ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন;###;মুনতাসীর মামুন

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ২১ এপ্রিল ২০১৫

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

(২০ এপ্রিলের পর) সামরিক শাসকরা এ দেশে এসে প্রথমেই বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ করে নিজেদের জন্য। সংসদীয় গণতন্ত্রে বাজেটে, বরাদ্দ দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অধিকার করলেও কার্যত সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেখা যায় সে খাতে বরাদ্দ বেশি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ বিভক্ত হয়ে যায়। সচিব শুধু দেখাশোনা করেন বেসামরিক প্রশাসন। অভ্যন্তরীণ বাজেট, ক্রয় প্রভৃতি ওপর থেকে বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। সামরিক বাজেট সংসদে আলোচিত হয় না। পাকিস্তানে এ অবস্থা চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকরা পরাজিত ঔপনিবেশিক প্রভুর ধারা আনন্দের সঙ্গে অনুসরণ করছে। সামরিক শাসন কিছুদিন বহাল থাকার পর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে এবং বিশ্বজনমতের চাপে এক ধরনের বেসামরিক শাসন, প্রয়োজনে সংসদ গঠন করে। আইয়ুব খান তা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ও হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ তা অনুসরণ করেছিলেন। আইয়ুব খান রেনিগেন্ড রাজনীতিবিদদের দিয়ে ‘দল’ সৃষ্টি করেছিলেন। জিয়া ও এরশাদ জাগদল, জাতীয়তাবাদী দল, জাতীয় পার্টি গঠন করেছিলেন এবং ‘গঠিত সংসদে’ তাদের যাবতীয় কুকর্ম বৈধ করেছিলেন। যেমন, ইনডেমনিটি বিল, যে বিলের বলে বঙ্গবন্ধু হত্যা বৈধ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার আমলে ‘ক্লিন হার্ট অপারেশনে’ নিহত প্রায় ৫২ জনের বিচার যাতে না হয় সে কারণেও সংসদে ইনডেমনিটি বিল পাস করা হয়েছে, যার কথা সবাই ভুলে গেছে। এমনকি বর্তমান আমলেও তা বাতিল করা হয়নি। যেমন জিয়া বা এরশাদসৃষ্ট সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলোচনা হয়নি। শুধু তাই নয়, সামরিক শাসকদের প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় প্রশাসন বা রাজনৈতিক দলও নয়। বরং গোয়েন্দা সংস্থা। বাংলাদেশে বেসামরিক আমলে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান হতেন পুলিশ বাহিনী থেকে। এরশাদ আমল থেকে এর প্রধান নিযুক্ত হতে থাকেন সামরিক বাহিনী থেকে। এখনও সেই ধারা বর্তমান। সামরিক শাসন বা শাসকরা চলে গেলে বা হটে গেলেও তাদের উপস্থিতি কীভাবে থেকে যায় বা থাকছে তার উজ্জ্বল উদাহরণ পাকিস্তানক। বাংলাদেশ এর থেকে মুক্ত নয়। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে যেমন, বেসামরিক কর্তৃত্ব বহালের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় দেশজুড়ে হঠাৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ১৯৭৪-৭৫, ১৯৮০-৮১, এমনকি এরশাদের উৎখাতের পরের সময়টুকু এর উদাহরণ। ১৯৯১ সালে পার্লামেন্ট স্থায়ী হতে-না-হতে বাংলাদেশের সত্তরটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সশস্ত্র হাঙ্গামার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বৃদ্ধি পেয়েছিল ডাকাতি, হত্যা, ছিনতাই। এসবের প্ররোচনা দেয়া হয় বাংলাদেশের শিক্ষিতদের মতে (অনেকে বক্তৃতায়ও তা বলেছেন) বিশেষ তথ্যানুসন্ধানী সংস্থা থেকে, যদিও কাগজপত্রে তা প্রমাণ করা যাবে না। এ সংস্থাগুলো বেসামরিক প্রশাসনের সমান্তরাল হয়ে যায়। বেসামরিক কর্তৃপক্ষ দৃঢ় হওয়ার আগে, বেসামরিক কর্তৃপক্ষও সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতে ইতস্তত করে এবং সময়ের এই সুযোগটুকু পুরো গ্রহণ করে তারা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তাদের সৃষ্ট রাজনৈতিক দল বা দ্বিতীয় ফ্রন্ট। যেমন ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রায় প্রধান দলগুলো সামরিক শাসনের বিপক্ষে কথা বলেছিল। একমাত্র বিএনপিই বলেছিল তারা শক্তিশালী সেনাবাহিনী চায়। তবে, এখানে বলে রাখা ভালো যে, বিএনপির সবাই বিশেষ করে তরুণরা যে এমন বিশ্বাস করে তা নয়। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন বিএনপির মূল চালিকাশক্তি জিয়াউর রহমানের আমলের অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসাররা এবং দল তারাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। একইভাবে পরবর্তীকালে জেনারেল মঈন, ফেরদৌস কোরেশী, জেনারেল ইব্রাহীমকে বাজারে নামিয়ে দেন। তারা সামরিক বাহিনীর হয়ে দু’টি ‘পার্টি’ গঠন করেন। আরো অনেকেই সে চেষ্টা গ্রহণ করেন। এরা পরিচিত হয়ে ওঠে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে। জেনারেল মঈন বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো এই পার্টি দু’টির ভিত্তি সুদৃঢ় করার সুযোগ পাননি। এদের মধ্যে জেনারেল ইব্রাহীমের ‘কল্যাণ’ এর সাইনবোর্ড এখনও আছে। এবং সেই সাইনবোর্ড নিয়ে তিনি বেগম জিয়ার ১৮ দলীয় জোটে যোগ দিয়েছেন। কারণ, সেনাসৃষ্ট পার্টি সেনাসৃষ্ট বড় পার্টিরই অনুসরণ করবে এবং সেটিই স্বাভাবিক। ॥ ৩ ॥ পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাজার অর্থনীতির প্রসঙ্গ আলোচনা করছিলাম। সামরিক আমলে যাঁরা অর্থশালী হয়েছিলেন, সামরিক শাসক উৎখাত হওয়ার পরও তাঁরা ক্ষমতাশীল থাকেন এবং বেসামরিক কর্তৃত্ব তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। তারা বাজারে এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যে, মানুষ তখন বর্তমান সময়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। এই বীতশ্রদ্ধ হওয়াটা পুরনো আমলকে যৌক্তিকতা প্রদান করে। শুধু তাই নয়, বাজেটে সিংহভাগ বরাদ্দ থাকে সামরিক বাহিনীর জন্য এবং সে-বাজেট সংসদে আলোচনা করা যায় না। ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের পর বিপুল উদ্দীপনায় সৃষ্ট বাংলাদেশের পার্লামেন্টের ১৯৯১ সালের বাজেটে সিংহভাগ বরাদ্দ করা হয়েছে সামরিক বাহিনীর জন্য এবং সংসদে তা আলোচিত হয়নি। শুধু তাই নয়, ব্যাংক-পর্ষদে ফিরে এসেছিলেন তখন সামরিক কর্মকর্তারা। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থার নিয়ন্ত্রণভার থেকে গেছে তাদের ওপর। (চলবে)
×