ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চরকুকরি-মুকরি

সবুজ দ্বীপ, অপরূপ সৌন্দর্য-পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৮ এপ্রিল ২০১৫

সবুজ দ্বীপ, অপরূপ সৌন্দর্য-পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে

এআরএম মামুন ॥ চর কুকরি-মুকরি। প্রাকৃতিক বিস্ময়, ভূস্বর্গ ভোলার চরফ্যাশনের দক্ষিণ আইচা থানার মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ। নয়নাভিরাম এ দ্বীপের একপাশে বঙ্গোপসাগর, অন্যপাশে বনভূমি। এক পাশের উত্তাল ঢেউ, বৈরী বাতাস আর জলোচ্ছ্বাসের গর্জন কর্ণকুহর হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে উদ্বেল করে ভাবনার জগতকে। আর অন্যপাশের সবুজ দ্বীপ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি দেয় ভাললাগার এক চিরসবুজ প্রশান্তি। নেই শহরের মতো কোলাহল, যানবাহনের বিকট শব্দ। শুধু আছে মানুষের ভালবাসা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণী আর সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে সৌন্দর্যের এক বর্ণিল উপস্থিতি, যা প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। নয়নাভিরাম এ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘিরে গড়ে উঠতে যাচ্ছে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে সরকার ইতোমধ্যে ৫০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, চর কচ্ছপিয়া ও চর কুকরি-মুকরির মধ্যবর্তী মোহনার ওপর কেবল কার তৈরি, গার্ডক্যাম্প, সড়ক, পর্যটকদের জন্যে একাধিক টাওয়ার ও রেস্ট হাউস তৈরি। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে কুকরী-মুকরি হবে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনোমুগ্ধকর স্থান। এখানে রয়েছে কক্সবাজার, কুয়াকাটার মতো দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ও গভীর অরণ্য, যা পর্যটক আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভোলা জেলা সদর থেকে ১৫০ কিলোমিটার (কিমি) আর উপজেলা সদর থেকে ৮০ কিমি দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনা নদীর মোহনায় কুকরী-মুকরির অবস্থান। চারদিকে জলরাশিবেষ্টিত, প্রমত্তা মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে পলি জমে জমে প্রায় আট শ’ বছর আগে দ্বীপটির জন্ম। দ্বীপটির নামকরণের ইতিহাস বেশ অদ্ভুত। দ্বীপ সৃষ্টির প্রথমদিকে ইঁদুর আর কুকুরের রাজত্ব ছিল। সে সময়ের জার্মানির যুবরাজ প্রিন্স ব্রাউন জনমানবহীন এ দ্বীপে জাহাজ নিয়ে বেড়াতে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল শিকার করা। কিন্তু শিকার করতে এসে দেখতে পান কেবল কয়েকটি কুকুর আর বিড়াল ছোটাছুটি করছে। তখন ইঁদুরকে স্থানীয় নামে ডাকা হতো ‘মেকুর’। সেই মেকুর থেকে মুকরি আর কুকুর থেকে কুকরি। সে হিসেবে তিনি নির্জন এ দ্বীপটিকে কুকরি-মুকরি নামে ডাকেন। তার থেকে এ দ্বীপের নাম কুকরি-মুকরি। স্থানীয় অনেকে এ দ্বীপকে স্বপ্নের দ্বীপ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। এ দ্বীপে ইঁদুর আর কুকুরের রাজত্ব কিন্তু বেশিদিন টেকেনি। এখানে রাজত্ব শুরু করে মনপুরার জলদস্যু, পর্তুগীজ ও ওলন্দাজরা। কুকরি-মুকরি দ্বীপ এখন সকলের কাছে অতি পরিচিত নাম। দ্বীপটির চারপাশ দিয়ে ম্যানগ্রোভ বনের কোল ঘেঁষে বাঁধ তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাঁধটি হয়ে গেলে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্যও অনেক সুবিধা হবে। কুকরি-মুকরিতে রয়েছে বাহারি প্রজাতির বৃক্ষ, তরুলতা। এ দ্বীপে বিচরণ করছে প্রায় চার হাজার হরিণ, ১৪ হাজার বানর, ১০ হাজার শেয়াল, অসংখ্য ভালুক, বুনোমহিষ, বনবিড়াল, উদবিড়াল, বনমোরগসহ হরেক রকম বৈচিত্র্যময় প্রাণী। যা দেখে মুগ্ধ পর্যটক। নীরব মূর্তির মতো মাথা উঁচু করে দ্বীপচরটি দাঁড়িয়ে থাকলেও এখানে রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসতি। যাদের জীবনধারার মান ভিন্ন। জেলে, দিনমজুর, কৃষক। আর খেয়া পার করে জীবনধারণ করা পেশাজীবীও রয়েছে। প্রকৃতির রূপ, আলো-আঁধারির বাহারি খেলা অবলোকন করা যায় স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরিতে। ভোরের সূর্যের আগমন বার্তা আর বিকেলের পশ্চিম আকাশে সিঁড়ি বেয়ে এক পা দু’পা করে লালিমায় ভরে ওঠার দৃশ্য সত্যিই অতুলনীয়। রাতে নতুন শাড়িতে ঘোমটা জড়ানো বধূর মতো নিঝুমতায় ছেয়ে যায় পুরো দ্বীপ। চর কুকরি-মুকরির দর্শনীয় একটি স্পট হলো ‘বালুর ধুম’। এটি চর পাতিলার দক্ষিণ পাড়ে (চর ডাকাতিয়া) নারকেল বাগান। তবে কুকরি-মুকরির প্রধান আকর্ষণ সাগরপাড়। এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্য ডোবার দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করে। চর কুকরি-মুকরির এ সৌন্দর্য খুব টানে পর্যটকদের। নতুন বছরকে বরণ করতে প্রতিবছর এখানে পালিত হয় সূর্যোৎসব। পর্যটক আর ভ্রমণপিপাসু মানুষকে মুগ্ধতার বন্ধনে আবদ্ধ করার এক অসাধারণ জাদু রয়েছে স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরিতে। স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরিতে শীতকালের চিত্র ভিন্ন। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখির আগমনে চর যেন নতুন রূপ ধারণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এর মধ্যে সিংহভাগই ভোলায় অবস্থান করে। স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরি অতিথি পাখিদের কাছে যেন অভয়ারণ্য। ইতোমধ্যে আইইউসিএন চর কুকরি-মুকরিকে বিশ্ব জীববৈচিত্র্যের স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশের অন্য পর্যটন কেন্দ্র্রগুলোর তুলনায় কুকরি-মুকরির চিত্র কিছুটা ভিন্ন ধরনের। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যানভাস কুকরি-মুকরিকে সাজিয়েছে সবুজের সমারোহে। যেখানে জীবিত গাছের সংখ্যা ২০ কোটিরও বেশি। নিরাপদ নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা, হোটেল-মোটেলসহ আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে কুয়াকাটা, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনের চেয়েও পর্যটক আকর্ষণ করবে অনেক বেশি। বিস্তৃত সবুজ বনাঞ্চল, মায়াবি হরিণের পাল আর মন ভুলানো সমুদ্র সৈকত কুকরি-মুকরিকে পরিণত করতে পারে ভ্রমণ বিলাসীদের তীর্থ ভূমিতে। বন বিভাগ জানায়, বন বিভাগ কুকরি-মুকরিতে একটি বন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানে পাঁচ হাজার ৯শ’ ৯১.৪২ হেক্টর বনাঞ্চল রয়েছে। এখানকার প্রধান বৃক্ষ কেওড়া, অর্থনৈতিক বিচারে যা ততটা সমৃদ্ধ নয়। দ্বীপের ভূ-প্রকৃতি সুন্দরী, গেওয়া, পশুর বৃক্ষের জন্য উপযোগী। তাই এখানে কেওড়ার পাশাপাশি এ সকল বৃক্ষ লাগানো হয়েছে। বন বিভাগের চর কুকরি-মুকরি রেঞ্জ কর্মকর্তা সাজেদুল আলম জানান, এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই কুকরির বনের মধ্যভাগ দিয়ে রাস্তা তৈরি ও লার্নিং সেন্টার নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া বালুর ধুম নারকেল বাগানে একটি বার্ড ওয়াচ টাওয়ার, পর্যটকদের সমুদ্র্রকূলে বসার জন্য ছাতা ও বেঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হবে।
×