উদরাময়, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া কত প্রকার রোগ। রয়েছে যক্ষ্মা রোগÑ যার কোন চিকিৎসা নেই বলা হতো। লোক যক্ষ্মারোগীর ধারে-কাছেও ঘেঁষতো না। এসব দেখতে দেখতে চলে গেছে ‘পাকিস্তান’ আমলের ২৪ বছর (১৯৪৭-১৯৭১)। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালে আমরা কী দেখছি? কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের অবস্থা কী? বলা যায় এসব কোন রোগই নয় এখন। এসব রোগের চিকিৎসা এখন সহজলভ্য, খরচও কম এই চিকিৎসায়। এই যে চিকিৎসা সেবার উন্নতি এর ফল কী? ফল অবধারিতভাবে একটা। মানুষ আজ কথায় কথায় মারা যায় না। সর্বনিম্ন চিকিৎসার সুযোগ আছে। কথায় কথায় মারা না গেলে, এসব রোগে গ্রামকে গ্রাম সাফ না হলে, অন্যভাবে বলতে গেলে এসব রোগের প্রকোপ হ্রাস পাওয়ায় মানুষের আয়ু বাড়ছে। জনে জনে আয়ু বাড়লে দেশের মোট মানুষের গড় আয়ু বাড়ে। অবশ্য শুধু এ কারণেই নয়, অন্য অনেক কারণও আছে যাতে গড়আয়ু বাড়ছে। শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পাচ্ছে। মাতৃত্বকালীন মৃত্যু হ্রাস পাচ্ছে। আগে এই দুই ক্ষেত্রেই মৃত্যু ছিল নিয়তি। মানুষ ‘উপরওয়ালাকে’ ডাকত মাতৃত্বকালীন সময়ে। এখন এসবের সমস্যা কম। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য, অতি দরিদ্র্যের সংখ্যা কমছে। কমছে মানে বেশ কমছে। আগে এমন সময় যেত যখন বাড়িতে প্রতিবেশীদের কেউ না কেউ দু’মুঠো ভাতের জন্য প্রার্থনা করত। এমন সময়ও গেছে ভাত না পেয়ে মানুষের ভাতের ‘ফেন’ চেয়েছে। উত্তরবঙ্গে মঙ্গা ছিল প্রতিবছরের ঘটনা। আজ এসব অতীতকালের ঘটনা। এটা দারিদ্র্য ও অতি দরিদ্র্য হ্রাসের একটা ফল। ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যায়। আগে প্রাইমারি স্কুল গ্রামে গ্রামে ছিল না। হাইস্কুল ছিল ৫-৭-১০ মাইল পর পর। কলেজ তো ‘দুরস্ত’। মহকুমা (আজকের জেলা) শহরে ছিল কলেজ। কলেজে পড়তে ‘লজিং’ থাকতে হতো। এমনকি হাইস্কুলে পড়তেও অনেককে ‘জায়গীর’ থাকতে হতো। আর আজ বলতে গেলে পাড়ায় পাড়ায় কলেজ, মহিলা কলেজ। স্কুল, হাইস্কুল তো ডাল-ভাত। নব্বই শতাংশ ছেলেমেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। গ্রামে গ্রামে গ্র্যাজুয়েট ছেলেমেয়ে। আগের দিনে কেউ ম্যাট্রিক পাস করলে তাকে দেখতে আসত লোকেরা। এই উন্নতি, অবস্থার পরিবর্তন তার ফল কী? এসবের সম্মিলিত ফল হচ্ছে গড় আয়ু বৃদ্ধি। গড় আয়ু বৃদ্ধিতে কাজ করছে মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা। দুই-তিনদিন আগে কাগজে দেখলাম বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রতিবছরই বাড়ছে। এর মধ্যে ছেলেদের গড় আয়ু মেয়েদের তুলনায় কম। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সালে আমাদের গড় আয়ু ছিল ৭০ দশমিক ১ বছর। ২০০৯ সালে তা ছিল ৬৭ দশমিক ২ বছর। ‘বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটস্টিকস’ (বিবিএস)-এর তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশের মেয়েরা পুরুষের তুলনায় গড়ে পৌনে তিন বছর বেশি বাঁচে। কী দারুণ ভাল খবর ভাবা যায়। বিশেষ করে উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে। পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অনেক সামাজিক সূচকের অবস্থা ভাল। স্কুলে ভর্তির সংখ্যা, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, সুপেয় জলের প্রাপ্যতা, গড় আয়ু, মেয়েদের শিক্ষা ইত্যাদি সূচকের নিরিখে বাংলাদেশের পারফরমেন্স প্রশংসনীয়। এই বিষয়গুলোতে আমাদের অগ্রগতি বিগত ৫-৭ বছরের মধ্যে অধিকতর গোচরীভূত হচ্ছে। কারণ এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতির গতি বা হার ইদানীংকালে বেড়েছে বেশি করে। এতসব ভালর মধ্যে দুই-একটা উদ্বেগের খবরও আছে। এর মধ্যে বড় উদ্বেগের খবর হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাড়ছে। ২০১২ সালে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা হয়েছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এই হিসাব এমনিতেই উদ্বেগজনক। আমি জানি না এতে দুটো হিসাব নেয়া হয় কি-না, নিলে বা না নিলে কিভাবে? বাংলাদেশী অভিবাসী যারা বিদেশে বসবাস করছে, অথবা যারা দুই দেশের নাগরিক। দ্বিতীয়ত সংখ্যালঘুদের শতাংশ হিসাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিম্ন হার। তাদেরটা এত নিম্ন হার যে ঐ নিম্নহারের পরেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০১৩ সালে জাতীয়ভাবে বেড়েছে। যদি তাই হয় তা হলে তা উদ্বেগজনক আরও বেশি। অবশ্য আজকাল কেউ কেউ জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কোন সমস্যা মনে করেন না। তাদের মতে, বাংলাদেশ জনসংখ্যা বা মানুষ রফতানি করবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের অভাব হবে, আর আমরা সেই ঘাটতি পূরণ করব। আবার ধর্মীয়ভাবে অনেকে বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবে দেখে। এসব যুক্তির বিপক্ষে, পক্ষে অনেক কথা আছে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার হতে হবে- আর সেটা হচ্ছে জনসংখ্যা নীতি। এর পরিষ্কার দিকনির্দেশনা থাকা দরকার বলে মনে করি। যে কথা দিয়ে শুরু সে কথায় ফিরে আসি। গড় আয়ু বা বাংলাদেশীদের আয়ুষ্কাল বাড়ছে। দৃশ্যত ভাল খবর। একদিকে যদি আয়ুষ্কাল বাড়ে, আরেকদিকে যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় তাহলে শেষ পর্যন্ত কী আমরা ‘বৃদ্ধের জাতিতে’ পরিণত হব না? এটা তো অঙ্ক! এই অঙ্কে তো উন্নত জাতিদের আজকে যে অবস্থা, সেই একই অবস্থায় আমরা পৌঁছাব। দ্বিতীয় সমস্যা গড় আয়ু বাড়ার সাথে সাথে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়বে। এখনই তা দৃশ্যমান। ৬০-৭০, এমনকি সত্তরোর্ধ বয়সের লোক এখন ঘরে ঘরে। ৫৯ বছরে সরকারী চাকরিতে অবসরগ্রহণ। বেসরকারী চাকরিতেও অবসরগ্রহণ বিধি আছে। আয়ুষ্কাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসরকালীন লোকের সংখ্যা বাড়ছে। এতে অবসরভাতার বোঝা দিন দিন বাড়তে বাড়তে সহ্যসীমার বাইরে যাবে না কি সরকারী ব্যয়। এছাড়া বৃদ্ধদের চিকিৎসার ব্যবস্থা কি? যতই বৃদ্ধদের সংখ্যা বাড়বে ততই তাদের জন্য কী গ্রামে, কী শহরে চিকিৎসার সুযোগ বাড়াতে হবে। এর জন্য অগ্রিম কোন পরিকল্পনা আছে কী? সকল বৃদ্ধ তাদের চিকিৎসা খরচ বহন করতে পারবে না, সকল বৃদ্ধ তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করতে পারবে না। তাদের চলাচলের বিষয় আছে। এসবের কী হবে? আয়ুষ্কাল বাড়া যেমন আনন্দের খবর, তেমনি এই বিষয়গুলোও চিন্তার বিষয়। সামাজিক যে অবস্থা তাতে আমাদের ‘একান্নবর্তী’ পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। আগে সহায়-সম্পত্তি, ঘর-জমি একটা পরিবারকে এক ছাদের নিচে ধরে রাখত। আজ চাকরি-চাকরি, পেশা, বৃত্তি ইত্যাদির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হওয়াতে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে পড়ছে। ছেলেমেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই এখনই দেখা যাচ্ছে বাপ-মায়ের খবর নিতে চায় না। ইতোমধ্যেই বেসরকারী পর্যায়ে দুই-চারটি ‘বৃদ্ধাশ্রম’ তৈরি হয়েছে। ঈদে-পার্বণে সেখানে আশ্রয় গ্রহণকারী বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যে চোখের জল ফেলেন তাতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। আগামী দিনে কিন্তু আয়ুষ্কাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ‘বৃদ্ধাশ্রমের’ প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। সরকার কী এসব ব্যাপারে কিছু ভাবছে? আমার জানা নেই। আয়ুষ্কাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা বাড়বে। তাদের চলাফেরার প্রশ্ন আছে। তাদের বিপুলাংশ লোক সীমিত আয়ের ওপর জীবনযাপন করে। তাদের সঞ্চয় দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু। তাদের সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ার কোন সুযোগ নেই। চাকরি থেকে প্রাপ্ত টাকা, সারা জীবনের সঞ্চয় এই তাদের ভরসা। এর ওপর থেকে প্রাপ্ত সুদের ওপরই তাদের জীবন। হয় ব্যাংকসুদ অথবা সঞ্চয়পত্রের লাভ বা সুদ। ব্যাংক আজকাল সুদ দেয় না বললেই চলে। সঞ্চয়পত্রের আকাল। এর ওপর সুদের হার কমানো হবে বলে সরকারী কর্মকর্তারা দুইদিন পরে পরে কাগজে ‘ভাষণ’ দেন। ফল অবসরপ্রাপ্তরা হতাশ। ব্যাংকে ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র কেনা-বেচা বন্ধ। সামনে জুন মাসে বছর শেষ হবে। এর মধ্যে চাকরিজীবী যারা দুদিন পরে অবসর নেবেন তাদের সঞ্চয়পত্র কিনতে হবে, নতুবা ট্যাক্স বেশি দিতে হবে। তারাও সঞ্চয়পত্র পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় প্রশ্ন, যারা সঞ্চয়ের ওপর বৃদ্ধাবস্থায় বাঁচতে চান তারা বাঁচবেন কী করে? আয়ুষ্কাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সব সমস্যাও আছে। লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×