ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাবলিক পরীক্ষায় গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন!

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৬ মার্চ ২০১৫

পাবলিক পরীক্ষায় গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ পাবলিক পরীক্ষায় গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্নজুড়ে দেয়ার ঘটনার বিষয়ে কঠোর এ্যাকশন নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বলেছেন, তদন্ত করে প্রশ্ন প্রণয়নকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এসএসসি পরীক্ষার এ উদ্বেগজনক ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হলেও রহস্যজনক কারণে নীরব ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। অভিযোগ ওঠার পর এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত প্রশ্ন করার সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করতে কোন উদ্যোগই নেয়নি বোর্ড। চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতর পর্যন্ত সকলেই বলছেন, এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়। পরীক্ষা শেষ হলে বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নের পাণ্ডুলিপি এনে বের করা হবে প্রশ্ন প্রণয়ন কে বা কারা করেছেন। তারপর ব্যবস্থা। অনুসন্ধানে জনা গেছে, পাঠ্যবই নয় বরং গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেয়া হয়েছে চলতি বছরের এসএসসির একটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে। ইতোমধ্যেই প্রশ্নপত্রের সঙ্গে গাইড বইয়ের নমুনা প্রশ্নের পুরোপুরি মিল পাওয়ার অভিযোগও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে জমা পড়েছে। অভিভাবকরাও তুলেছেন অসংখ্য অভিযোগ। এছাড়া বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালও গণমাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে একই রকম অভিযোগ করেছেন। এর আগে তিনি বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধও লিখেছেন। গণমাধ্যমে পাঠানো চিঠিতে মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, ‘সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেয়ার একটি বিষয় ঘটতে শুরু করেছে। এক অর্থে এ বিষয়টি প্রশ্নফাঁস থেকেও গুরুতর। প্রশ্নফাঁস কারা করছে, সেটি ধরা সম্ভব না হতে পারে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারা কারা গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, সেটি বের করা সম্ভব।’ গণমাধ্যমকে বিষয়টির প্রতি নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলেছেন, বিষয়টি সকলের নজরে এনে সরকারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করার বিনীত অনুরোধ করছি। এদিক বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের ইংরেজী ভার্সনের প্রশ্ন ‘পাঞ্জেরী’ গাইড বই থেকে নেয়া হয়েছে। পাঠ্যবই বাদ দিয়ে বাজারে থাকা এ গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেন পদার্থবিজ্ঞানের ইংরেজী ভার্সনের প্রশ্ন প্রণয়নকারীরা। অথচ পাবলিক পরীক্ষাতো বটেই, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায়ও গাইড থেকে প্রশ্ন না করার বিরুদ্ধে সরকারী নির্দেশনা জারি করা আছে। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, মূল বই থেকে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে হবে। এ নির্দেশনা উপেক্ষা করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের এমপিও (বেতনের সরকারী অংশ) বাতিল করা হবে। সরকারী শিক্ষক হলে বিভাগী ব্যবস্থানসহ কঠোর আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলছিলেন, গাইড বই থেকে কীভাবে প্রশ্ন হয় সেটিই আগে অনুসন্ধান করতে হবে। সেই সঙ্গে এখনও সব শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বিষয়টি বুঝতে পারেননি। তার ওপর প্রশ্নপত্র তৈরিতে শিক্ষকদের সময় দেয়া হয় ২ থেকে ৪ দিনের মতো। ফলে অনেকেই ঝামেলা কমাতে গাইড বই থেকে প্রশ্ন করেন। তবে এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষক সমাজকে যেমন সচেতন হতে হবে। সেই সঙ্গে কর্তৃপক্ষকেও এসব বিষয়ে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। যোগ্য শিক্ষকদের দ্বারা প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ এম এ সাত্তার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছিলেন, এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে ভয়াবহ একটি নেতিবাচক ধারণা পৌঁছে গেছে। শিক্ষার্থীরা জানছে গাইড বই থেকে প্রশ্ন হয়। ফলে তারা পাঠ্যবই বাদ দিয়ে গাইড বইয়ের দিকে ঝুঁকবে। বিষয়টি ভয়াবহ। অবিলম্বে তদন্ত করে প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় শিক্ষার জন্য এটা হবে মারাত্মক ক্ষতির একটি কারন। বিষয়টিকে নিন্দনীয় বলে অভিহিত করলেন খোদ পাঞ্জেরীর স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান শায়কও। জনকণ্ঠকে তিনি বলছিলেন, অনেকদিন ধরেই বাজারে এ বইটি আছে। তবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কাজটি ঠিক করেননি। গাইডের প্রশ্ন হুবহু কোন শিক্ষক তুলে দিতে পারেন না। এখানে তাদের কোন দায় নেই বলে দাবি করেন কামরুল হাসান শায়ক। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সমালোচনার প্রেক্ষাপটেই বুধবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, হ্যাঁ বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এটা অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য ও উদ্বেগজনক কাজ। আমি দ্রুত তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব। তদন্ত করে দেখব কে বা কারা এটি করেছে। অবশ্যই এ বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশন নেয়া হবে। তবে মন্ত্রী কঠোর হলেও যে বোর্ডের ব্যর্থতার কারণে এ ঘটনা সেই ঢাকা বোর্ডে এ অভিযোগ এসেছে এক সপ্তাহেরও আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেননি কর্মকর্তারা। এখন পর্যন্ত প্রশ্ন করার সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করতে কোন উদ্যোগ নেয়নি বোর্ড কর্তৃপক্ষ। বোর্ড বলছে, এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়। চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ আবু বকর সিদ্দিক বলছিলেন, এখন এসএসসি পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষ হলে প্রশ্নের পা-ুলিপি এনে আমরা দেখব কে বা কাদের কারণে এটা হয়েছে। তারপর ব্যবস্থা। পরীক্ষা শেষ না হলে দায়ীদের চিহ্নিত করতে সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিটি বিষয়ে এবার ৮টি শিক্ষা বোর্ডের প্রতিটি থেকে ৪ সেট করে মোট ৩২ সেট প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছে। প্রশ্নপ্রণেতা শিক্ষকরা প্রশ্ন তৈরি করে মডারেটরের কাছে পাঠান। মডারেটর সেখান থেকে প্রশ্ন বাছাই করে লটারি করেন। লটারিতে যে সেটের প্রশ্ন ওঠে সে প্রশ্নই বিজি প্রেসে পাঠানো হয় ও সেখানে ছাপা শেষে পরীক্ষা কেন্দ্রে যায়। তাই তারা এখনই বলতে পারছেন না কোন শিক্ষক এই কাজটি করেছেন। হাতে লেখা মূল প্রশ্নপত্র এখন ঢাকার ট্রেজারিতে রাখা আছে। পরীক্ষা চলমান থাকায় এখন তা তারা দেখতে পারবেন না। উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকারও বলেছেন একই কথা। তবে তারা দুজনই বলছেন, অবশ্যই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে আগামী ২৮ মার্চ এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলেই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কমার চন্দ আগেই বলেছেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের চিঠির বিষয়টি আমি জেনেছি। তবে এর আগেই আমাদের কাছে এসএসসির পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষা পাঞ্জেরী গাইড বইয়ের নমুনা প্রশ্ন থেকে নেয়ার অভিযোগ এসেছে। এসএসসি পরীক্ষা শেষে যেসব বিষয় ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গাইড বই থেকে প্রশ্ন দেয়ার অভিযোগ এসেছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া পরীক্ষার পর এ বিষয় নিয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও চেয়ারম্যানদের একটি বৈঠকও হবে।
×