ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তারেকের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড এ্যালার্ট

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৬ এপ্রিল ২০১৫

তারেকের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড এ্যালার্ট

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের নোটিসে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারি করেছে ফ্রান্সে অবস্থিত পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল। তারপর তার বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারির বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে পৃথিবীর ১৯০টি সদস্য দেশকে। মঙ্গলবার সকালে তার বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারি করা হয়। রেড এলার্ট জারি করার দিন মঙ্গলবার দুপুরে তিনি লন্ডন থেকে বেলজিয়ামে চলে যান এবং রাতের বেলায় ফিরে আসেন বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিক পুলিশের সংস্থা ইন্টারপোলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রেড এলার্ট জারি করার ফলে পলাতক অপরাধী হিসেবে তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলো। তারেক রহমানের পরিচয়, অবস্থান নিশ্চিত করতে সদস্য দেশগুলোর পুলিশ বাহিনী সহায়তা করবে, যাতে এক দেশের সরকার অপর দেশের সরকারের কাছে অপরাধী হিসেবে তাকে গ্রেফতার ও প্রত্যর্পণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের নোটিসে রেড এলার্ট জারি করার ফলে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা সহজ হবে। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টারপোল ডেস্ক সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ইন্টারপোল ডেস্ক সূত্র জানান, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, মানি লন্ডারিং, রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। ইন্টারপোলের নোটিসে আওয়ামী লীগের জনসভায় হ্যান্ডগ্রেনেড বিস্ফোরণ ও হত্যা মামলার অভিযোগের কথা বলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেফতার হওয়ার পর আর রাজনীতি করবেন না এই ধরনের মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার নামে লন্ডনে অবস্থান করছেন তারেক রহমান। তাকে গ্রেফতারের পর অমানুষিক নির্যাতন করে মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে ওয়ান ইলেভেনের সময়ে ক্ষমতাগ্রহণকারী তত্ত্ববধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে। ইন্টারপোল সূত্র জানান, ফ্রান্সে অবস্থিত ইন্টারপোলের সদর দফতর থেকে এই ধরনের রেড এলার্ট পলাতক আসামিদের ক্ষেত্রে জারি করা হয়, যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে দেশে-বিদেশ পালিয়ে বেড়ায়। ইন্টারপোল ডেস্ক সূূত্র জানান, ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে ওয়ান্টেড পারসন হিসেবে তারেক রহমানের ছবি, নাম-পরিচয় ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। ওয়েবসাইটটিতে তারেক রহমান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়, ৪৭ বছর বয়সী তারেকের জন্ম ১৯৬৭ সালের ২০ নবেম্বর। তিনি বাংলা, ইংরেজী ও উর্দু ভাষা জানেন। তার চোখ ও চুলের রং কালো এবং শরীরের উচ্চতা ১.৬৮ মিটার। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের ৬১ জনের নাম-বিবরণ রয়েছে। সবার শেষে তারেক রহমানের নাম, ছবি ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে তারেক রহমানের নাম ওয়ান্টেড পারসন হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ইন্টারপোলের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যানের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ তাকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য খুঁজছে। ২০০৮ সালে জরুরী অবস্থার সময় গ্রেফতার তারেক জামিনে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার কথা বলে লন্ডন পাড়ি দেন এবং সেখানে অবস্থান করে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচীতে তিনি অংশগ্রহণ করে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় বেশ কিছুদিন ধরেই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সর্বশেষ অবস্থান জানাতে লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনেও চিঠি দেয়া হয়। ১৯৫৮ সালে গৃহীত শরণার্থী সনদের ওপর ভিত্তি করে তারেকের রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের কথাও যুক্তরাজ্যের কাছে তুলে ধরেছে সরকার। ওই সনদ অনুযায়ী শরণার্থী যে দেশে থাকে সেখানে কোন রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নিতে পারে না। তারেক ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে যাওয়ার পর ওই বছরের ডিসেম্বরে তার পাসপোর্ট সর্বশেষ নবায়ন করেন এবং তার মেয়াদ ২০১৩ সালে শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশী পাসপোর্ট বৈধতা হারানোয় তিনি এখন শরণার্থী হিসেবে দেশটিতে অবস্থান করছেন বলে কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ইন্টারপোল ডেস্ক জানায়। সূত্র জানায়, তারেক রহমান পলাতক আসামি হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে তার বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে হাইকোর্ট। মঙ্গলবার সকালে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড এলার্ট জারি করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরেই তিনি লন্ডন থেকে বেলজিয়ামে চলে যান এবং রাতের বেলায় ফিরে আসেন বলে জানা গেছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেদিন ইন্টারপোল রেড এলার্ট জারি করেছে, ঠিক সেদিনই আবার লন্ডন ছেড়ে বেলজিয়ামে গিয়ে আবার ফিরে আসার বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে গোয়েন্দারা। তার ওপর তিনি পলাতক আসামি এবং চিকিৎসার নামে মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে যাওয়ার পর যদি বেলজিয়ামে যেতে পারেন, তবে বাংলাদেশে ফিরে আসছেন না কেন? তাহলে কি তিনি সত্যি অসুস্থ নাকি অসুস্থতার ভান করে মামলার আসামি হয়ে গ্রেফতার এড়াতে লন্ডনে অবস্থান করছেন? চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে যান তিনি। লন্ডনে অবস্থান করে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত ও জাতির জনকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বক্তব্য দেয়ায় রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির কয়েকডজন মামলাতেও তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে পুলিশ সদর দফতরের ইন্টারপোল ডেস্ক। সূত্র জানায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন শেখ হাসিনা গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে গেলেও সাবেক রাষ্ট্্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হওয়া ভবন এবং হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক রহমানের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই, সিআইডির দাখিল করা হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় আদালতে দাখিল করা দুটি সম্পূরক অভিযোগপত্রে (চার্জশীট) বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে আসামিসহ মোট ৫২ জনকে আসামি করা হয়েছে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা ও হত্যার অভিযোগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এ রেড এ্যালার্ট জারি করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সৈয়দ বজলূল করিম জানান, ফ্রান্সে অবস্থিত আন্তর্জাতিক পুলিশের সদর দফতর ইন্টারপোলের রেড এলার্ট নোটিস জারি করার আগে অপরাধী বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার জন্য তাদের রয়েছে লিগ্যাল ডেস্ক (আইন শাখা)। ইন্টারপোলভুক্ত দেশগুলোর সদস্যরা যেই অপরাধীর বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারির কথা বলবে তার পরিচয়, অবস্থান, মামলা, অপরাধের ধরন ইত্যাদির সকল বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করা হয়। তারেক রহমানের ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রশ্ন সামনে এনে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে বিএনপির আনা অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা সৈয়দ বজলূল করিম বলেন, ইন্টারপোলকে অপরাধীর পরিচয় ও তার বিরুদ্ধে সকল অপরাধের বিষয় জানাতে হয় ইন্টারপোলের সদর দফতরকে। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থার সদস্যভুক্ত ১৯০টি দেশের চোখে ধুলো দেয়া সম্ভবপর নয়। ইন্টারপোল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারি করার পর সরকারের উচিত হবে, তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো। ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আমরা তিন-চার মাস আগেই ইন্টারপোলে রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) পাঠিয়েছিলাম। ইন্টারপোল যাচাই-বাছাই করে, সবকিছু ক্লিয়ার (স্পষ্ট) পেয়ে, তারপরই নোটিস জারি করে। এটা তাদের এখতিয়ার। তাদের নিজস্ব লিগ্যাল এ্যাডভাইজার বডি (আইনী পরামর্শ শাখা) আছে, তারা যাচাই-বাছাই করেই কারও বিরুদ্ধে নোটিস জারি করে। এটা শুধু তারেক রহমানের ক্ষেত্রে নয়, সবার ক্ষেত্রেই এটা করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারি করার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য আইনানুগ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে লন্ডনে অবস্থারত তারেক রহমানকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য যুক্তরাজ্যে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।
×