ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জিজ্ঞাসাবাদে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল জানায়, তারা ‘সিøপার সেলের’ সদস্য ॥ সেল নেতা মাসুমকে খুঁজছে গোয়েন্দারা

ব্লগার ওয়াশিকুরকে খুনের পরিকল্পনা করা হয় দুই মাস আগে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২ এপ্রিল ২০১৫

ব্লগার ওয়াশিকুরকে খুনের পরিকল্পনা করা হয় দুই মাস আগে

শংকর কুমার দে ॥ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু খুনের সময়ে হাতেনাতে আটক দুই মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে রিমান্ডে আনার পর জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, জঙ্গী সংগঠন ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের’, ‘সিøপার সেলের’ সদস্য তারা। ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে কাজ করে সিøপার সেলের সদস্যরা। ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য হুজুরের নির্দেশে প্রায় দুই মাস আগে খুনের পরিকল্পনা করা হয় ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা জসিম উদ্দিন রাহমানির ভক্ত আটক দুই খুনী। এই খুনের মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি)। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেই দুই হিজড়া ও রফিক নামের ড্রাইভারসহ যারা দুই খুনীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে তাদের পুরস্কৃত করা হতে পারে, তারা খুনের প্রত্যক্ষদর্শীও। সিøপার সেলের দলনেতা মাছুমকে গ্রেফতার করা গেলেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামক জঙ্গী গোষ্ঠীটির শিকড় কত গভীরে তা খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে করছে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানান, আটক দুই মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ, আরিফ ও পলাতক তাহের, মাছুম ও সাইফুল থাকতো যাত্রাবাড়ীর একটি মেসে। এর মধ্যে সাইফুল কিছুদিন আগে আগ্নেয়াস্ত্র ও চাপাতিসহ যাত্রাবাড়ী এলাকার এক পুলিশের চেকপোস্টে ধরা পড়ে কারাগারে আটক আছে। আটক জিকরুল্লাহ জেএমবির সদস্য হয়ে নরসিংদী এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়ার কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে খুন করেছে ওয়াশিকুরকে। আর খুনী চক্রের দলনেতা হচ্ছে মাছুম। মাছুম কার নির্দেশে কিভাবে খুনের পরিকল্পনা করেছে এবং খুনী চক্রের সদস্যকে কিভাবে খুনে ব্যবহৃত করেছে তার ক্লু খুঁজে পাওয়া যাবে। মাছুম ও তাহেরের সন্ধানে হন্যে হয়ে খুঁজছে গোয়েন্দারা। পুরস্কৃত হতে পারে হিজড়া, রফিকসহ অন্যরা ॥ প্রকাশ্য দিবালোকে ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে সরাসরি হত্যা করে তাহের, জিকরুল্লাহ ও আরিফ মানুষজনকে ‘ডাকাত-ডাকাত’ করে দৌড়ে পালাচ্ছিল। এ সময়ে খুনীদেরও উচ্চস্বরে ‘ডাকাতা- ডাকাত’ বলে পিছু নিয়ে দোকানে বসে থাকা রফিক নামের এক ড্রাইভার। সামান্য এগুনোর পর দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করা খুনীদের সামনে পড়ে হেঁটে যেতে থাকা এক দল হিজড়া। এর মধ্যে দুই হিজড়া দুই খুনীকে জাপটে ধরে ফেলে। এতক্ষণে পেছনে থাকা রফিক ও তার সঙ্গে জনতা চলে এসে ঘিরে ফেলে খুনীদের। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসে ঘটনাস্থলের অদূরে কর্তব্যরত থাকা টহল পুলিশ দল। খুনীরা এতদিন খুন করে পালিয়ে গেলেও হাতেনাতে ধরে ফেলার ঘটনা এই প্রথম। এ জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা খুনীদের ধরে ফেলেছে তাদের পুরস্কৃত করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে সাহস নিয়ে খুনীসহ অপরাধীদের ধরে ফেলার উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। পুরস্কৃত করার নামের তালিকায় হিজড়ারা ছাড়াও রফিকসহ অন্যরা, খুনের প্রত্যক্ষদর্শীও হবেন পুরস্কৃতরা। মামলার তদন্তভার ডিবিতে ॥ ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার তদন্তভার হস্তান্তর করা হয়েছে ডিবিতে। বুধবার মামলার তদন্তভার ডিবিতে হস্তান্তর করার কথা জানিয়েছেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মিজানুর রহমান। সোমবার রাজধানীর দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে নিজের বাসার কাছে জঙ্গী হামলার শিকার হয়ে খুন হন ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্মী ওয়াশিকুর, একমাস আগে ব্লগার ও লেখক অভিজিত রায় হত্যারও প্রতিবাদে ফেসবুকে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। তিন জঙ্গীর চাপাতির আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান ওয়াশিকুর। পালানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়ে দুই মাদ্রাসা ছাত্র, যাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। ওয়াশিকুরের ভগ্নিপতি মনির হোসেন মাসুদ আটক দুইজনসহ মোট চারজনকে আসামি করে এই হত্যা মামলা দায়ের করেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়। যা বলেছেন ডিএমপি মুখপাত্র ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম মঙ্গলবার এক অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, জনতার হাতে আটক জিকরুল্লাহ ও আরিফুল হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, তারা নিজেরা ব্লগ বা ফেসবুক সম্পর্কে কিছু জানে না। ধর্মীয় মতাদর্শগত বিরোধের জের ধরে নির্দেশিত হয়ে এই হত্যায় অংশ নিয়েছে তারা। তাদের বোঝানো হয়েছে, এটা তাদের ঈমানী দায়িত্ব। তিনি জানান, গ্রেফতার দুজনের মধ্যে একজন এর আগে নরসিংদীতে জেএমবি কর্মী হিসেবে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিল। ওই দুইজনকে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযানও চালিয়েছেন। মাসুম নামে একজনের নির্দেশে তারা এই হত্যাকা- ঘটায়। তাদের সঙ্গে আবু তাহের নামে আরেকজন ওই হামলায় অংশ নেয়। খুনের ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে ওই দুই হামলাকারীকে ধরতে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের পুলিশের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানান ডিএমপির মুখপাত্র। আটক দুইজনের তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে ॥ ওয়াশিকুর হত্যাকা-ের সময়ে হাতেনাতে আটক জিকরুল্লাহ নিজেকে হেফাজত প্রধান চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসার ছাত্র বলে দাবি করেছেন। তবে হেফাজত নেতা শাহ আহমদ শফী পরিচালিত ওই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ওই নামে তাদের কোন শিক্ষার্থী নেই। জিকরুল্লাহ ও আরিফ হাতেনাতে আটক হওয়ার সময়ে যেসব তথ্য দিয়েছে এবং রিমান্ডে আনার পর যেসব তথ্য দিচ্ছে তার মধ্যে তারা তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করছে কিনা কিংবা গড়মিল তথ্য পাওয়া গেলেই তা যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। সিøপার সেলের সদস্যরা যেভাবে কাজ করে ॥ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা ছোট ছোট দলে সিøপার সেল তৈরি করে কাট আউট পদ্ধতিতে কাজ করছে। অর্থাৎ একটি দল ধরা পড়লেও আরেক দল সম্পর্কে যাতে কোন তথ্য প্রকাশ না পায় সে জন্য করা হয়েছে ‘সিøপার সেল’ ও ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে কাজ করে। খুনের পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতাদের আড়ালে রাখতেই এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সংগঠনটি। এতে খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত কিলার গ্রুপের কোন সদস্য ধরা পড়লেও তাদের বাইরে অন্য কারও নাম-ধাম জানতে পারবে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৩ থেকে ৭ জনকে দিয়ে এ সিøপার সেল তৈরি করা হয়। এক সেলের খবর আরেক সেল কখনই জানতে পারে না। সিøপার সেলের সদস্যরা কোন ব্যক্তিকে হামলার টার্গেট করলে প্রথমে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। এ পদ্ধতিতেই ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়। অভিজিত রায় হত্যাকা-েও সিøপার সেল ও কাট-আউট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় বলে সন্দেহ পুলিশের। ওয়াশিকুর রহমান হত্যাকা-ে সিøপার সেলের কাট আউট পদ্ধতির যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত চলছে।
×