ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৫ হাজার একর জমি দখল করে গড়ে উঠেছে

৪৫ হাজার বস্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার, অহরহ দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১৮ এপ্রিল ২০১৫

৪৫ হাজার বস্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার, অহরহ দুর্ঘটনা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রায়ই দেশের বিভিন্ন বস্তিতে দুর্ঘটনা ঘটছে, যা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। গত বুধবার রামপুরার হাজীপাড়ার আদর্শ গলিতে ঝিলের ভেতরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একটি দু’তলা বাড়ি ধসে পড়লে ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এছাড়া প্রায়ই বস্তিতে অগ্নিকা-সহ নানা ধরনের দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এসব কারণে দেশে থাকা ৪৫ হাজার বস্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার। বস্তিগুলো সরকারের প্রায় ৫ হাজার একর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে খোদ রাজধানীতেই রয়েছে ১১০টি। স্থানীয় প্রভাবশালী, এনজিও, মাদক ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, জমির দালাল, পেশাদার অপরাধী, স্থানীয় প্রশাসনের কারণে দেশে বছরের পর বছর ধরে বস্তি টিকে আছে। বস্তি উচ্ছেদ করতে গেলেই শুরু হয় সরকারবিরোধী নানা অপতৎপরতা। ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন্স) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জনকণ্ঠকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সারাদেশে থাকা বস্তির সঠিক পরিসংখ্যান এবং বস্তিতে থাকা মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সর্ম্পকে ধারণা থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি বস্তির অবস্থান, বস্তিতে যাতায়াতের রাস্তা, কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কিভাবে তা মোকাবেলা করা যায় বা ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায় সে সর্ম্পকেও পরিষ্কার চিত্র থাকা দরকার। তা থাকলে দেশের বিভিন্ন বস্তিতে অগ্নিকা- বা অন্যান্য দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা সম্ভব। কারণ বস্তিগুলো এমন জায়গায় অবস্থিত, যেখানে যাতায়াতের তেমন কোন রাস্তা নেই। ভারি যানবাহন নিয়ে যাওয়া রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য বেশিরভাগ সময়ই শত আন্তরিকতা ও চেষ্টার পরও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে বস্তিতে আগুন লাগলে পানি না পাওয়া যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। বস্তিবাসীদের মধ্যে আগুন লাগার পর করণীয় সম্পর্কে ধারণা কম থাকাও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। এসব কারণে প্রায়ই বস্তিগুলোতে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় সরকারের অধীনে কাজ করা বিভিন্ন দাতা সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, টঙ্গী, ময়মনসিংহ, রংপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, কুমিল্লা, দিনাজপুর, নবাবগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সাভার. গাজীপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ, পাবনা, চাঁদপুর, ফেনী, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ ও ফরিদপুরসহ ২৪টি জেলার ২৯টি শহরে ৪৫ হাজার বস্তি রয়েছে। এর মধ্যে টঙ্গী ও সাভারে বস্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বস্তিগুলো প্রায় ৫ হাজার একর সরকারী জমির উপর গড়ে ওঠেছে। রেলওয়ের জায়গায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি বস্তি। রেলওয়ের হিসেব অনুযায়ী সারাদেশে সরকারী, আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ৪ হাজার ৬৩৫ দশমিক ৫১ একর রেলওয়ের জমি অবৈধভাবে দখলে রেখেছে। বেদখলে থাকা জায়গাগুলোতে ভারি ও হালকা আধাপাকা স্থাপনা ছাড়াও বস্তি গড়ে উঠেছে। ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার রেলপথের দুই ধারের প্রায় ৫৮ একর জমিতে রয়েছে হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা আর বস্তি। এসব স্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করছে প্রায় ৫ হাজার স্থানীয় প্রভাবশালী। রেলওয়ের জায়গায় গড়ে উঠা বস্তিতে বসবাসকারী প্রকৃত বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন না করার আগ পর্যন্ত উচ্ছেদ না করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এজন্য গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার কাওরানবাজারে রেললাইনের উপর অবৈধভাবে বসানো মাছবাজারে বেচাকেনার সময় দুই ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় ১৬ জন। এরপর রেল কর্তৃপক্ষ সারাদেশে রেলের জায়গায় থাকা সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করে। টানা কয়েক দিনের অভিযানে প্রায় ৪ হাজার অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কোন বস্তি আদালতের নির্দেশনার কারণে উচ্ছেদ করতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ২০১২ সালে কমলাপুরের শাহজাহানপুর এলাকায় রেলওয়ের জায়গায় গড়ে উঠা অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করতে গেলে রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বস্তিবাসীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। বস্তিবাসীদের হামলায় দুই ম্যাজিস্ট্রেট ও ৮ পুলিশ আহত হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে শেষ পর্যন্ত গুলি চালাতে হয়েছিল। গুলিতে এক মহিলার মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হন ৫ জন। এমন পরিস্থিতিতে উচ্ছেদ অভিযান থেমে যায়। অদ্যাবধি শাহজাহানপুর রেলবস্তিতে আর কোন অভিযান চালানো হয়নি। স্থানীয় সরকারের অধীন কাজ করা দাতা সংস্থা ইউপিপিআর (আরবান পার্টনারশিপস ফর পোভার্টি রিডাক্সন প্রজেক্ট) এর জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ২১ ভাগ। এর মধ্যে ৮ শতাংশ মানুষ হতদরিদ্র। এসব হতদরিদ্র মানুষের বসবাস বস্তিগুলোতে। বস্তিগুলোতে প্রায় ৫ লাখ হতদরিদ্র মানুষ বাস করছেন।
×