ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ জীবন ও লোকজ সংস্কৃতির নানা উপাদান মুগ্ধ করছে শহুরেদের

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৯ এপ্রিল ২০১৫

গ্রামীণ জীবন ও লোকজ সংস্কৃতির নানা উপাদান মুগ্ধ করছে শহুরেদের

মোরসালিন মিজান বৈশাখের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। এক সময় বাংলার প্রায় প্রতি গ্রামে ছোট কিংবা বড় পরিসরে এই মেলার আয়োজন করা হতো। এখন অত নেই। মেলার চরিত্রও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিসিক ও বাংলা একাডেমির আয়োজনকে চমৎকার বলতেই হয়। সরকারী দুই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে একাডেমি চত্বরে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ‘বৈশাখীমেলা’র আয়োজন করা হয়। যথাসময়ে শুরু হয়েছে এবারের মেলা। প্রতিটি স্টলে গ্রামীণ পণ্য। লোকজ সংস্কৃতির নানা উপাদান সুন্দর করে সাজানো। শুধু তাই নয়, স্টলে বসেই কাজ করছেন অনেক শিল্পী ও কারিগর। শহুরে মানুষ বিপুল আগ্রহ নিয়ে তাদের কাজ দেখছেন। চলছে কেনাকাটা। শনিবার একাডেমি চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য বছরের মতোই সাজানো হয়েছে স্টল। শতাধিক স্টলে পসরা সাজিয়ে বসেছেন দেশের প্রসিদ্ধ হস্ত ও কারুশিল্পীরা। মৃৎশিল্প, বাঁশ ও বেতশিল্প, নকশিকাঁথা, শতরঞ্জি, কাঠজাতপণ্য, ঐতিহ্যবাহী জামদানি, তাঁতের শাড়ি, গহনা, ঝিনুকপণ্য থেকে পঁতিরমালা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। মেলায় মৃৎশিল্পের একাধিক স্টল। ‘পোড়া মাটির নকশা ঘর’ নামে নেয়া স্টলটির সামনে ভিড় একটু বেশি মনে হলো। এখানে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির পটারি, ফ্লাওয়ারভাস। আছে ঘর সাজানোর বাহারি পণ্য। কোনটিই নতুন নয়। তবে প্রতিটি কাজ এত সুন্দর আর নিখুঁত যে, দেখে নতুনের মতো মনে হয়। হাতে নিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। কারণ প্রতিটি মোটিফের গায়ে নিজের দক্ষতা ও যতেœর ছাপ স্পষ্ট করেছেন শিল্পী আবুল কালাম মিয়া। মাটির স্বভাব বোঝেন। তাই হয়ত যেমনটি চাই, গড়ে নিয়েছেন। গড়ে নিতে পেরেছেন। কাজে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সুন্দর সমন্বয় ঘটিয়েছেন তিনি। শিল্পীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা গেলো তিনি ঢাকার রায়েরবাজারে থাকেন। ওখানেই কাজ করেন। সেই ১৯৭৫ সাল থেকে। রায়েরবাজারের সাড়ে ৭ হিন্দু পরিবার এই কাজ করত জানিয়ে তিনি বলেন, আমি একা ছিলাম মুসলিম। বাপ-দাদার পেশা অনেকেই ছেড়ে দিলেও ভালবাসার কারণে কাজটি ছাড়তে পারেননি বলে জানান তিনি। মেলার পৃথক স্টলে পাওয়া যাচ্ছে শখের হাঁড়ি। শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। গায়ে কাঁচা হলুদ রং। তার ওপর লাল ও সবুজ রঙে ফুল-লতা-পাতার নকশা আঁকা। দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। শখের হাঁড়ি এখন মূলত গৃহসজ্জার কাজে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন আকারের ৪টি হাঁড়ি দিয়ে তৈরি এক সেটের দাম ১০০ টাকা। ৫ হাঁড়ির সেটের দাম ২০০। নিজের স্টলের সামনে ফাঁকা জায়গায় বসে শখের হাঁড়ি রং করছিলেন রাজশাহীর সঞ্জয় কুমার। বয়সে তরুণ শিল্পীর কণ্ঠে অপ্রাপ্তি হতাশা। বললেন, সারা বছর কাজ করি। যেখানে মেলা হয় ছুটে যাই। কিন্তু বিক্রি কম। এটি বাপ-দাদার পেশা। আর কোন কাজ শিখিনি। তাই ছাড়তেও পারছি না। ঐতিহ্য বাঁচাতে সরকারকে বিশেষভাবে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। পাশের খোলা জায়গায় বসেছিলেন শোলাশিল্পী। তাঁর স্টলে শোলায় তৈরি গোলাপ-বেলি-শাপলা ফুল। কয়েক প্রকার পাখি। হাতপাখা। বানর, কুমিরও আছে। আছে গরুরগাড়ি। হিন্দু বিয়েতে বর যে টোপর পরেন, সেটিও দেখা গেল স্টলে। শখের হাঁড়ির পাশে বসেই কাজ করছিলেন শোলাশিল্পী শঙ্কর মালাকার। জানালেন, কয়েক পুরুষ ধরে এই কাজ করছেন। জন্মের পর থেকে একটিই কাজ তার। ছেলে রামপ্রসাদও শিখেছেন বাবার কাছে। তিনিও কাজ করছিলেন পাশে বসে। বললেন, বাপ-দাদার পেশা। না করলে চলে না। একটিমাত্র স্টলে কাঁসা ও পিতলের সামগ্রী। পুরনো ঢাকার বেচারাম দেওড়ির এক কারিগর সাজিয়েছের স্টলটি। তার স্টলে দেখা গেল বিখ্যাত সিন্ধী কলসি। একসময় গ্রামের গৃহস্থরা ঘি-দুধ-মাখন ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে কারুকার্য খচিত এই কলসি ব্যবহার করত। এখানে আরও আছে পিতলের ঘোড়া, ফ্লাওয়ারভাস, হুঁকোসহ নানা ধরনের পণ্য। কারিগরের নাম মুক্তি। জানালেন, বংশপরম্পরায় তারা এই কাজ করে আসছেন। তবে এখন সময় মন্দ। বললেন, আগের সেই রমরমা অবস্থা আমাদের নেই। এক সময় কত কাজ করতাম! এখন টিকে থাকতে মূলত শোপিস তৈরির কাজ করি। প্রচুর সময় দিতে হয়। কিন্তু লোকে দাম দিতে চান না। মেলার বড় অংশজুড়ে আছে তাঁতের শাড়ি ও জামদানি। নারায়ণগঞ্জের এক কারিগর জানালেন, একটি শাড়ি তৈরিতে এক মাসও লেগে যায়। কিন্তু সে অনুযায়ী মূল্য পাওয়া যায় না। মেলার একাধিক স্টলে আছে লোকজ বাদ্যযন্ত্র। একটি স্টলে শুধু বাঁশি। বাঁশের বাঁশি। তবে নানান জাত। আকারে ছোট-বড়-মাঝারি। মুখ বাঁশি আছে। আছে আঁড় বাঁশি। এলিফ্যান্ট রোডের লাল মিয়া এই বাঁশি তৈরি করেন। নিজেও বেশ বাজান। কথা বলতে বলতেই বড় বাঁশি হাতে নিয়ে সুর তুললেন। কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। বললেন, প্রেম লাগবে। বাঁশি প্রেম ছাড়া বাজে না। তিনি জানান, বিশেষ একসেট বাঁশি তিনি গত চার বছরে গড়েছেন। ৩৭ সেটের বাঁশির দাম ৬৫ হাজার টাকা। এখানেই শেষ নয়। আছে মিষ্টি, মুড়ি-মুড়কিও। সোনারগাঁওয়ের লাঙ্গলবন্দের কারিগররা বড় দুটি স্টল সাজিয়ে বসেছেন। এখানে কদমা, বাতাসা, মোড়ালি, আঙ্গুরী, আমিরতি, উখড়া, নিমকি, নকুল দানা, লাড্ডু; কত কী! মেলায় দেখা যাবে পুতুলনাচ। নাগরদোলায়ও চড়া যাবে। সব মিলিয়ে নগরজীবনে গ্রামীণ অনুভূতি। মেলা চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
×