ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৩ এপ্রিল ২০১৫

মমতাজ লতিফ

যুদ্ধাপরাধের বিচার সেই একাত্তর সালেই তো বঙ্গবন্ধু সরকার শুরু করেছিলেন যা পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধীদের মিত্র জিয়াউর রহমান বন্ধ করে দেন। যে আইনে এই বিচার হচ্ছিল ঐ দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজারেরও বেশি গ্রেফতারকৃত, বিচারে সোপর্দ যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি ও নাগিরকত্ব ফেরত দিয়ে জিয়া নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, পাকিস্তানের মিত্র প্রমাণ করেন। দেশে অপরাধীর বিচার না হওয়ার যে রীতি একনায়ক জিয়াউর রহমান চালু করেছিলেন তা আইনের শাসন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করে তুলে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেসব বাধার মূলোৎপাটন করেছে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে সরকারের এই সদিচ্ছাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে লাখো শহীদ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রধানত আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা দেশের জন্মের বিরোধিতাকারীদের বিচার চায়, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে বর্তমান সরকারকে এ কাজে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখন বেগম জিয়া পেট্রোলবোমায় ঝলসিয়ে নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়ে যে খেলা খেলেছেন তার জন্য অদূর ভবিষ্যতে জাতি ও দেশ ধ্বংসের অপরাধ সংঘটনের জন্য আইনের কাছে তাঁকে সোপর্দ করা হবে। পশ্চিমা সরকারগুলো যারা ১৯৪১ থেকে ’৪৫ সালে সংঘটিত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দানব হিটলার ও হিটলারপন্থী নাৎসি সদস্যদের এখনও খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের বিচার চালাচ্ছে, নাৎসি বাহিনীকে নিষিদ্ধ করেছে, তাদের সমর্থকদের জেলে বন্দী করে বিচারের মুখোমুখি করে। সেই তারা আজ কোন এক অভিসন্ধি নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে ঘৃণ্য ’৭১-এর হত্যাকারী ও ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড না দিতে এবং মুক্তিযুদ্ধে অপরাধী সংগঠন জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করতে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দ্বিচারিতা কেন? ইউরোপ-আমেরিকা নাৎসিমুক্ত থাকবে, কিন্তু বাংলাদেশ তার জন্মের শত্রু জামায়াতমুক্ত থাকতে পারবে না! এটা কেমন আবদার। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, বিদেশী সংস্থায় চাকরিকালে বহুবার বহু পশ্চিমা নারী-পুরুষকে ‘মাঠ’ বা তৃণমূল পরিদর্শনে সঙ্গী ও দোভাষীর কাজ করার সময় মাঝে মাঝে প্রত্যন্ত গ্রামের অর্ধ উলঙ্গ শিশুদের দল যখন ওদের দেখে ‘লাল বাঁদর’ ‘লাল বাঁদর’ বলে চেঁচাতে দেখেছি, তখন লজ্জায় অবনত হয়ে শিশুদের এসব গালি না দেয়ার জন্য বলতাম। এত বছর পর আজ মনে প্রশ্ন জাগছে পশ্চিমাদের অনেকেই কি আসলে লাল বাঁদর, যারা ডুগডুগি, অর্থ, সূত্রধরের তালে তালে নাচে? ব্যক্তিগতভাবেও আমাকে এক শ্বেতাঙ্গ নারীবশের অসহ্য, অন্যায় আচরণ ও পদক্ষেপ সইতে হয়েছে। তবে চির প্রতিবাদী আমি কিছু হবে না জেনেও হেড অফিসে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিলাম। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলব, ওরা (যুদ্ধাপরাধী) ওদের কথা বলে যাক, আপনি আপনার নির্বাচনী অঙ্গীকারের কথা বলে ঐ প্রসঙ্গ শেষ করুন। দ্বিতীয়ত প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, সাংসদ ’ল কমিশন, সবাই জনগণকে একটি বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দিন। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, ১৯৭৩-এর বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট, ’৭৩-এর আদি সংস্করণে, বর্তমান সংস্করণে যুদ্ধাপরাধীর ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপীলের সুযোগ পর্যন্তই বিচার কার্যক্রমটি সম্পন্ন হয়। এরপর যুদ্ধাপরাধীদের আর কোন সুযোগ থাকবে না। সরকার ভালভাবেই অবগত আছে যে, সরকারের শক্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণ প্রজন্ম ও সব বয়সের জনগণ। যে কারণে এই দীর্ঘ তিন মাস বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধে প্রাণ দিয়ে, জীবন-জীবিকার চাকা বন্ধ হলেও আমাদের সাধারণ নিরীহ মানুষ ওদের সমর্থন দেয়নি। এটিই তো সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রমাণ। এবার সরকারকে এই চরম ত্যাগের মাধ্যমে জনগণের আনুগত্যের দাম দিতে হবে। কিভাবে? প্রথমত, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে; দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় যুদ্ধাপরাধী ও জেলাভিত্তিক বিশাল মাপের যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার আপীলের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দ্রুত কার্যকর করে এবং তৃতীয়ত, আগুনে পুড়িয়ে নিরীহ মানুষকে মারার দায়ে বিএনপি নেত্রীসহ অপরাপর হুকুমের আসামির মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার শুরু। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বলব, জীবনে মহৎ কাজের সুযোগ কখনও দুইবার আসে না। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমরা বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কন্যা শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্র, জঙ্গী হামলা প্রতিহত করে জাতিকে একটি দৃঢ়, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসন, ক্ষতিগ্রস্তের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সবচাইতে বড় ভূমিকা রাখে যার মধ্যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়কালের মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধী এবং ২০১৩ ও ২০১৫-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান হুকুমদাতা ও অপরাধ সংঘটনের অপরাধীদের দ্রুত বিচার সম্পাদন এবং তাদের দ্রুত দ- কার্যকর করা। এখানে একটি প্রস্তাব আমি ব্যক্তিগতভাবে রাখতে চাই, তা হলোÑ এসব অপরাধীর কারও জন্য আপীলের পর ‘রিভিউ’ এবং ‘রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা’Ñ এ দুটি অতিরিক্ত সুবিধা থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী, জানি আপনাকে নানা হিসাব-নিকাশ করে দেশ ও সরকার পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। আপনি ’৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট-এ প্রদত্ত ও নির্ধারিত বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করুন। এই এ্যাক্টটি যুদ্ধাপরাধীদের আপীলের যে সুযোগ দিয়েছে সেটি নাৎসি অথবা অন্য দেশের অন্যান্য বিশাল মাপের পরিকল্পিত হত্যাকা-ের ও নারী নির্যাতনের অপরাধের অপরাধীদের দেয়া হয়নি। আমাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আমরা আপীলের সুযোগ রেখে অতিরিক্ত সুযোগগুলো আর দেব না। আমি, জনগণ, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধী এবং পরবর্তী সময়ের গণহত্যাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে ও ‘রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা’ অপরাধীদের বিচারের নামে অনাবশ্যক কালক্ষেপণকারী এই দুটো অতিরিক্ত সুবিধা রহিত বা বাতিল করার পক্ষে। সরকারকে আশ্বস্ত করতে চাই এই বলে যে, এই দুই দল জাতির চরম শত্রু এবং তারা অতীতে কখনও তাদের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা দূরে থাক, দুঃখ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি, তারা কখনও অনুশোচনাও করেনি, বরং উল্টো তারা তাদের একই অপরাধ সময় ও সুযোগ পেলে আবারও করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তাদের আত্মীয়রা পর্যন্ত লজ্জিত নয়, বরং মিথ্যা কথা বলে যুদ্ধাপরাধীর অপরাধকে সমর্থন করে অপরাধ করেছে। বলতে চাই, শত্রুকে ছোট ভাবতে নেই, মনে রাখবেন বিশেষ করে যে শত্রু দীর্ঘ তিন দশকে অর্থবিত্তে শক্তিশালী হয়েছে। তাই এই একবারেই শক্ত হাতে শত্রুকে বধ করতে হবে। এখানে সঙ্কটের বিহ্বলতা দুর্বলতা মাত্র, যা মুহূর্তে লাখ লাখ দানবের জন্ম দেবে। সুতরাং, সাবধান! এ কথা তো বলাবাহুল্য যে, যুদ্ধাপরাধীরা মানুষ হত্যা করেছিল, আমরা তো পশু দানবদের হত্যা করছি, তাও আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ
×