ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পিকেএসএফের বকেয়া কর নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে এনবিআর

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২৩ এপ্রিল ২০১৫

পিকেএসএফের বকেয়া কর নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে এনবিআর

জসিম উদ্দিন ॥ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) কাছে আটক পাঁচ বছরের বকেয়া প্রায় আড়াই শ’ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে এনবিআর। এনবিআরের এক পক্ষ চায় বকেয়া রাজস্ব রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা হোক। অন্য পক্ষ চায় সংস্থাটিকে বকেয়া মওকুফ করতে। এদিকে বকেয়া কর মওকুফ পাওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন উভয় প্রতিষ্ঠানের একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তা। জানা যায়, পিকেএসএফের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২ মার্চ পিকেএসএফের সকল প্রকার আয়কে আয়কর দেয়া থেকে অব্যাহতি দিয়ে এসআরও (স্টেটিউটরি রেগুলেটরি অর্ডার) জারি করে এনবিআর। এই এসআরওর ভিত্তিতে বকেয়া মওকুফ করতে চান এক পক্ষ। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উর্ধতন কর্মকর্তারা বলছেন প্রচলিত আইন অনুযায়ী এই কর মওকুফের কোন সুযোগ নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তা এই অভিযোগ তুলেছে খোদ কর আপিলাত ট্রাইব্যুনালের এক সদস্যদের বিরুদ্ধে। যে ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চে বিষয়টি সুরাহা হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এর এক সদস্য হলেন আয়কর বিভাগের কমিশনার সৈয়দ মোঃ মাহবুবুর রহমান। অন্যজন এনবিআরের বাইরের। সৈয়দ মোঃ মাহবুবুর রহমানের অফিসে একাধিকবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি এবং গত কয়েকদিন ধরে তার সেলফোন নম্বরটিও বন্ধ রয়েছে। এ ব্যাপারে কর আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সভাপতি সিরাজুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, পিকেএসএফের বিষয়টি তিনি জানেন। তবে তা কেন আটকে আছে এবং অভিযোগটি খতিয়ে দেখবেন। উল্লেখ্য, গত মার্চ মাসের ১৯ তারিখ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া কথা ছিল ওই ট্রাইব্যুনালের। সূত্র জানায়, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইনের আওতায় ১৯৯০ সালের ২ মে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠান। তারা বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থাকে (এনজিও) তহবিল সরবরাহ করে থাকে। এর বিপরীতে এসব সংস্থা থেকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে আয় (অপারেটিং ইনকাম) করে থাকে। এই আয় ১৯৯৮ সালের ১৯ নবেম্বর এনবিআরের আপীল ও অব্যাহতি বিভাগ থেকে দেয়া এক চিঠির আলোকে কর মুক্ত ঘোষণা করা হয়। যাতে বলা হয়, জনকল্যাণমূলক কাজ ব্যতীত কোন ধরনের মুনাফা অর্জন বা মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করতে পারবে না। ১৯৯৮ সালের ওই চিঠির আলোকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক ব্যালেন্সের বিপরীতের লাভ, স্বল্পমেয়াদী ডিপোজিট ও অন্যান্য খাত থেকে আয় (নন অপারেটিং ইনকাম) কোনভাবেই আয়করমুক্ত হতে পারে না। তাই প্রতিষ্ঠানটির নন অপারেটিং ইনকামের ওপর এনবিআর কোম্পানি আইন অনুযায়ী ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর দাবি করে এনবিআর। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যাংক ব্যালেন্সের বিপরীতের লাভ, স্বল্পমেয়াদী ডিপোজিট ও অন্যান্য খাত থেকে আয় (নন অপারেটিং ইনকাম) করে ১৪১ কোটি ৩১ লাখ ১৪ হাজার ৬৯২ টাকা। যা আইন অনুযায়ী কর আদায়যোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত হয়। যার ওপর আয়কর হয় ৫৬ কোটি ৫২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৭৭ টাকা। এর সঙ্গে সরল সুদ যোগ হবে ৮ কোটি ৪৭ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮২ টাকা। সব মিলিয়ে ওই অর্থবছরে এনবিআরের পাওনা ৬৫ কোটি ৩২ হাজার ৭৫৯ টাকা। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে পিকেএসএফ নন অপারেটিং ইনকাম হয় ৯১ কোটি ৯৬ লাখ ৪৩ হাজার ১৭০ টাকা। যার ওপর আয়কর হয় ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৯ টাকা। এর সঙ্গে সরল সুদ যোগ হবে ৫ কোটি ১৭ লাখ ২৯ হাজার ৯২৮ টাকা। সব মিলিয়ে ওই অর্থবছরে এনবিআরের পাওনা ৩৯ কোটি ৬৫ লাখ ৯৬ হাজার ১১৭ টাকা। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে পিকেএসএফ নন অপারেটিং ইনকাম হয় ১০৮ কোটি ৮ হাজার ৯১২ টাকা। যার ওপর আয়কর হয় ৪০ কোটি ৫০ লাখ ৩ হাজার ৩৪২ টাকা। এর সঙ্গে সরল সুদ যোগ হবে ৬ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার ৫০১ টাকা। সব মিলিয়ে ওই অর্থবছরে এনবিআরের পাওনা ৪৬ কোটি ৫৭ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৩ টাকা। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে পিকেএসএফ নন অপারেটিং ইনকাম হয় ৯১ কোটি ৪৮ লাখ ২ হাজার ৩৫৯ টাকা। যার ওপর আয়কর হয় ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৮৮৫ টাকা। এর সঙ্গে সরল সুদ যোগ হবে ৫ কোটি ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৬৩৩ টাকা। সব মিলিয়ে ওই অর্থবছরে এনবিআরের পাওনা ৩৯ কোটি ৪৫ লাখ ৮ হাজার ৫১৮ টাকা। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে পিকেএসএফ নন অপারেটিং ইনকাম হয় ১২০ কোটি ৯৯ লাখ ৫৩ হাজার ৭২৫ টাকা। যার ওপর আয়কর হয় ৪৫ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ৬৪৭ টাকা। এর সঙ্গে সরল সুদ যোগ হবে ৬ কোটি ৮০ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৭ টাকা। সব মিলিয়ে ওই অর্থবছরে এনবিআরের পাওনা ৫২ কোটি ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৫৪৪ টাকা। এই পাঁচ অর্থবছরের মোট বকেয়া পাওনার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪২ কোটি ৮৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৮১ টাকা। কোম্পানি আইনের ৯৩ ধারা অনুযায়ী এই বকেয়া কর দাবি করে প্রতিষ্ঠানটিকে একাধিকবার নোটিস দেয় এনবিআর। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটি কোন জবাব না দিলেও পরে এনবিআরের শুনানিতে হাজির হন প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক শব্বীর আহ্মেদ। এর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করছে পিকেএসএফ। এরপর আপীল করলে তাও পিকেএসএর বিপক্ষে যায়। বাধ্য হয়ে বকেয়ার ১০ শতাংশ জমা দিয়ে ট্রাইব্যুনালে যায় প্রতিষ্ঠানটি। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ড. জসীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পিকেএসএফ একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। আমরা এই কর মওকুফ পাওয়ার চেষ্টা করছি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমরা যেহেতু মানুষের কল্যাণে কাজ করি তাই বকেয়া মওকুফ করার আবেদন জানিয়েছেন আমাদের আইনজীবীরা। আশা করছি সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে আসবে। আমরা ভাল ফল পাব।’ এদিকে গত ২ মার্চ পিকেএসএফের সকল প্রকার আয়কে আয়কর দেয়া থেকে অব্যাহতি দিয়ে এসআরও (স্টেটিউটরি রেগুলেটরি অর্ডার) জারি করে এনবিআর। তবে, ওই এসআরও জারির আগের পাওনার ওপর কোন প্রভাব থাকবে কি না জানতে চাইলে ড. জসীম উদ্দিন বলেন, এনবিআরের দাবি সাধারণত এসআরও জারির আগের পাওনায় এসআরও কোন প্রভাব ফেলবে না। আমাদের যুক্তি হলো- যদি এই প্রতিষ্ঠানের সব আয়কে আয়কর থেকে অব্যাহতি দেয়া যায়। তাহলে কেন বকেয়া মওকুফ করা যাবে না। এছাড়া পিকেএসএফ বর্তমানে তহবিল সঙ্কটে রয়েছে বলে উল্লেখ করে সংস্থাটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, চলতি অর্থবছরে তহবিল হিসেবে পেয়েছেন প্রায় ২০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ঋণ ব্যতীত শুধু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ করেছেন ৬০ কোটি টাকা। এরপরও ট্রাইব্যুনাল থেকে কোন রায় যদি পিকেএসএফের বিপক্ষে যায় তাও প্রতিষ্ঠানটির বোর্ডকে অবহিত করা হবে। বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নেবে সেভাবে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজন হলে প্রতিষ্ঠানটি সুপ্রীমকোর্টে আপীল করবে বলেও জানান পিকেএসএফের ডিএমডি ড. জসীম উদ্দিন।
×