ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্মমতার আলোকে প্রকৃতি ও মানুষ

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২৩ এপ্রিল ২০১৫

নির্মমতার আলোকে প্রকৃতি ও মানুষ

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এখন স্প্রিং অর্থাৎ বসন্তকাল। মিসিসিপিতে এখন প্রায়শ রিমঝিম বৃষ্টি হচ্ছে। এতদিনকার পত্রহীন ন্যাংটো গাছগুলোতে হঠাৎ করেই দেখি কচি পাতার সমারোহ এবং দু’একদিনের মধ্যেই দেখা যাবে সবুজাভের কোমলতায় ভরপুর চারদিক। এযেন প্রাণের উল্লাস। কিন্তু প্রকৃতির এই কোমলতায় হঠাৎ শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, টর্নেডো, তাৎক্ষণিক ধুমবৃষ্টিতে বন্যা- এসবই যুক্তরাষ্ট্রে আছে। শুধু তাই নয়, সবকিছুরই রূপ অত্যন্ত অস্বাভাবিক। বজ্রপাতের আওয়াজে মনে হয় এটমবোমা ফাটলো বুঝি। শিলাবৃষ্টিতে বাইরে পার্ক করা গাড়ি সহসাই মসৃণতা হারিয়ে ফেলে ফুটো হওয়ার উপক্রম। টর্নেডোর পাল্লায় পড়লে তো ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন। আর ঘণ্টাখানেকের বন্যায় ঘর দুয়ার জলে ভাসান একটা সাধারণ ব্যাপার। তারপর আছে বুশ ফায়ার অর্থাৎ বনে আগুন। অনেক সময় তা চলতে থাকে সপ্তাহ ধরে। জঙ্গলের কাছাকাছি বাড়িঘরও ভস্মীভূত হয়। তাছাড়া খরাও আছে। জলও রেশানিং হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যু তুলনামূলক অস্বাভাবিকভাবে কম। বাংলাদেশও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ এবং নির্মম হলেও সত্যি, মৃত্যু সংখ্যা অনেক বেশি। এই তো কালবৈশাখীতে কয়েক ডজন মানুষ মারা গেল। বাংলাদেশে তো আর টেলিফোনে ৯১১ কল করার ব্যবস্থা নেই। যাহোক আমার বক্তব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে নয়। আমার বসন্তকালীন চারদিনের ছুটি চলছে। সুতরাং নেটফ্লিক্সে ‘হিটলার এবং নাজিস’ নামের একটা ডকুমেন্টারি দেখছিলাম। পাঁচ পর্বের সিরিজে একটা কোটেশন আমাকে সচকিত করল। হিটলার বলেছে, ‘ও ফড় হড়ঃ ংবব যিু সধহ ংযড়ঁষফ হড়ঃ নব ধং পৎঁবষ ধং হধঃঁৎব’ এখন হিটলারকে আপনি কি বলবেন? জিনিয়াস? পাগল? নাকি হিটলারের নির্মমতাকে আপনি সাপোর্ট করবেন? হিটলার জিনিয়াস তো বটেই। হিটলার তো একদিনে তৈরি হয়ে যায়নি। সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলার খবর সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত ছিল। তখন সে আহতও হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ছিল পরাজিত শক্তি। হিটলারের মনে এটা একটা বড় ধাক্কা। সেই থেকে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখত। বক্তৃতায় দারুণ পটু ছিল। ১৯১৯-এর পর থেকেই হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় আসার ব্রত গ্রহণ করে। গড়ে তোলে নাজি পার্টিকে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৩৫ সালের দিকে ক্রমান্বয়ে জার্মানির সর্বেসর্বা হয়ে বসে এবং একের পর এক পুরো ইউরোপই কব্জা করতে নেমে পড়ে। একই সঙ্গে প্রতিশোধ চরিতার্থ করতেও লেগে পড়ে। ইহুদী মাত্রই- শিশু, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধÑ কেউই বাদ যায়নি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মৃত্যুর থাবা থেকে। যুদ্ধক্ষেত্রেও বন্দী সৈন্যদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। ইউরোপের ছোট-বড় প্রতিটি দেশই দখল করার নেশায় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। হিটলার প্রকৃতির মতোই নির্মম হতে চেয়েছিল এবং হয়েছেও। কিন্তু পরিণতি কি হলো? আত্মহত্যা। আমরা কি ইতিহাস থেকে শিখব না? প্রকৃতির মতো মানুষকেও নির্মম হতে হবে? একজন বন্দীকে আমরা খাঁচায় ভরে আগুনে পুড়িয়ে মারব? একজন নিরীহ মানুষকে অপরাধী না হওয়া সত্ত্বে¡ও গলা কেটে মারব? একজন আধুনিক টেকনোলজি, ইন্টারনেট ব্লগে ভিন্নমতের লেখা লিখলেই আমরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করব? শুধু তাই নয়, অনেককেই আমরা জন্মভূমি ছাড়া করতেও বাধ্য করি। তারপর সুযোগ এলেই আমরা মানুষের মৃত্যু নিয়ে সেলিব্রেট করব? হাজার বছরের নিদর্শন আমরা ধ্বংস করে ফেলব? আচ্ছা মানলাম, হরতাল অবরোধে বাস চলছে। সুতরাং বাসটা ধ্বংস করবেন। তাহলে যাত্রীদের বাস থেকে নেমে যেতে দিয়ে তারপর বাসে পেট্রোলবোমা মারেন। ফাঁকা জায়গায় ককটেল ফুটান, জনগণ ভয় পাবে। কিন্তু আপনাদের লাশ ফেলতেই হবে? এমনও তো হতে পারে, যে বাসে পেট্রোলবোমা মারলেন, তাতে আপনারই আত্মীয় আছে। এক এক করে বাংলাদেশে এক শ’ আটত্রিশজন আমারই মতো নিরীহ মানুষ পেট্রোলবোমায় মারা গেছে গত তিন মাসে। সংখ্যাটা কিন্তু বড় কম নয়। পাকিস্তানে স্কুলের মৃত্যু সংখ্যা কিম্বা কেনিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্রীস্টান ছাত্রছাত্রীদের মৃত্যু সংখ্যার কাছাকাছি। কত সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে, তার কথা নাই বললাম। শুধু কি তাই? দেশটাকে কতটা বছর পিছিয়ে দিয়েছে? শিক্ষার কথাটাও ধর্তব্যে আসেনি। এর একটা হিসাব-নিকাশ হওয়া প্রয়োজন নয়কি? সরকার আসবে আবার চলেও যাবে। কিন্তু আমার অধিকার আর মোটামুটি জনগণের কিছুটা সাপোর্ট আছে বলেই আমি মানুষ মারা উৎসবে মেতে উঠব? এটা তো আর ১৯৪০ দশকের হিটলারে সময়কাল নয়। সুতরাং নিরীহ মানুষ মারার বিচার অবশ্যই হতে হবে। তা যে পক্ষই করুক না কেন? আজকের দিনে দেখুন কেমন সুন্দরভাবে ধরা পরে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কীর্তিকলাপ? প্রথমদিকে এক বিরুদ্ধবাদী নেতা নির্দেশ দিচ্ছে, রাস্তায় তারকাঁটা ছড়িয়ে দাও, গাড়ির চাকা ফুটো হয়ে যাবে। সুতরাং গাড়ি আর চলবে না। কেমন হীনম্মন্য মানসিকতা? এরমাঝে যে নিরীহ মানুষ মারারও ইঙ্গিত রয়েছে। চাকা বার্স্ট করে গাড়ির একসিডেন্টে মানুষ মারাও যেতে পারে। তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। আর একজন তো লাশ ফেলার কথাই বলে ফেলেছেন। পেট্রোলবোমায় নিরীহ মানুষদের মারতে বলেনি তাই বা বিশ্বাস করি কি করে? নিশ্চয় কেউ না কেউ নির্দেশ দিয়েছেন। যারা ঢিল ছুড়েছে তারা তো আজ্ঞাবহ কর্মী। কিছু পয়সার বিনিময়ে কাজ করেছে। পরিকল্পনাকারী বা নির্দেশদাতাদের খুঁজে বের করতেই হবে। বাংলাদেশের জনগণ অন্ততপক্ষে কিছু ঘটনার প্রমাণসাপেক্ষে দ্রুত বিচার দেখতে চায়। এ ব্যাপারে কোনরূপ ছাড় দেয়া উচিত নয়। তবে অবশ্যই বিচার করতে গিয়ে জজ মিয়া নাটক যেন মঞ্চস্থ না হয়। প্রতিবেশী দেশ, ভারতে কতটা বছর কংগ্রেস শাসন করেছে কিন্তু এখন তার পাত্তাই নেই। পশ্চিমবঙ্গেও কতটা বছর বামফ্রন্ট শাসন করেছে, এখন তাদেরও পাত্তাই নেই। পরিবর্তন হয়। কিন্তু ওখানে তো ক্ষমতা যাওয়ার জন্য এমন মারামারি, হানাহানি হয়নি। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সবকিছু হয়েছে। ধৈর্য ধরতে ধরতে বিজেপি ভারতে ক্ষমতায় এসেছে। ধৈর্য ধরতে ধরতে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশে যে দুটো পার্টি প্রতিনিয়ত মারামারি করছে, তারা অতীতে ভাগাভাগি করে ক্ষমতায় ছিল এবং জনগণ তার স্বাদ ভালভাবে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এখনকি সেই একই পার্টি হুজুরের পানিপড়া দিয়ে শুদ্ধ হয়েছে যে বাংলাদেশকে সুইজারল্যান্ড বানিয়ে ফেলবে? দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের, একটা নতুন করে থার্ড পার্টি গড়ে উঠতে পারেনি। তাহলে তাদেরই ক্ষমতায় আসার সুযোগ ছিল। যেমনটি দিল্লীর সরকারে কেজরিওয়াল এসেছে। জনগণ নতুনত্ব চায়। কিন্তু সেই নতুন পার্টি অঙ্কুরেই মরে যায়। ফল আর আসে না। যুক্তরাষ্ট্রেও একই কথা। হয় ডেমোক্র্যাট, নয় রিপাবলিকান। তৃতীয় দল কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। চেষ্টা এখানেও হয়েছে। আর যাই হোক, এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ মেরে পার পাওয়া যায় না। এখানে পয়সা মেরেও পার পাওয়া যায় না, তা সে যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন? বিচার তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় চলবে। প্রেসিডেন্টেরও সাধ্য নেই কোনরূপ প্রভাব ফেলতে। যুক্তরাষ্ট্রে ভাল আছে, আবার খারাপ যে নেই তেমন নয়। তবু এতটা বছর থাকতে থাকতে আমার বলতে ইচ্ছে করে, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি কিন্তু বাংলার রাজনীতি আমি দেখতে চাই না। লেখক : অধ্যাপক, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান মিসিসিপি, যুক্তরাষ্ট্র
×