ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আহত তিন শতাধিক ॥ দেড় হাজার একর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত ॥ আজও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস

শনিবারের কালবৈশাখীতে প্রাণহানি বেড়ে ৩৯

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৬ এপ্রিল ২০১৫

শনিবারের কালবৈশাখীতে  প্রাণহানি বেড়ে ৩৯

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শনিবার বয়ে যাওয়া শক্তিশালী কালবৈশাখী ঝড়ে সারাদেশে মোট মৃতের সংখ্যা ৩৯ জনে দাঁড়িয়েছে। নৌকাডুবি, বজ্রপাত, দেয়াল ও গাছের ডাল পড়ে তাদের মৃত্যু ঘটে। আহত হয়েছে তিন শতাধিক। ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেড় হাজার একরের বেশি জমির ফসল। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, শিক্ষা ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। ভেঙ্গে গেছে শত শত গাছপালা। বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার নেমে আসে। রবিবারও অনেক এলাকায় বিচ্ছিন্ন বিদ্যুত লাইনের সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার। আজ সোমবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। নিজস্ব সংবাদদাতা, স্টাফ রিপোর্টার, আবহাওয়া অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শনিবার ঘূর্ণিঝড়ে জামালপুরে নৌকাডুবিতে ১ জনের মৃত্যু হয় এবং নিখোঁজ রয়েছে তিনজন। সিরাজগঞ্জে নৌকাডুবি ও বজ্রপাতে মৃত্যু হয় ৩ জনের, নিখোঁজ রয়েছে ৩ জন এবং আহত হয়েছে ১০ জন। কুড়িগ্রামে আহত হয় ২০ জন। বগুড়ায় ১৯ জনের মৃত্যু ঘটে, আহত হয় দেড় শতাধিক। রাজশাহীতে মৃত্যু হয়েছে ৫ জন, আহত ২৭ জন। গাইবান্ধায় নৌকাডুবিতে ১ জনের মৃত্যু হয় এবং ১ জন নিখোঁজ রয়েছে। যশোরে বজ্রপাতে ২ জনের মৃত্যু হয় এবং আহত ২ জন। এদিকে গাছ চাপায় মানিকগঞ্জে ১ বৃদ্ধা, নরসিংদীতে ১ জন, পাবনায় ১ জন এবং নাটোরে ১ বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। আর বজ্রপাতে কক্সবাজারে ১ জন, সুনামগঞ্জে ১ জন, কুমিল্লায় ২ জন, ঝিনাইদহে ১ জনের মৃত্যু ঘটে। আর সিরাজগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির আবাদী ফসল। রাজশাহীতে প্রায় ৮০ হাজার কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। জামালপুরে ১২টি ইউনিয়নের ৩ শতাধিক ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সিরাজগঞ্জের ৫ উপজেলার প্রায় ২শ’ কাঁচা ঘরবাড়ি, কুড়িগ্রামের ৫টি গ্রামের ২ শতাধিক ঘরবাড়ি, বগুড়া জেলার ৮ উপজেলার ৮০ ভাগ ঘরবাড়ি, রাজশাহীতে প্রায় ৩১ হাজার ঘরবাড়ি এবং ১৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নরসিংদীতে ৬ উপজেলার কয়েক শ’ ঘরবাড়ি, সুনামগঞ্জে শতাধিক ঘরবাড়ি, গাইবান্ধায় ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জেলায় কয়েক শ’ ঘরবাড়ি উড়ে গেছে। নিজস্ব সংবাদদাতা জামালপুর থেকে জানান, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ের তা-ব ও শিলাবৃষ্টিতে ২ হাজার কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ইসলামপুরে যমুনা নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবিতে একজনের লাশ উদ্ধার ও ৩ জন নিখোঁজ রয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা মানিকগঞ্জ থেকে জানান, শনিবার রাতে বৈশাখী ঝড়ে মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে গাছের চাপায় সন্ধী বেগম (৫৫) নামের এক বিধবা নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার খলশী ইউনিয়নের বনগ্রাম এলাকার মৃত আজমত আলীর স্ত্রী। স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, রাজারহাট উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া টর্নেডোর আঘাতে ৫টি গ্রাম ল-ভ- হয়েছে। এতে ২টি মন্দিরসহ ২ শতাধিক আধাপাকা বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ সময় কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। প্রচ- ঝড়ে মৌসুমি ফসল ও বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করছে। স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া অফিস থেকে জানান, ২১ মিনিটের ভয়াবহ ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে বগুড়ার ৮ উপজেলা। এ যাবত কালের সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় হয়েছে বলে মনে করছেন এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা। মাঠপর্যায়ের ঝড়ের চিহ্ন তা সমর্থন করে। ঝড়ে এ পর্যন্ত মারা গেছে ১৯ জন। মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে। আহত হয়েছে দেড় শতাধিক। ৬৩ জনকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্কি করা হয়েছে। যার মধ্যে ৮ জনের অবস্থা গুরুতর। মৃত ব্যক্তিরা হলেন বগুড়া সদরের বৌবাজার এলাকার আজিরণ (৩৮) ও তার ৬ মাসের শিশু নিলা। শহরদীঘি এলাকার রাজিব (১৫), মধ্যপালশার পলাশ (১৮), নিশিন্দারা চাঁদপাড়া এলাকার গোলাপী (৩৪) শাজাহানপুর উপজেলার নয়মাইল এলাকার আব্দুল মান্নান পান্না (৩৫), ক্ষুদ্রফুলকোট গ্রামের পায়েল (১৮), খোট্টাপাড়ার রাবেয়া (৬৫), গাবতলি উপজলোর তেলিহাটা গ্রামের মাজিরা বেগম (৬০), সোনাতলা উপজেলার লোহাগাড়া গ্রামের ফিরোজা বেওয়া (৫৫), কাহালু উপজেলার হারলতা গ্রামের আজিজার (৩৫) ও ইসমাইল (৩৭), ধুনট উপজেলার জোরশিমুল গ্রামের আফজাল হোসেন (৫৪), সারিয়াকান্দি উপজেলার ফুলবাড়ি গ্রামের সুজন (৩০) ও নারচি গ্রামের শান্তা বেগম (৫০), সারিয়াকান্দির ধারাবর্ষা ছরের মোজামে শেখ (৩৫) ও নন্দীগ্রামের বইল গ্রামের আব্দুস সাত্তার (৫০)। শনিবার সন্ধ্যা ৫টা ৫৯ মিনিট থেকে ঘণ্টায় ৯৬ কিলোমিটার বেগে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ঝড় শুরু হয়ে কিছুক্ষণের জন্য ঘণ্টায় প্রায় ১শ’ ২৫ কিলোমিটার বেগে পৌঁছে ২১ মিনিট স্থায়ী হয়। স্টাফ রিপোর্টার রাজশাহী থেকে জানান, কালবৈশাখীর প্রথম ছোবলে ল-ভ- হয়ে গেছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ। শনিবার বিকেলের তা-বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার কৃষকরা। নগরসহ জেলার ৯ উপজেলায় অন্তত এক শ’ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। আর এসব উপজেলা ৩১ হাজার ৯৩৬ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ৬ হাজার ৯০৬টি। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭৬টি। ১২ মিনিটের তা-বে ৮০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রবিবার সকালে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র কালবৈশাখীর তা-বের ক্ষতচিহ্ন। ঝড়ে মোট ৫ জন নিহত ও ২৭ জন গুরুতর আহত হয়েছে। ইতোমধ্যে নিহতদের পরিবারকে নগদ ২০ হাজার করে টাকা ও আহতদের প্রত্যেককে ৫ হাজার করে টাকা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার প্রতি ২০ থেকে ৩০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা নরসিংদী থেকে জানান, কালবৈশাখীর ছোবলে আলাল মিয়া (৩৫) নামে এক ব্যক্তি গাছ চাপায় নিহত হয়েছে। জেলার ৬টি উপজেলার কয়েক শ’ কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। শনিবার রাত ৮টার দিকে শুরু হয়ে রাত ১১টা পর্যন্ত টানা ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে নরসিংদী সদর, পলাশ, শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে শাকসবজি, ইরি-বোরো, কলাসহ উঠতি ফসলের ক্ষতি সাধিত হয়। ঝড়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙ্গে পড়েছে এবং অনেক গাছ উপড়ে পড়েছে। সংবাদদাতা নাটোর থেকে জানান, নাটোরের সিংড়ায় কালবৈশাখীতে গাছের ডাল ভেঙ্গে মাথায় আঘাত লেগে রাবেয়া বেগম (৫৫) নামের এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। রবিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিংড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। নিহত রাবেয়া বেগম উপজেলার রামানন্দ খাজুরা এলাকার আব্দুর রহমানের স্ত্রী। স্টাফ রিপোর্টার কক্সবাজার থেকে জানান, কক্সবাজার সদর পোকখালীতে বজ্রপাতে এক লবণ চাষীর মৃত্যু হয়েছে। পূর্ব গোমাতলীর লবণ মাঠে কাজ করার সময় রবিবার ভোরে বজ্রপাতে মোঃ তারেক (২০) নামে লবণ চাষী ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। তিনি ঈদগাঁও মাইজপাড়ার সোলতান আহমদের পুত্র। নিজস্ব সংবাদদাতা সুনামগঞ্জ থেকে জানান, সুনামগঞ্জে শনিবার রাতে কালবৈশাখীতে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার গাছপালা ভেঙ্গে পড়েছে। এদিকে শনিবার রাতে শাল্লা উপজেলার কাশিপুর গ্রামের নিবাস দাস (২৫) নামের এক যুবক বজ্রপাতে মারা গেছে। নিজস্ব সংবাদদাতা কুমিল্লা থেকে জানান, কুমিল্লায় বজ্রপাতে হাসান ও রফিক হাজারী নামে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা ঝিনাইদহ থেকে জানান, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে বজ্রপাতে জহির উদ্দিন (৩০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, রবিবার যশোরে বজ্রপাতে এক শিশুসহ ২ জন নিহত হয়েছে। নিহতরা হলো যশোর উপশহর ৭ নম্বর সেক্টরের শহীদ গাজির পুত্র এবং স্থানীয় শহীদ স্মৃতি সরকারী প্রাইমারী স্কুলের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র নুরুজ্জামান(১২) ও মণিরামপুরের হানুয়ার গ্রামের সাগর হোসেন।
×