ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সিটি নির্বাচন বিএনপির মান বাঁচানোর একটা পথ করে দিল

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৯ মার্চ ২০১৫

সিটি নির্বাচন বিএনপির মান বাঁচানোর  একটা পথ করে দিল

উত্তম চক্রবর্তী ॥ ৮১ দিন পর রাজনীতির দমবন্ধকর গুমট আবহাওয়া কাটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নাশকতা-আতঙ্ক-উদ্বেগের বদলে রাজনীতিতে স্বস্তি ও শান্তির সুবাতাস ফিরে আসবেÑ এ ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ। ইতোমধ্যে নাশকতা ও সহিংস রাজনীতির বলি হয়ে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণ ঝরে গেলেও অনিশ্চিত পরিস্থিতি কাটিয়ে ফের স্বাভাবিক রূপে ফিরে ধীরে ধীরে নির্বাচনমুখী হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতি। তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনই রাজনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে নিয়ে আসার নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। টানা ৮১ দিন পর সহিংস হরতাল কর্মসূচী স্থগিত রেখে বিএনপি-জামায়াত জোটের তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণায় পাল্টে গেছে রাজনীতির দৃশ্যপট। বরফ গলতে শুরু করেছে রাজনৈতিক প্রধান দুই শিবিরে। অকার্যকর হরতাল-অবরোধ আর পেট্রোলবোমা দিয়ে ভয়াল-বীভৎস কায়দায় মানুষ হত্যার পথের পরিবর্তে নির্বাচনী মাঠে আসার বিএনপির ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে রাজনৈতিক বোদ্ধারাও। ইতোমধ্যে সরকার তরফ থেকেও বিএনপির নির্বাচনে আসার ঘোষণাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। এখন সব পক্ষই মনে করছে, বিএনপি ইতিবাচক ধারায় ফিরে এলে রাজনীতি আতঙ্কমুক্ত হবে, ফের দেশের রাজনীতি স্বাভাবিক পথেই হাঁটবে। দেশের প্রবীণ আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক উল হক তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়ায় বলেন, গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি ভুল করেছিল। কিন্তু এবার আর তারা সে ভুলটি করছে না। তারা (বিএনপি) ভুল বুঝতে পেরেছে। ভুল বুঝতে পেরেই বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বলেই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। বিএনপির নিখোঁজ যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের গুলশানস্থ বাসায় পরিবারের লোকজনকে সমবেদনা জানাতে এসে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বিএনপির সিটি নির্বাচনে অংশ নেয় ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও ১৪ দলের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত চলমান গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করেছে। তা না হলে বিএনপি গণতন্ত্রের পথ থেকেই হারিয়ে যেত। কারণ নির্বাচন ছাড়া একটি রাজনৈতিক দল বেঁচে থাকতে পারে না। দেশের সাধারণ মানুষকে হত্যা করে কোন আন্দোলনে যে বিজয় লাভ করা যায় না- এই বাস্তবতা হয়ত উপলব্ধি করেই বিএনপি নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন থেকেই বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী ক্রমেই সহিংসতা-নাশকতায় রূপ নেয়। গত ৮১ দিন ধরে চলা হরতাল-অবরোধে এ পর্যন্ত ঝরে গেছে দেড় শতাধিক নিরীহ মানুষের প্রাণ। যাদের অধিকাংশই ঘাতক পেট্রোলবোমার আগুনে অঙ্গার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। নারী-পুরুষ, শিশু, দিনমজুর, ড্রাইভার এমনকি অন্তঃসত্ত্বা মা রেহাই পাননি মানুষরূপী দানবদের অগ্নিবোমার হাত থেকে। দগ্ধ হয়ে জীবন গেছে নিরপরাধ মানুষের, পঙ্গুত্ববরণ করে বিভীষিকাময় জীবন-যাপন করতে হচ্ছে অনেককে। বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ অকার্যকর হয়ে পড়লেও চোরাগোপ্তা নিক্ষিপ্ত পেট্রোলবোমা গোটা দেশে এক মহাআতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। সে আতঙ্ক এখনও পুরোপুরি কাটেনি। একটানা ৮১ দিনের অবরোধ-হরতালের নামে সহিংসতা-নাশকতা ও বীভৎস কায়দায় মানুষ হত্যার বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিকে কার্যত প্রত্যাখ্যান করে দেশের মানুষ। সহিংসতা রাজনীতি আর দেশের জনগণকে জিম্মি করে সরকারকে সংলাপে বসতে বাধ্য করার বিএনপি জোটের কৌশলকে কোন পক্ষই কেউ-ই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। উল্টো সরকারপক্ষ বাধ্য হয়েই সহিংস-জঙ্গীবাদী রাজনীতির সঙ্গে কোন ধরনের আপোস না করার ঘোষণা দিয়ে শক্তহাতে নাশকতা দমনে মাঠে নামতে হয়েছে। ফলে সংলাপের দাবি সহিংস রাজনীতির ডামাডোলেই চাপা পড়ে যায়। প্রথম দিকে সঙ্কট সমাধানে কূটনৈতিক মহলও সংলাপের ব্যাপারে সোচ্চার হলেও পরবর্তীতে নিষ্ঠুর ও অমানবিক কায়দায় রাজনীতির নামে মানুষ হত্যার বিষয়টি মেনে নেয়নি। বরং উল্টো সহিংস রাজনীতির ব্যাপারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে। দুই নেত্রীর অনড় অবস্থানের কারণে সঙ্কট সমাধান সুদূরপরাহত হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দিনের পর দিন বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তাদের হরতাল-অবরোধ কার্যত মিডিয়ায় প্রকাশ পেলেও দেশের অধিকাংশস্থানেই তার কোন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। এমনকি বিএনপি-জামায়াতের ব্যবসায়িক নেতারাও হরতাল-অবরোধ না মেনে তাদের সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সচল রাখে। বিএনপির হাইকমান্ড এ বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করলেও ‘রাজনৈতিক পরাজয় ঘটবে’Ñ এ আশঙ্কায় অকার্যকর হরতাল-অবরোধ চালিয়ে গেলেও এ থেকে বের হওয়ার ‘এক্সিট রুট’ খুঁজতে থাকে। সরকারের কাছেও একটি সম্মানজনক ‘এক্সিট রুট’ দেয়ার ব্যাপারে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও গোপনে দেন-দরবার চালিয়েছে বলেও নানা সূত্র থেকে জানা গেছে। সূত্র জানায়, বিএনপিকে ‘এক্সিট রুট’ দিতেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের টার্মকার্ডটি খেলে। ঘোষণা করে তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরই রাজনীতির ভাগ্যাকাশে জমে ওঠা কালো মেঘ কাটতে শুরু করে। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি নেতারাও নেমে পড়ে নির্বাচনের মাঠে। হাইকমান্ডের নির্দেশে তিন সিটি কর্পোরেশনেই বিএনপির বাঘা বাঘা নেতা নির্বাচনী মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে গুলশানের কার্যালয়ে ৮১ দিন ধরে অবস্থান নেয়া বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ‘শত নাগরিক কমিটির’ ব্যানারে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা সাক্ষাত করতে গেলে তিনি নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দেন। বৈঠক শেষে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ হলে তাতে অংশ নেবে বিএনপি। তবে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সবার জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হলে তাতে অংশ নিতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন খালেদা জিয়া। বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। তিন সিটিতে নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। তবে তার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। হঠাৎ করেই বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত, আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্বাগত জানানোর ঘটনায় রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ধারণা, পুরোদমে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে গত ৮১ দিন ধরে চলা দমবদ্ধকর পরিবেশ আর থাকবে না। বিএনপিও সিটি নির্বাচনকে ‘এক্সিট রুট’ হিসেবে নিয়ে অকার্যকর হয়ে পড়া হরতাল-অবরোধের নামে ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সরে আসবে। দীর্ঘদিন ধরে চলা দেশের অস্বাভাবিক আতঙ্কের পরিবেশ কাটিয়ে শান্তি-স্বস্তির পরিবেশ ফিরে আসবে। আতঙ্কমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক হয়ে আসবে দেশের রাজনীতি। আর প্রকাশ্য না বললেও কোন দাবি আদায় ছাড়াই বিএনপির নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্তকে ‘রাজনৈতিক বিজয়’ হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা। বিএনপির ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে’র দাবি প্রসঙ্গে সরকারের খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। তবে ভাল মানুষের জন্য অবশ্যই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ হবে। সন্ত্রাসীদের জন্য এমন ফিল্ডের সুযোগ নেই। বিএনপি নির্বাচন করুক না না করুক, সন্ত্রাসী কর্মকা- করলে, বোমা মেরে মানুষ হত্যা করলে তার বিচার হবেই। বিএনপি নির্বাচনে আসবে এতে সাধুবাদ জানাই। তবে সন্ত্রাস করে নির্বাচন ভ-ল করার চেষ্টা বা নির্বাচনে হেরে গেলে মানবে না, নির্বাচন নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে, সন্ত্রাস করবে সে সুযোগ তাদের দেয়া হবে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনও বিএনপির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। আমরা চাই সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হোক। এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি সুষ্ঠু ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসবে এটাই আশা করছি। বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে চলমান নৈরাজ্য থেকে দেশ মুক্তি পাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
×