ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্রিটিশ আমলে তৈরি ॥ সংস্কার বা পুনর্নির্মাণের প্রকল্প নিলেও বছরের পর বছর ফাইলবন্দী

ঝুঁকিপূর্ণ ৩২৭ রেল সেতু দিয়ে চলছে ট্রেন ॥ যে কোন সময় বড় দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৩০ মার্চ ২০১৫

ঝুঁকিপূর্ণ ৩২৭ রেল সেতু দিয়ে চলছে ট্রেন ॥ যে কোন সময় বড় দুর্ঘটনা

মশিউর রহমান খান ॥ সারাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু দিয়ে চলছে ৩৩৯ যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন। বছরের পর বছর সেতুগুলোর সংস্কার না করার কারণে ৩ হাজার ৩৮০ ছোট-বড় সেতুর মধ্যে বর্তমানে ৩২৭ সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সংস্কারের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এ সেতুগুলো দিয়ে ট্রেন চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। বর্তমানে দেশের ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে ৪৭৭ বড় সেতু (৬০ ফুট বা তার বেশি) এবং ছোট সেতু রয়েছে ২ হাজার ৯০৩। তবে এ সব সেতুর অধিকাংশেরই নির্মাণকাল ব্রিটিশ আমলে হওয়ায় সেতুগুলোর বয়স বর্তমানে ৮০-১০০ বছর। বেশিরভাগ সেতু নির্মাণ করা হয় ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে। সেতুগুলো নির্মাণের পর স্বাধীনতার আগ থেকে পর পর্যন্ত কোন সরকারই এ সব সেতু সংস্কার বা নির্মাণের বড় আকারের কোন উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু রেল কর্তৃপক্ষ ট্রেনচালকদের এ সব ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন পরিচালনার কথা থাকলেও শুধুমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ট্রেন চালকগণ ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার গতিতে এ সব সেতু পার করেন। রেলের এ সব ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর সংস্কার বা কোন কোন সেতু পুনঃনির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্প হাতে নিলেও বছরের পর বছর ধরে ফাইল বন্দী হয়ে পড়ে থাকে। সেতু নির্মাণের বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষ উদাসীন। রেল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, গত দুই দশক ধরে এ সব সেতু সংস্কার না করায় অতিবৃষ্টি বা প্রবল বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো ভেসে বা দেবে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ার পাশাপাশি ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ এ সব সেতুতে ট্রেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে হয়। ফলে চলাচলের জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। এর ফলে প্রতিদিনই সিডিউল বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। যাত্রাপথে যাত্রীদের হয়রানী হতে হচ্ছে। তাছাড়া ট্রেন সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না বিধায় যাত্রীদের মূল্যবান লক্ষ লক্ষ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, পাশপাশি কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রেলওয়ে। যার প্রভাব সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে পড়ছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে রেলওয়ের মোট ৩ হাজার ৩৮০ সেতুর মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে ৩২৭ সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৭৭ বড় সেতু (যেগুলোর দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট বা তার বেশি) ঝুঁকিপূর্ণ। ছোট সেতু ২৫০ ঝুঁকিপূর্ণ। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতুগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ২২ বড় ও ৭৬ ছোট সেতু ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ভৈরব-নরসিংদী অংশে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৪ বড় ও ২৪ ছোট সেতু, ভৈরব-আঠারবাড়ি অংশে ১টি বড় ও ১৭ মাইনর, টঙ্গী-নরসিংদী অংশে দু’টি বড় ও ১৯ ছোট, টঙ্গী-শ্রীপুর অংশে ৪ বড় ও ৩৯ মাইনর, শ্রীপুর-ময়মনসিংহ অংশে ৭ ছোট, আঠারবাড়ি-ময়মনসিংহ অংশে একটি বড় ও ১০ ছোট এবং ময়মনসিংহ-গৌরীপুর অংশে দু’টি বড় ও ৮ ছোট সেতু ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম সিলেট রুটে ৪৩ বড় ও ৫২ বড় সেতু ঝুঁকিপূর্ণ। রেল কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর দেশের কোন কোন রেলসেতু ঝুঁকিপূর্ণ তা চিহ্নিত করতে বিশেষ জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন করে। তবে জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে গত কয়েকবছরেও কোন সেতু সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নেয়নি। রেলসেতুর প্রায় সবগুলোই ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়ায় বর্তমানে এ সব সেতু অনেকটা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সেতুগুলোর প্রায় সবগুলোই ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি। সে সময় মজবুত সেতু নির্মাণে সিমেন্টের ব্যবহারের প্রচলন না থাকায় সব গাঁথুনি করা হয় চুন সুরকির সাহায্যে। ফলে তখনকার সেতুগুলো তেমন মজবুত ও যুগোপযোগী নয়। ঝুঁকিপূর্ণ এ সব সেতুর বড় একটি অংশ বর্তমানে নড়বড়ে। তবে সেতুগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই। এ সব সেতুতে লোকাল অথবা আন্তঃনগর ট্রেন চলার সময় গতি অত্যন্ত কমিয়ে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দেয়া রয়েছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে কোন সময় এ সব সেতুতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। গত দুই বছরে প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় কয়েকটি সেতু ভেসে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রেলসূত্র জানায়, ২০১০ সালে ১৩৮ কোটি ব্যয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে সেতুগুলো মেরামতের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। যেটি আজও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। গত দুই বছরে প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় কয়েকটি সেতু ভেসে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালে সীতাকু-ের ভাটিয়ারিতে একটি রেলসেতু ভেঙে যাওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল কয়েকদিন বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী এ সেতুটি মেরামত করে। এছাড়া ২০১৪ সালে বন্যায় চট্টগ্রামের কাছে আরেকটি রেলসেতুর একটি পিলার দেবে গিয়ে সেতটিু ভেঙ্গে যায়। যা মেরামত করতে কয়েক দিন সময় লেগে যায়। এতে করে রুটে যাতায়াতকারীদের মহাভোগান্তিতে পড়তে হয়। শত বছর আগের দুর্বল নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ এ সব রেলসেতু অতি দ্রুত সংস্কার বা পুনঃনির্মাণ করে গণপরিবহন হিসেবে ট্রেনের যাত্রীদের চলাচল স্বাভাবিক রাখা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মোঃ মুজিবুল হক বলেন, সারাদেশের ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ছোট বড় অনেকগুলো রেলসেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল বর্তমানে অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যেগুলো আমরা সমীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করেছি। দীর্ঘ বছর আগের তৈরি করা এ সব সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করায় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বা নানা প্রকৃতিক দুর্যোগের সময় দেশের অনেক স্থানে নানা দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। অনেক সময় সেতু ভেঙ্গে পড়ে বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ সব বিবেচনায় সারাদেশের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখতে অতি গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলোকে সংস্কার ও কোন কোন রেলসেতু পুনঃনির্মাণ করতে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে সারাদেশের সকল ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু নির্মাণ ও সংস্কার করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।
×