ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এখনও পেছনে হাঁটছে বিএনপি

তিন সিটিতেই ভোটযুদ্ধের মাঠে আওয়ামী লীগের একক মেয়র প্রার্থী

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৬ এপ্রিল ২০১৫

তিন সিটিতেই ভোটযুদ্ধের মাঠে আওয়ামী লীগের একক মেয়র প্রার্থী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একক প্রার্থী মনোনয়নে এগিয়ে আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে তিন সিটিতেই একক মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করে তাদের ভোটযুদ্ধের মাঠে নামিয়েছে দলটি। এক্ষেত্রে এখনও পেছনে হাঁটছে বিএনপি। ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রামে একক মেয়র প্রার্থী ঘোষণা দিলেও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে এখনও দলীয় মেয়র প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে পারেনি দলটি। আর কাউন্সিলর পদে ঐকমত্য এখনও দূর অস্ত। জনপ্রিয়তা ও অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তিন সিটিতে নিজেদের প্রার্থী বিজয়ী করতে নানা হিসাব-নিকাশ করেই নির্বাচনী কর্ম-কৌশল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী নিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানেই রয়েছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিভিন্ন মামলা, প্রার্থীদের ভোটের মাঠে দৃশ্যমান না থাকা, সিদ্ধান্তের দোদুল্যমানতায় এখনও পর্যন্ত বেশ বেকায়দায় রয়েছে বিএনপি। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রার্থিতা নিয়ে সৃষ্ট মান-অভিমান ও গ্রুপিং নিষ্পত্তি করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তিন সিটিতে দল সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থীর পক্ষে ভোটযুদ্ধে নামার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। কাউন্সিলের সম্ভাব্য একক প্রার্থীর একটি খসড়া তালিকাও ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের কৌশলই চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। শোনা যাচ্ছে, দীর্ঘ ৯২ দিন পর গুলশানের কার্যালয় থেকে বাসায় ফেরা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আজ-কালের মধ্যেই দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ‘ক্লিন ইমেজের’ সাবেক এফবিসিআই সভাপতি আনিসুল হককে দলের প্রার্থী করে আগেই চমক দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে নতুন প্রজন্মের দুই তরুণ নেতা সাঈদ খোকন ও আ জ ম নাছির উদ্দিনকে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন সব পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই। ঢাকা দক্ষিণে দলের অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী হাজী মোহাম্মদ সেলিম এমপিকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝিয়ে সাঈদ খোকনের পক্ষেই নির্বাচনী প্রচারে নামানোর ক্ষেত্রেও সফলতা দেখিয়েছেন। এসব কারণে ঢাকা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঘোষিত তিন মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের মধ্যে প্রকাশ্য কোন বিরোধিতা নেই। যেটুকু মান-অভিমান কিংবা দ্বন্দ্ব-কোন্দল রয়েছে তা দ্রুতই নিষ্পত্তি করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব পর্যায়ের নেতারা তিন সিটিতেই দলের বিজয় ঘরে তুলতে নির্বাচনী মাঠে নামার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের তিন সিটি মেয়র প্রার্থীই নগরবাসীদের আকৃষ্ট করতে নানা প্রতিশ্রুতি সম্বলিত নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজও প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছেন। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ জ ম নাছিরকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে মাঠে নেমেছে ১৪ দলের নেতাকর্মীরাও। দু’একদিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় চৌদ্দ দলের বৈঠক থেকে ঢাকার দুই প্রার্থী সাঈদ খোকন ও আনিসুল হককে সমর্থন জানানো হতে পারে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি দু’জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলেও ঢাকা উত্তর সিটিতে দলীয় একক প্রার্থিতা নির্বাচন নিয়ে দোটানায় পড়েছে বিএনপি। ঢাকা দক্ষিণে নগর বিএনপির সভাপতি মির্জা আব্বাস এবং চট্টগ্রামে সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। তবে ঢাকা দক্ষিণে মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করা নিয়ে মহাসঙ্কটে পড়েছে বিএনপি। ঢাকা উত্তরে আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় বলতে গেলে বিএনপি সমর্থিত আর কোন প্রার্থীই নেই। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একক মেয়র প্রার্থিতা মনোনয়ন নিয়েই রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন বিএনপির হাইকমান্ড। একক কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনের কাজ শুরুই করতে পারেনি তারা। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল এবং বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরীর মেয়র পদে প্রার্থিতা বহাল রয়েছে। এ দু’জনের সঙ্গে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের সুসম্পর্ক থাকলেও কেউই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। যদিও আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রার্থিতা ফিরে পেতে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। আজ শুনানি শেষে যদি আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে সেক্ষেত্রে তাবিথ আউয়াল কিংবা মাহী বি চৌধুরী যে কোন একজন মেয়র পদে বিএনপির সমর্থন পেতে পারেন বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা সিটি দক্ষিণে মির্জা আব্বাসের মনোনয়ন নিয়েও খোদ বিএনপির মধ্যে স্পষ্ট দ্বিধা-বিভক্তি রয়েছে। বিএনপির সাবেক দুই মেয়র মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার সম্পর্ক যে ‘সাপে নেউলের’ মতোই এ বিষয়টি আগেই দলটির নীতিনির্ধারক নেতাদের জানা। আর এই বিভেদের রাজনীতি থেকেই সাদেক হোসেন খোকার সমর্থন নিয়ে মেয়র পদে মনোনয়ন নিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় আবদুস সালাম। আরও মনোনয়ন নিয়েছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক এম আসাদুজ্জামান রিপন, আবুল বাশার ও কারাবন্দী নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু। পিন্টুর মনোনয়ন বাতিল হলেও আবদুস সালাম, আসাদুজ্জামান রিপন ও আবুল বাশারের মনোনয়ন বৈধ রয়েছে। বিএনপির হাইকমান্ড থেকে মির্জা আব্বাসকে মেয়র পদে দলীয় সমর্থন দেয়া হলেও তা ভালভাবে মেনে নেয়নি সাদেক হোসেন খোকার সমর্থক নেতাকর্মীরা। কাউন্সিলর পদের জন্য ইতোমধ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছে মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার পক্ষ থেকে দুটি পৃথক তালিকা জমা দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে দু’গ্রুপ প্রকাশ্য না হলেও গোপনে এখন মুখোমুখি অবস্থায়। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মির্জা আব্বাসের জয়ী হওয়া অনেকটাই অসম্ভব বলেই মনে করছেন খোদ বিএনপির মাঠের নেতাকর্মীরাও। আর দক্ষিণে অনেকটাই অপরিচিত তাবিথ আউয়াল। বিএনপির নেতাকর্মীরাই তাকে চেনে না। আর মাহী বি চৌধুরীর ব্যাপারেও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি ভেঙ্গে বিকল্পধারা বাংলাদেশ গঠনের অন্যতম কারিগর মাহী বি চৌধুরীকে দলটির নেতাকর্মীরা শেষ পর্যন্ত মেনে নেবে কি না, এ নিয়েও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। মোদ্দাকথা তিন সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিলেও একক প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি। সেদিক থেকে সবদিক দিয়েই স্বস্তি ও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন তিন সিটি নির্বাচনকে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের ‘এসিড টেস্ট’ হিসেবে নিয়েছে শাসক দলটি। কোন প্রকার হস্তক্ষেপ নয়, বরং জনপ্রিয়তা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল শক্তিকে একাট্টা করেই নির্বাচনী যুদ্ধে নেমে তিনটি মেয়র পদই নিজেদের ঘরে তুলতে চায় তারা। তিন সিটি নির্বাচনের টোপে ফেলে বিএনপিকে নাশকতার পথ ছেড়ে স্বাভাবিক রাজনৈতিক ধারায় ফিরিয়ে আনার বিষয়টি রাজনৈতিক প্রাথমিক বিজয় হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগ। এবার নির্বাচনী ভোটযুদ্ধেও বিএনপিকে পরাজিত করে তাদের রাজনীতিকেই অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিতে চান দলটির নেতারা। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল বিভেদ ভুলে দলের স্বার্থে দলসমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশের পরই গভীর রাত পর্যন্ত সাঈদ খোকন ও হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে নিয়ে বৈঠক করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ওই বৈঠকেই হাজী সেলিম সাঈদ খোকনের পক্ষে নির্বাচনী মাঠে নামার ঘোষণা দেন এবং দল সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগেরও ঘোষণা দেন। দফায় দফায় বৈঠক করে মেয়র ছাড়াও কাউন্সিলর পদে দলীয় একক প্রার্থিতা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। একক কাউন্সিলরের একটি খসড়া তালিকা ইতোমধ্যে দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলেও দিয়েছেন তাঁরা। জানা গেছে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই কাউন্সিলর পদেও একক প্রার্থিতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে আওয়ামী লীগ। একক প্রার্থিতা ঘোষণার পর মনোনয়নপত্র দাখিলকারী দলের সব প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হবে। কেউ দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে সিটি নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতার মতে, এ নির্বাচন আমাদের জন্য এ্যাসিড টেস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট হরতাল-অবরোধের নামে যে ভয়াল নাশকতা-সহিংসতা ও মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, তাতে দেশের জনগণ দলটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধুমাত্র দলীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ তৎপরতার দুর্নাম থেকে নিজেদের কিছুটা হলেও মুক্ত করতেই বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। অতীতে কয়েকটি সিটি নির্বাচনে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেজন্য আওয়ামী লীগ এবার আগে থেকেই সতর্ক। যেটুকু বিভেদ বা দ্বন্দ্ব রয়েছে তা দ্রুত মিটমাট করে ফেলা সহজ হবে। সবদিক থেকে তিন সিটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থীর বিজয়ের ব্যাপারে আমরা প্রচ- আশাবাদী।
×