ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বহু বাড়িঘর দোকানপাট বিধ্বস্ত, বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন

কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ঢাকাসহ সাত জেলায় হত ১৪

প্রকাশিত: ০৯:১২, ৫ এপ্রিল ২০১৫

কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ঢাকাসহ সাত জেলায় হত ১৪

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শনিবার বয়ে যায় কালবৈশাখী। এতে নারী-শিশুসহ ১৪ জনের মৃত্যু ঘটে। ঝড়ে রাজশাহীতে ৪ জন, বগুড়ায় ৫ জন এবং ঢাকা, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় একজন করে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে বহু মানুষ। ফরিদপুর সদর থানার শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট বিধ্বস্ত হয়। বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এলাকাসমূহে নেমে আসে অন্ধকার। রাজধানীতেও ভেঙ্গে পড়ে গাছের ডালপালা, সাইনবোর্ড এবং বাসাবাড়ির দরজা-জানালার কাঁচ। উড়ে যায় অনেক ভাসমান দোকানপাট। ঝড়ো বাতাসের বেগে আহত হয় অনেক পথচারী। বাতাসের সঙ্গে আকাশে উড়তে থাকে ধুলাবালি। ঝড়োহাওয়া শেষে নেমে আসে বৃষ্টি। সাময়িক দুর্ভোগে পড়ে রাজধানীবাসী। শনিবার সকাল থেকে বিকেলজুড়ে তীব্র গরম অনুভূত হয় রাজধানীতে। সূর্যের তির্যক রশ্মি এবং তীব্র গরমে অতীষ্ঠ হয় নগরবাসী। হঠাৎ সন্ধ্যায় বদলে যায় রাজধানীর চিত্র। বইতে থাকে কালবৈশাখী। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে চলতে থাকে ঝড়োহাওয়া। শুরু হয় লোকজনের ছোটাছুটি। কেউ কেউ নিকটস্থ স্থাপনায় পৌঁছার আগেই বাতাসের কবলে পড়েন। বাতাসের বেগ সামাল দিতে না পেরে অনেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে আহত হয়। ফুটপাথের ভাসমান দোকানসমূহ গুটিয়ে ফেলার সুযোগ পায়নি অনেকে। বাতাসে উড়ে যায় জিনিসপত্র। ফুটপাথের চা দোকানগুলোর পলিথিনের ছাউনিও উড়ে যায়। নড়বড়ে অবস্থায় থাকা অনেক সাইনবোর্ড ভেঙ্গে পড়ে। ঝড়োহাওয়া শেষে নেমে আসে বৃষ্টি। বাড়তে থাকে পথচারীর দুর্ভোগ। কেরানীগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, সদরঘাটে নদী পারাপারের সময় ঝড়ের কবলে পড়ে হানিফ শেখ (৪০) নামে এক ব্যক্তি মারা যান। ঝড়ের সময় দু’নৌকার মাঝখানে চাপা পড়ে তার মৃত্যু ঘটে বলে তার চাচাতো ভাই জানান। রাজধানীর রমনা থানাধীন মৎস্য ভবন সংলগ্ন রাস্তায় ঝড়ে বিলবোর্ড ভেঙে দুই রিক্সাচালক ও এক প্রাইভেটকার আরোহী আহত হয়েছেন। আহত রিকশাচালদের মধ্যে একজন হলেন তারা মিয়া (৩৮)। অপরজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় জাকারিয়া (২৮) নামে একজন টিনের আঘাতে এবং ধোলাইপারে আবুল হোসেন (৩০) নামে একজন ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন। তারা উভয়েই ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে জানান, মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী আঘাত হেনেছে রাজশাহী অঞ্চলে। শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার পর হঠাৎ পুরো এলাকায় অন্ধকার নেমে আসে। শুরু হয় কালবৈশাখীর তা-ব। রাজশাহী নগরীসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে কালবৈশাখী ঝড়। সঙ্গে ছিল বজ্রসহ বৃষ্টিপাত। ঝড়ের শুরু থেকেই বিদ্যুতবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজশাহী মহানগরীর পুরো এলাকা। ঝড়ে আম, লিচুসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা। ঘণ্টাব্যাপী এ ঝড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবলিস চত্বরে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া জেলার পুঠিয়ায় অটোরিক্সার ওপর বিলবোর্ড পড়ে অন্তত ৫ জন আহত হয়। মোহনপুরে এক শিশু গুরুতর আহত হয়েছে। তাকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া গোদাগাড়ী ও তানোরে অন্তত ৪ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। বাঘা উপজেলার পাকুরিয়া গ্রামের জাহানারা বেগম (৫০) দেয়াল চাপায় এবং একই উপজেলার কিশোরপুর গ্রামের ইমাজউদ্দীনের (৪৮) ওপর গাছের ডাল পড়লে তিনি মারা যান। বিকেলে শুধু ঝড় হলেও এলাকাজুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। বিদ্যুতের তার ও বিলবোর্ড রাস্তায় পড়ে পথচারীদের চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। রাজশাহী আবহাওয়া অধিদফতরের পর্যবেক্ষক দেবল কুমার মৈত্র জানান, ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এ সময় ১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় বলে জানান তিনি। বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকা বিদ্যুতের তার ও বিলবোর্ড পথচারীর চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। রাজশাহীর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানায়, ঝড়ের পর নগরীর ভদ্রা ও সাগরপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ওপর গাছ পড়ে গেছে। ভাঙ্গা গাছ ও ডালপালা সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করেন দমকল বাহিনীর সদস্যরা। বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহীর ইঞ্জিনিয়ার শহিনুল ইসলাম শাহিন জানান, ঝড়ের পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিদ্যুতের খুঁটির ওপর গাছ পড়ে যাওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে সেসব জায়গায় মেরামতের জন্য লোক পাঠানো হয়েছে। ঝড়ে নগরীর সাহেববাজার, গোরহাঙ্গা রেলগেট, নওদাপাড়া, বায়া, বিমানবন্দর থানার মোড়, শালবাগান এবং লক্ষ্মীপুর এলাকার রাস্তার ধারের বিভিন্ন গাছপালা ও সাইনবোর্ড রাস্তায় পড়ে গেছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকানপাট। জেলার তানোর, গোদাগাড়ী, পবা, পুঠিয়া, বাগমারা, বাঘা, চারঘাট ও মোহনপুর উপজেলায় কালবৈশাখী ঝড়ে আম, লিচু বাগান ও পানের বরজে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও অনেক স্কুল ও কলেজের টিন উড়ে গেছে। সড়কের পাশের অনেক দোকানপাট উড়ে গেছে। গ্রামের মানুষের ছোট ছোট অসখ্য কুঁড়েঘর উড়ে গেছে বলে এলাকাবাসী জানায়। বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দুর্ভোগে পড়ে এলাকাবাসী। ঝড়ের শুরুতেই বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঝড়ের পর জেলার কোথাও বিদ্যুত ছিল না। তবে বিদ্যুত বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, অনেকস্থানে বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে তার ছিঁড়ে পড়ায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুত বিভাগের লোকজন ইতোমধ্যে মাঠে কাজ শুরু করেছে। স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া থেকে জানান, শনিবার সন্ধ্যায় প্রবল ঝড়ে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে দেয়াল ও গাছ চাপা পড়ে মহিলা ও শিশুসহ ৫ জন মারা যান। নিহতরা হলেন আজিরন (৩৫), ছয় মাস বয়সী শিশু নিলা, আব্দুল মান্নান ওরফে পান্না (৩৮) ও রাবেয়া। এছাড়া কমপক্ষে আরও ৩০ জন আহত হন। ঝড়ের সঙ্গে ছিল শিলা বৃষ্টি। ঝড়ে কয়েকশ’ বাড়ি ঘরের টিনের চাল উড়ে যায়। শত শত গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, বিলবোর্ড ও বাড়ি ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে। প্রবলঝড়ের কারণে রাত পৌনে ১০টা পর্যন্ত বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ ছিল। বিদ্যুত বিভাগ জানিয়েছে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের মূল সরবরাহ লাইনের তার ছেঁড়াসহ বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে যাওয়ায় রাতে বিদ্যুত সরবরাহ স্বভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। ঝড়ে ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। নিজস্ব সংবাদদাতা, ফরিদপুর থেকে জানান, ঝড়ে ফরিদপুর সদরের আলীয়াবাদ ও ডিক্রিরচর ইউনিয়নে ৯১টি ঘরবাড়ি ও ৬টি দোকান বিধ্বস্ত হয়েছে। শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঝড়ে আলীয়াবাদ ইউনিয়নের গদাধরডাঙ্গি গ্রামে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ওই গ্রামের বিলাল বিশ্বাস, কুদ্দুস শেখ, হাবিবুর রহমান, সরোয়ার তালুকদারসহ ৩০টি পরিবারের ৫৬টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া ওই গ্রামের খুশিরবাজার এলাকায় আসাদ ফকির, রাজা মোলা, দলিলউদ্দিন মোলা ও সাত্তার শেখসহ ৬ ব্যক্তির ৬টি দোকান উড়ে গেছে। গদাধরডাঙ্গি গ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মকবুল হোসেন জানান, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট জমা দেয়া হয়েছে। সদরের ডিক্রিরচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাদেকুজ্জামান পাল বলেন, একই সময় ঝড়ে ডিক্রিরচর ইউনিয়নের ভাঙ্গিডাঙ্গি, ভূইয়াডাঙ্গি, রহিম ফকিরেরডাঙ্গিসহ চারটি গ্রামে ৩৫টি ঘরবাড়ি উড়ে গেছে। ফরিদপুর সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহিরুল ইসলাম বলেন, ফরিদপুর সদরে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে সাহায্য দেয়া হবে। নিজস্ব সংবাদদাতা, নওগাঁ থেকে জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে জেলার অনেক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন এবং গাছপালা ভেঙ্গে পড়ায় স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। চরম দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। এতে শাহনাজ পারভীন নামে এক নারীর মৃত্যু ঘটে। স্টাফ রিপোর্টার মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, আকস্মিক ঝড়ে মুন্সীগঞ্জে বহু গাছপালা উপড়ে যায়। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েকটি কাঁচা ঘরবাড়ি। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যায়। এতে বিদ্যুতহীন হয়ে পড়ে মুন্সীগঞ্জ। ঝড়ের কারণে শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে হাজরা টার্নিংয়ের চরে আটকা পড়ে ফেরি রামশ্রী। পরে ৩ ঘণ্টা পর এটিকে উদ্ধার করা হয়।
×