ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাপস মজুমদার

বৃষ্টিবিহীন

প্রকাশিত: ০৬:১২, ৩১ মার্চ ২০১৫

বৃষ্টিবিহীন

মধুমাস চলমান। তবে তার আগে বলে নেই যে, বাংলাদেশে বিশেষ করে পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে দেখা যায়, মধুমাস নিয়ে একটা বিভ্রান্তি চলছে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ ও আষাঢ়ের আগমনে যখন রাজধানীর হাট-বাজারসহ প্রায় সর্বত্র সয়লাব হয়ে যায় আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু-তরমুজ-বাঙ্গি ইত্যাকার রসালো ফলফলাদিতে, তখন প্রায়ই দেখা যায় যে, প্রতিবেদন বা ফিচার লেখা হচ্ছে, মধুমাসে মধুফলে বাজার উপচে পড়ছে। মূলত এটি একটি সাংঘাতিক ভুল প্রয়োগ অথবা বলা যায় অপপ্রয়োগ, যা চলে আসছে দীর্ঘকাল থেকে। বেশ কয়েকবার একে সংশোধনের চেষ্টা যে করা হয়নি তা নয়। তবে কোন অজ্ঞাত কারণে ভুলটি থেকেই যাচ্ছে এবং চলছেও ক্রমাগত। এরকম কত যে ভুল আমরা প্রতিনিয়ত করে চলেছি দৈনন্দিন ও জাতীয় জীবনে, কে জানে! যাক ভুলের কেচ্ছা বাদ দিয়ে প্রবেশ করি মধুমাসে। মধুমাস মানে বসন্ত, বসন্তকাল বা ঋতু, আরও সঠিক অর্থে চৈত্র মাস। মধ্যযুগে বিশেষ করে বৈষ্ণব কাব্য-সাহিত্যে মধুমাসের বিস্তর প্রয়োগ আছে। যেমন, বৃন্দাবনের এক বন মধুবন। মধুস্বর মানে কোকিলকণ্ঠি বা কণ্ঠ। অনুরূপ মধুমাধবÑচৈত্র ও বৈশাখ মাস। মধুনিশি, মধুযামিনী, মধুরাতি। মধুপুরিÑমথুরানগরী। সর্বশেষ মধুৎসব মানে বসন্তোৎসব। নগরজীবনে প্রায়ই অনেকে হাহাকার করে বলেন যে, হায়, ইট-কাঠ-পাথর-কংক্রিট-ইস্পাতের মৃত্যুপুরিতে আজকাল আর কোকিলের কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায় না। তথ্যটি ভুল। আমরা প্রায় প্রতিদিনই অফিসে আসা-যাওয়ার পথে বিশেষ করে রমনা পার্ক, মিন্টো রোড দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পাই সুরেলা কোকিলকণ্ঠ। ভয়ঙ্কর যানজট ও অসহ্য গরমে মিনিবাসের ভিতরে বসে ঘামতে ঘামতে হাঁসফাঁস অবস্থায়ও সত্যি বলতে কি, বেশ লাগে শুনতে কোকিলের পরিত্রাহি চিৎকার। তীব্র তীক্ষè আর্তনাদ। চাইকি সুযোগ পেলে পেট্রোলবোমা-ককটেলের ভয়ে বন্ধ জানালার আনাচে-কানাচে চোখ মেলে সকাতর এক পলক দেখারও প্রাণান্তকর চেষ্টা করি, হায়, কোথায় সংগোপনে লুকিয়ে আছে নগরজীবনের জন্য প্রায় দুর্লভ দর্শন সেই অধরা অদৃশ্য কোকিল! জনান্তিকে আরও একটি কথা বলে রাখি, মনে রাখবেন কোকিল কিন্তু শুধু বসন্তকালেই ডাকে না, অন্য সব ঋতুতেও ডাকে বৈকি; তা সে কাব্য ও সঙ্গীত প্রয়োগে যা-ই বলা হোক না কেন। মেটিং কল বিধায় বসন্তকালে প্রয়োজনের সময় বেশি ডাকে বলে ভাববেন না যেন অন্য সময় কোকিলরা মৌনব্রত অবলম্বন করে থাকে। পাঠক হয়ত ভাবছেন যে, মধুমাস, বসন্ত, কোকিল ইত্যাদি নিয়ে অযথা কচকচি করছি কেন? সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে চাই বিষয়টি। এবার নগরজীবনে বসন্ত কি আদৌ সে রকম অনুভূত হয়েছে? সত্যি বলতে কি শীতও তো এবার পড়েনি তেমন। দু’চারদিন হাল্কা কুয়াশামাখা শীত অনুভূত হলেও ঠা-া আচমকা উধাও হয়েছে নগরজীবন থেকে। কনকনে ঠা-া শন্শনে বাতাস বলতে যা বোঝায়, তা আর তেমন লাগল কই? শীতের পোশাক পরার মওকাও তেমন মিলল না। তবে শীতের লাগোয়া বসন্ত যৎসামান্য হলেও চোখে পড়েছে ভ্যালেনটাইন্স ডে তথা ভালবাসা দিবস এবং এর পাশাপাশি পয়লা ফাল্গুনের আগমনে। সে সময়ে নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে এ দুটো উৎসবকে পালন করতে দেখা গেছে মহাসমারোহে। এ প্রসঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ছাব্বিশে মার্চের স্বাধীনতা দিবসের রাশি রাশি অনুষ্ঠান-উৎসবকেও আমরা অবশ্যিই ভুলে যাচ্ছি না। হ্যাঁ, বাস্তবেই এসব উৎসব-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়েও নগরজীবনে অনুভূত হয় বসন্ত উৎসব। এটুকুই যা আনন্দ ও অনুপ্রেরণার। এই যখন সার্বিক অবস্থা তখন একটি আশঙ্কার বাণীও আমাদের শুনাচ্ছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ভূগোলবিদ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। তারা আবহাওয়া ও জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি ও রেকর্ড বিচার বিশ্লেষণ করে বলছেন যে, বর্তমানে পৃথিবীতে ক্রমশ সংক্ষিপ্ত হচ্ছে বসন্তকাল। কমছে শৈত্যপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত ও কালবৈশাখী। তারা এর একাধিক কারণও দেখিয়েছেন। তবে প্রধানত দায়ী করেছেন অয়নচলনকে। সে ক্ষেত্রে অয়নচলনের ব্যাপারটিকে একটু বুঝে নেয়া দরকার। আমরা জানি, সূর্য থেকে পৃথিবীর নিকটতম ও দূরতম অবস্থানের ওপর ভিত্তি করেই পৃথিবীর গতি ও কাত হওয়ার মতো ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথ বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। তদুপরি গ্রহটি সূর্য থেকে সব সময় সমান দূরত্বেও অবস্থান করে না। জানুয়ারির শুরুতেই পৃথিবী নিজ কক্ষপথে সূর্য থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বে এবং জুলাইয়ের প্রথম দিকে সবচেয়ে বেশি দূরত্বে অবস্থান করে থাকে। কম দূরত্বে পৃথিবীর গতি বেশি এবং বেশি দূরত্বে ধীরগতি। গতির এই হ্রাস-বৃদ্ধি পৃথিবীর ঋতুগুলোর সময়কালকে প্রভাবিত করে থাকে। পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ২৩ দশমিক ৫ ডিগ্রী ঢালু বা কাত হয়ে চক্রমণের কারণেই প্রধানত ঘটে থাকে ঋতুর পরিবর্তন। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধ পর্যায়ক্রমে ছয় মাস করে হেলে থাকে সূর্যের দিকে। সে ক্ষেত্রে পৃথিবীর অক্ষ নিজেই স্থান পরিবর্তন করে, অনেকটা কম্পনশীল শীর্ষের মতো, যার নাম অয়নচলন। যার ফলে সূর্যের বিষুবরেখা অতিক্রমণের সময় প্রতিবছর কিছুটা এগিয়ে আসে। গ্রীষ্মকালে নিরক্ষ রেখা থেকে সূর্যের দূরতম স্থানে অবস্থানকালে শেষ হয় বসন্ত। আর অয়নচলনের কারণে পৃথিবী নিজের কক্ষপথে যে বিন্দুতে পৌঁছায় তা সামান্য সরে যায়। পরবর্তী বছরে পৃথিবী সেই একই বিন্দুতে কিছুটা আগে পৌঁছে যাবে। সে ক্ষেত্রে বসন্ত শেষ হবে আর গ্রীষ্ম শুরু হবে আগের বছরের তুলনায় একটু আগে। আবহাওয়া ও ভূবিজ্ঞানীরা হিসাব করে কত বছর পর বসন্তকাল কতটা বা কদিন কম হবে, তাও বের করেছেন। তাঁরা বলছেন, প্রতিবছর বসন্তের স্থায়িত্ব কমে যোগ হচ্ছে গ্রীষ্মের সঙ্গে। আপাতত বসন্তকালের ব্যাপ্তি প্রতিবছর ত্রিশ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট করে কমছে। প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রয়েছে কয়েক হাজার বছর ধরে। সাধে কি বিশ্বকবি আক্ষেপ করে বলেছেন, মরি হায় বসন্তের দিন চলে যায়... আবহাওয়া ও ঋতু পরিবর্তন তথা হ্রাস-বৃদ্ধির আরও নানা কারণ ও উপসর্গ রয়েছে। বহুকথিত গ্রীনহাউস গ্যাস, বন ধ্বংস, কার্বন নিঃসরণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বাঁধ নির্মাণ, এল নিনো, লা নিনা, পারমাণবিক বিস্ফোরণ, ব্যাপক বোমাবাজি ও যুদ্ধবিগ্রহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মেরু ও মরুকরণ প্রক্রিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বরফগলন, হিমালয়-আল্পস ইত্যাদিতে তুষারগলন, হিমবাহের চালচলন সর্বোপরি ওজোন হোল বৃদ্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি। মোট কথা, মহাজাগতিক নানা কর্মকা-ের পাশাপাশি মানুষের সীমাহীন গাফিলতি তথা আত্মধ্বংসী ও বিধ্বংসী অপতৎপরতা। বসন্তের আর দোষ কী? তবুও ঠিক কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু আশা-ভরসা বেঁচে থাকে শেষ পর্যন্ত। শুরুতেই তো বলেছি, নগরজীবনেও ঠিকই কোকিল ডাকেÑরমনা পার্কে কিংবা অন্য কোথাও। পঞ্চাশ-ষাট দশকে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। সর্বস্তরের মানুষ লুফে নিয়েছিল লাইনটি। তবে বাস্তবেও কিন্তু ফুল ফোটে শহরে, নগরে, বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জে ও সর্বত্র। প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে ফুলকে ঘিরে। এই ফুলই অপরূপ শোভায় শোভিত হয়ে ওঠে তন্বী নারীর খোঁপায়, ব্রীড়াবনত বধূর কানে ও কণ্ঠে, শিশু-কিশোরের করপুটে, শহীদানের স্মরণে, স্বর্গতদের স্মৃতিতর্পণে। ফুল তার আপন নিয়ম, স্বভাব ও মহিমায়ই ফুটে থাকে প্রতিনিয়ত। যে বা যাদের দেখার চোখ আছে, তারা ঠিকই দেখেন এর অপার সৌন্দর্য ও অপরূপ গরিমা। তবুও কেন জানি মনে হচ্ছে, এবারের বসন্ত যেন কেমন একটু রুখু রুখু। বড় বেশি শুকনো ও বৃষ্টিহীন। পেট্রোলবোমা ও ককটেলে ক্ষত-বিক্ষত। মানুষের আর্তনাদ ও হাহাকারে ভরপুর। এরকম এক দুঃসময়ে সংক্ষিপ্ত বসন্ত শেষে অনিবার্য আসছে হে নিদাঘ বৈশাখ। হে রুদ্র বৈশাখ। বসন্তের পর খরতপ্ত গ্রীষ্মকাল। সেটাও কি হবে প্রলম্বিত, বৃষ্টিহীন!
×