ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

সেদিনের চৈত্র সংক্রান্তি মেলা

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৪ এপ্রিল ২০১৫

সেদিনের চৈত্র সংক্রান্তি মেলা

মাসিমা মারা গেছেন। কলকাতার লেক টাউনে নিজ বাড়িতে। বয়স হয়েছিল তাঁর। আমার ছেলেবেলার বন্ধু এ্যাডভোকেট প্রিয়লাল দত্তের মা। তাঁকে যত দেখেছি, তাঁর কাছে যখনই গেছি আমাদের নিজের মায়ের মতো মনে হয়েছে। কখনও বুঝতে দেননি আমি তাঁর ছেলের বন্ধু হলেও মুসলিম সন্তান আর তিনি একজন হিন্দু নারী। মমতাময়ী বলতে যা বোঝায় মাসিমা ছিলেন তেমনি একজন। বাংলার কোন ঘরে কোন আঙিনায় এমন মাসিমাদের আজকাল দেখা যাবে কিনা জানি না, তবে ৫০-৬০ বছর আগেও তাদের পদস্পর্শে বাংলার মাটি ধন্য হয়েছে। তাঁরা কেউ মুসলমান ছিলেন, কেউ হিন্দু। কিন্তু ওই হিন্দুত্ব আর মুসলমানিত্ব নিয়ে নিজেদের আলাদা সমাজের বাসিন্দা বানাতেন না। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও মহাত্মা গান্ধীÑনেহরুরা ১৯৪৭ সালে বাংলা মায়ের হৃদয়টাকে দু’টুকরা করেছিলেন সত্য কিন্তু তাদের শাণিত কৃপাণ অমিয় মাসিমাদের (অমিয়বালা দত্ত) হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। এই যেমন এখনও আমি ছুটে যাই কলকাতায় আমার পিতার (মরহুম) কর্মস্থল ভবানীপুর জগুবাজার মসজিদে, নামাজ পড়ি, দোয়া করি, একই সঙ্গে লেক টাউনে মাসিমার সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁর মমতার স্পর্শ নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। ঠিক তেমনি আমার বন্ধু প্রিয়ও তার পূর্বপুরুষের একটু স্পর্শ একটু উত্তাপ পেতে ছুটে আসে বাংলাদেশে, কখনও ছুটে যায় জন্মভিটা দেইচর দত্তবাড়ি। যদিও সে বাড়িতে আজ আর দত্তদের কেউ থাকে না। তবুও একটা অদৃশ্য টান উপভোগ করে আবার ফিরে যায় কলকাতায়। সেকালে পাগলার খাল এবং খালের দু’ধারে পাগলার বিল (নিচু জমি) কেন্দ্র করে পশ্চিমপাড়ে দেইচর আর পূর্বপাড়ে কৃষ্ণপুর-বালিথুবাকেন্দ্রিক যে সমাজ গড়ে উঠেছিল তাতে হিন্দু-মুসলিম যার যার ধর্ম সে সে নির্ভয়ে পালন করেছে এবং তারপর জাতিভেদের উর্ধে উঠে ভাই-বন্ধু-সখা-সখীর মতো একে অপরকে ভালবেসেছে, দুর্যোগে মন্বন্তরে পাশে দাঁড়িয়েছে, সুখ-দুঃখ সমান ভাগ করে পথ চলেছে। তখন সমাজটাই ছিল ওরকম। হিন্দু হোক মুসলিম হোক প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিয়েশাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন, কাজ করতেন। হিন্দুর জন্য হিন্দুস্তান, মুসলমানের জন্যে পাকিস্তানÑ যেদিন এভাবে ভাগাভাগি হলো সেদিন থেকেই মানুষগুলোর মনটা ভেঙ্গে গেল। চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু তাড়িয়ে জমি দখল কিংবা ভারত থেকে মুসলমান তাড়িয়ে তাদের জমি-ব্যবসা দখল করে এসব হীন উদ্দেশ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে মানুষের সম্প্রীতির বন্ধন ভেঙ্গে দিল। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন হলো। মানুষ হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে গেল, বাঙালী থাকল খুব কমই। নাম হলো বাংলাদেশী হিন্দু বা ভারতীয় মুসলমান। অথচ একদিন ছিল একই দীঘির একপাড়ের ঘাটে মিয়াবাড়ির গৃহিণী যেমন সকালে ঘড়া (মাটির কলসি) ভরে ‘পানি’ নিয়েছে, তেমনি অপরপাড়ের ঘাটলায় দত্ত-ঠাকুরদের কুলবধূ কলসি (পিতলের) ভরে ‘জল’ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। একজন ভরতেন ‘পানি’ অপরজন ‘জল’ কিন্তু এর রঙ-রূপ কোনদিন পাল্টায়নি কিংবা দীঘিটিও কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না তুলে বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী জল-পানি সরবরাহ করেছে। পাগলার খালটা ছিল অনেক চওড়া, ছোটখাটো নদীর মতো। বড় বড় পণ্যবাহী মহাজনী নৌকা চলত। এর পূর্বপাড়ে আমাদের বাড়ি। গভীর রাতে মুরশিদী বা কীর্তন গাইতে গাইতে মাঝিরা এক মোকাম থেকে আরেক মোকামে পণ্য পরিবহন করত। পশ্চিমপাড়ে ছিল কালীবাড়ি। এখানে শিবমন্দির এবং কালীমন্দির ছিল। ছেলেবেলায় আমাদের আকর্ষণ ছিল কালীবাড়ির চৈত্রসংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখের মেলা। আমরা মেলা থেকে ঘুড়ি-নাটাই, ফুটবল কেনা এবং কদমা-মুরলী-সন্দেশ খাবার জন্যে সারাবছর পয়সা জমাতাম। আজ আর সেই মেলা হয় না, সেই মন্দিরও নেই, দুই মন্দিরের গা ঘেঁষে যে বিশাল দু’টি বটগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল সেগুলোও নেই। দিনে দিনে মানুষের উনুনের পেট ভরিয়ে ভরিয়ে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ওই দুই বটগাছের ভূতেরাও কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। ভূত আছে কী নেই জানি না, তবে বড় ভাইয়েরা কতদিন দেখেছে গভীর রাতে ভূতেরা বটের সুউচ্চ ডালে পাশাপাশি বসে লম্বা চুল পিঠে ছড়িয়ে খোশগল্প করছে বা একে অপরের মাথায় সিঁথি কাটছে, উকুন বাছছে, বেণি করে দিচ্ছে। সন্ধ্যা বাতির সময়ও অনেকে দেখেছে। ভাগ্যিস ভূতদের ছায়া নেই, কারণ তারা মাটির তৈরি নয়, নইলে নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় গায়ে ছায়া পড়লে নির্ঘাত ভস্ম হয়ে যেতে হতো। ছেলেবেলায় ওই বটগাছের নিচ দিয়ে যেতে গা ছমছম করে উঠত। ভরদুপুরে, সন্ধ্যা বাতির সময় এবং গভীর রাতে বটগাছের নিচ দিয়ে যেতে হলে আমরা দল বেঁধে অথবা এক দৌড়ে পার হতাম। আজ আমাদের সেই ছোটবেলাও নেই, সেই কালীবাড়িও নেই। আছে সেই মধুর স্মৃতিগুলো। মনে পড়ে পয়লা বৈশাখের ভোরে সূর্য ওঠার আগেই আশপাশের বাড়ির হিন্দু নারীরা পুজোর থালা হাতে কালীবাড়ি আসতেন। পুজো সেরে হাতা-বেড়ি খুন্তি-কুড়াল নানান গেরস্তালি জিনিসপত্র ক্রয় করে বাড়ি ফিরতেন। মাসিমাকে দেখতাম লাল পেড়ে গরদের শাড়ি পরে কপালে লাল টিপ পরে বাড়ি থেকে অন্যান্য মহিলাসহ ক্ষেতের আল দিয়ে কালীবাড়িতে আসতেন, হাতে থাকত পুজোর থালা। এরপর যখনই ও বাড়ি গেছি সন্দেশ, নাড়ু না খেয়ে আসতে পারিনি। অথচ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষ যখন পাকিস্তানী মিলিটারি হায়েনাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকত তখনও মাসিমার মধ্যে ভয়-ভীতিহীন এক বঙ্গনারীর শাশ্বত রূপ দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে যত রাত ওই বাড়ির পাশ দিয়ে গেছি একবারও তাঁর সঙ্গে দেখা না করে যাইনি। গেলে নতুন করে রান্না করে খাইয়ে তবে ছাড়তেন। আমাদের সঙ্গে অনেক অস্ত্র থাকত, মনে হয়েছে আমাদের অস্ত্র দেখে তিনি খুশি হতেন। একবার সম্ভবত আমরা বারোজন সশস্ত্র অবস্থায় তাদের বাড়ি যাই। আমি অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখতে সহযোদ্ধাদের বলিÑ দেখে হয়ত কেউ ভয় পেতে পারে। কেউ কেউ ভয় পেয়েও ছিল। কিন্তু না, মাসিমা ছিলেন নির্বিকার, এতটুকুও ভীতির চিহ্ন তার চেহারায় ছিল না। বরং তিনি দ্রুত মুড়ি-গুড় নিয়ে এসে আমাদের খেতে দিলেন। চা করে খাওয়ালেন। স্বাধীনতার পর সম্ভবত ১৯৭৩ সালে অসুস্থ স্বামী ও দুই কন্যা জ্যোৎ¯œা ও মায়াকে নিয়ে আগরতলায় যান তাঁর বড়লোক ভাইয়ের বাড়িতে। চিকিৎসা চলতে চলতে একদিন স্বামী রবীন্দ্র দত্ত প্রয়াত হন। প্রিয় স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালেই আগরতলায় গিয়ে বীরবিক্রম কলেজে ভর্তি হয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোটখাটো কাজ করে মা-বোনকে নিয়ে আলাদা বাসায় চলে যায়। তারপর একদিন আইনের ডিগ্রী নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করে এবং লেক টাউনে জমি কিনে বাড়ি করে মা-বোনদের নিয়ে এখানেই স্থায়ীভাবে সেটেলড করেছে। স্বামীকে হারাবার পর প্রথম যখন কলকাতায় দেখি চেহারায় বলা যায় ধবধবে সাদা শাড়িতে তাঁকে আরও বেশি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হতো। এতটুকু পরিবর্তন, বদলেছে কেবল তাঁর খাওয়া-দাওয়া কাপড়-চোপড়। মানুষটা সে রকমই রয়ে গেছেন। তখনও ডাইনিং টেবিলে তাঁর ছেলের বউ ভবানী খাবার পরিবেশন করতে এলে তাঁর মন ভরত না, নিজে এসে পরিবেশন করতেন। ভবানী বর্তমানে কলকাতা মাওলানা আজাদ (সাবেক ইসলামিয়া কলেজ) কলেজের ইংরেজীর প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান। শুনেছি মাসিমা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেয়া হলে দু’দিন নিবিড় পরিচর্যায় রাখার পর না ফেরার দেশে চলে যান। তার চলে যাওয়াটা প্রিয়লাল দত্ত, তার দুই বোন ও অন্যদের জন্য মাথার ওপরের ছায়াটা চলে যাওয়া; আর আমার কাছে একজন মমতাময়ী নারীর অনুপস্থিতি। ঢাকা, ২ এপ্রিল ২০১৫ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
×