ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জটিলতা কমলে বিনিয়োগ আরও বাড়বে

৪৪ বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে ৮শ’ গুণ

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২১ এপ্রিল ২০১৫

৪৪ বছরে বিনিয়োগ  বেড়েছে ৮শ’ গুণ

রহিম শেখ ॥ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিনিয়োগ বাড়ছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৮শ’ গুণ। ১৯৭২ সালে মাত্র ৫৭৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ বেড়ে এখন সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সময়ে-অসময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার ছোবলে অনেক বিদেশী বিনিয়োগ সীমানা পেরিয়ে চলে গেছে ভিন্ন দেশে। তারপরও পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখন দঃ এশিয়ায় দ্বিতীয়। বিদেশী বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের জন্য সম্ভাবনাময় দেশের তালিকায় ১৫তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসার গতি কমে গেছে। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাব, অবকাঠামো সমস্যা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেশীয় বিনিয়োগ কিছুটা কমছে। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান করা গেলে বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। মূলত আশির দশকে রফতানিযোগ্য তৈরি পোশাক শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে শিল্পায়নের নবযাত্রা শুরু হয়। ওই সময়ে দেশের চাহিদা, মানবসম্পদ, কাঁচামালের পর্যাপ্ততা, প্রযুক্তিগত দক্ষতার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় শিল্প-কারখানা বাড়তে থাকে। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন উদ্যোক্তা। কর্মসংস্থানও বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশের মোট বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৫৭৭ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা প্রায় ৮শ’ গুণ বেড়ে ৫ লাখ ১৩ হাজার ৬৩৯ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ২০০৮-২০১২ এই সময়ে সামগ্রিক বিনিয়োগ বিশেষ করে শিল্প খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির চিত্র ছিল লক্ষণীয়। ব্যবসায়িক ব্যয় কম থাকার কারণেই মূলত এই সময়ে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করার ব্যয় অনেক কম। তাই শ্রমের মজুরি ছাড়াও গ্যাস ও বিদ্যুতের সেবামূল্যও তুলনামূলক কম। কিন্তু নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় গ্যাস-বিদ্যুত সংযোগ সহজলভ্য নয়; বরং নতুন সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের তালিকায় শেষের দিকে রয়েছে বাংলাদেশ। তাই ব্যবসা করার ব্যয় কম হলেও সুযোগ কাজে লাগছে না। এতে আশানুরূপ হারে বাড়ছে না প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই)। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত কয়েক বছর ধরে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে কিছুটা মন্দাভাব বা স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জানা গেছে, দেশে বিনিয়োগ মন্দার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, অবকাঠামোর অভাব, বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থার সঙ্কট, বাণিজ্য খাতে সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, অনিয়ম, শিল্প, কল-কারখানায় অস্থিরতা, বিদেশী ক্রেতাদের আইনগত পরিপালনগত চাপ ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেকেই বরাদ্দপ্রাপ্ত শিল্পপ্লট ভিন্ন কাজে ব্যবহার করছেন। প্লান্ট ও মেশিনারিজ স্থাপনের পরেও অনেকেই প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে উৎপাদন শুরু করতে পারেননি। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগই শুধু কমেনি, বরং খেলাপী হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা বিনিয়োগ বাড়াতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার যে অপরিহার্য শব্দ ব্যবহার করা হয় তাও সমীচীন ছিল না। গত কয়েকবছর বিনিয়োগ স্থবিরতার পেছনে আর্থ-সামাজিক অস্থিতিশীলতাকে প্রধানত দায়ী মনে করেছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেশে প্রত্যাশিত হারে বিনিয়োগ না বাড়ার জন্য কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করেন। এগুলো হলো গ্যাস, বিদ্যুত, জমি ও অবকাঠামোর অভাব এবং দুর্নীতির সমস্যা। তার মতে, একদিকে দেশে বিনিয়োগ নেই, অন্যদিকে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। সে অর্থই আবার বিদেশী বিনিয়োগ বলে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ কম আসার পেছনে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সামনের দিনগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগ আরও কমে যেতে পারেÑ যদি না চলমান পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান না হয়। একই মত পোষণ করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আব্দুস সবুর খান। তিনি জনকণ্ঠকে বলে, বিনিয়োগের জন্য সর্বপ্রথম দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। গত বছর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিনিয়োগ কমেছে। তাই টেকসই জিডিপির জন্য সিঙ্গেল ডিজিটে সুদের হার নির্ধারণ, জমি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রোকেয়া আফজাল রহমান বলেন, গ্যাস, বিদ্যুত ও অবকাঠামো এই তিনটি সুবিধা নিশ্চিত করা হলে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বিনিয়োগকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ব্যবসায়ীদের রয়েছে। জানা গেছে, বিনিয়োগ বাড়াতে বিদেশীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বর্তমানে অন্তত ১৭টি খাতে কর অবকাশ-সুবিধা পাচ্ছেন বিদেশীরা। বিদেশীদের মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও বিধিবিধান শিথিল করা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে বিশ্বের ৬৬টিরও বেশি দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টির মতো দেশ রয়েছে যাদের বিনিয়োগ আরও বাড়াতে চায় দেশগুলো। গার্মেন্টস খাতে বিনিয়োগ করতে বিদেশী উদ্যোক্তারা এখন বাংলাদেশমুখী। চীন, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, জার্মানি, ডেনমার্ক এবং কানাডার উদ্যোক্তারা এখন ছুটে আসছেন বাংলাদেশে। বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে ‘গ্রিন গার্মেন্টস’ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন বিদেশী উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং, টেক্সটাইল, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও অবকাঠামো, ব্যাংকিং, টেলিকমিউনিকেশনসহ অনেক খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আসছে। তবে ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশি ৭২ কোটি ২৮ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছে ম্যানুফ্যাকচারিং বা শিল্প খাতে। ৩৯ কোটি ডলার এসেছে টেক্সটাইল খাতে; ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে এসেছে ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলার; ব্যাংকিং খাতে এসেছে ৩১ কোটি ১৮ লাখ ডলার; যোগাযোগ ও অবকাঠামোতে ২৩ কোটি ৫৫ লাখ ডলার; টেলিকমিউনিকেশনে ২২ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে; সেবা খাতে এসেছে সাড়ে ৬ কোটি ডলার; বিদ্যুত, গ্যাস ও জ্বালানি তেল খাতে এসেছে ৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। সূত্রমতে, সারা বিশ্বে এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ছয় ধাপ এগিয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখন দঃ এশিয়ায় দ্বিতীয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানদ-ে বিদেশী বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের জন্য সম্ভাবনাময় দেশের তালিকায় ১৫তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ছিল এই তালিকার ২৮তম স্থানে। জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) আন্তর্জাতিক গবেষণা অফিস পরিচালিত জাপানী সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের দৃষ্টিভঙ্গি শীর্ষক ২২তম বার্ষিক জরিপে প্রাপ্ত ফল থেকে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনদিক থেকেই পিছিয়ে নেই বলে মনে করে জাপানী তরুণ উদ্যোক্তা মামি ইদুয়ি, কেনেচি ইয়ানাদা, মাসামি শিদা, শিনোসুকে সাওয়ামুরা। তবে আমাদের পর্যবেক্ষণ, এখানে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। তাছাড়া বাংলাদেশের দুর্বল অবকাঠামো, অদক্ষ শ্রমিক, জ্বালানি স্বল্পতা রয়েছে। জাপান সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ‘গ্লোবাল ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম’ এর আওতায় মোট ২২ তরুণ উদ্যোক্তা গত ৬ মাস ধরে বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪ সালে দেশে এফডিআই এসেছে ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ডলারÑ যা ২০১৩ সালের একই সময়ের চেয়ে ৭ কোটি ২৫ লাখ ডলার বা ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। ২০১৩ সালের পুরো সময় দেশে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছিল ১৫৯ কোটি ৯১ লাখ ডলার। গেল বছরও বিদেশী বিনিয়োগের সিংহভাগই এসেছে রিইনভেস্টেড আর্নিংসের মাধ্যমে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪ সালে নতুন বিনিয়োগ বা ইক্যুইটির পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮ কোটি ডলার। রিইনভেস্টেড আর্নিংসের পরিমাণ ছিল ৯৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। ইন্ট্রা-কোম্পানি লোনের পরিমাণ ছিল ২৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।
×