ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে আইপিএস ও ব্যাটারি ব্যবসায় ধস ॥ জেনারেটর ব্যবহারও হ্রাস

বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যাপক অগ্রগতি

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৬ মার্চ ২০১৫

বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যাপক অগ্রগতি

মহসিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশে বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যে আইপিএস ব্যবসায় ধস নেমেছে। উধাও হয়ে গেছে ব্যাটারি ব্যবসা। লোডশেডিং একেবারে নিম্নপর্যায়ে নেমে এসেছে। তবে লোকাল সরবরাহ লাইনে সমস্যায় মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের অনির্র্ধারিত লোডশেডিং রয়েছে কোথাও কোথাও। বিদ্যুত উৎপাদন ও বিতরণে বর্তমান সরকারের নজরকাড়া সাফল্যে প্রাক গ্রীষ্মে আইপিএস বিক্রির ধুমের পরিবর্তে বিক্রেতারা অলস বসে আছে। আইপিএস আমদানিকারক ও বিপণন কোম্পানিগুলোর বিক্রি কমেছে প্রায় ৮০ ভাগ। হ্রাস পেয়েছে জেনারেটর ব্যবসা। বিদ্যুত উৎপাদন ও বিতরণের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী আগামীতে এ ধরনের ব্যবসার ভবিষ্যতও সুখকর নয় বলে জানিয়েছেন আইপিএস বিপণনকারীরা। অনুসন্ধান নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামে ডজন ব্র্যান্ডের আইপিএস প্রতিষ্ঠান ছাড়াও স্থানীয় বহু প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যাপকহারে লোডশেডিংয়ের সময় বিদ্যুত সমস্যা নিরসনে আইপিএস বাজারজাত করা হতো। শীতের সময় আইপিএসের ব্যবহার কম। কারণ, বিদ্যুতের লোডশেডিং তখন সহনীয় পর্যায়ে থাকত। গ্রীষ্ম এবং গরমের সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বিদ্যুত চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকলে সরকারী বেসরকারী বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র থেকে পর্যাপ্ত বিদ্যুত না পেয়ে পিডিবি গ্রাহকদের লোডশেডিংয়ে বাধ্য করত। এতে বেড়ে যেত আইপিএসের ব্যবহার। সাধারণত প্রাক গ্রীষ্ম এবং গ্রীষ্মে নগরীতে ব্যাপকহারে আইপিএস বিক্রি হয়ে থাকে। নগরীতে ব্যাপক প্রচলিত দুটি ব্র্যান্ডেড আইপিএস কোম্পানির বিপণন ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, আইপিএস ব্যবসায় হঠাৎ করে ধস নেমেছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর একই সময়ে বিক্রি কমে গেছে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। আগে প্রতিটি বিক্রয় পয়েন্ট থেকে ৫-৬টি করে অর্ডার পাওয়া যেত। প্রাক গ্রীষ্ম এবং গ্রীষ্মে চাহিদা সামাল দিতে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় নিতে হতো। কিন্তু এখন আর আগের পরিস্থিতি নেই। সপ্তাহ মিলেও কোন গ্রাহক মিলছে না। বসে গেছে বিভিন্ন স্থানে গজে উঠা আইপিএস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্র্যান্ডেড প্রতিষ্ঠানগুলোরও বেহাল অবস্থা। বেশ কয়েকটি বিপণন প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে আইপিএস উৎপাদন সীমিত করেছে। তারা জানান, বিদ্যুতের লোডশেডিং বৃদ্ধি পেলে আইপিএস নির্ভরতা বাড়ে। যেখানে লোডশেডিংই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে স্বাভাবিকভাবে আইপিএস নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুত উৎপাদনের রোডম্যাপ অনুযায়ী দেশে বিদ্যুত উৎপাদন ৩৬ হাজার ৩৪ মেগাওয়াটে উন্নীত হওয়ার কথা। যা চাহিদার চেয়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বেশি। ঐ সময় পর্যন্ত লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। তাই এ ব্যবসার মন্দার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে তারা পেয়েছেন। ফলে আইপিএস উৎপাদন ও বিপণন থেকে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সরে আসছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় চীন থেকে আইপিএসের বিভিন্ন সরঞ্জামাদিও উল্লেখযোগ্যহারে কমে এসেছে। খাতুনগঞ্জের এক আমদানিকারক জানান, বাজারে নন ব্র্যান্ডেড আইপিএস উৎপাদনের জন্য তারা সার্কিটসহ বিভিন্ন ধরনের আইপিএস সরঞ্জাম কয়েক কন্টেনারযোগে আমদানি করত। গত বছর আমদানি করা সরঞ্জামের অর্ধেকই অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। তাই এ বছর নতুন করে কোন এলসি খোলা হয়নি। বরং গেল বছর আমদানি করা সরঞ্জামাদি বিক্রি করতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। আগে আইপিএসের ব্যাপক চাহিদা থাকায় পাড়ায় মহল্লায় ও সংবাদপত্রে বিভিন্নভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে নন ব্র্যান্ডেড আইপিএস বিক্রির হিড়িক ছিল। এখন থেমে গেছে এ ধরনের প্রবণতা। বিদ্যুতের লোডশেডিং ঘন ঘন এবং অসহনীয় পর্যায়ের কারণে আইপিএস নির্ভরতা ব্যাপক ছিল। চাহিদা বাড়তে থাকায় দামও ছিল নাগালের বাইরে। এক সময় ১ হাজার ওয়াট ক্ষমতার ব্র্যান্ডেড আইপিএসের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এখন তা ৩০ হাজার টাকার নিচে নেমে এসেছে। নন ব্র্যান্ডেড আইপিএসের দাম নেমে এসেছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। তারপরও সহজে ক্রেতা মিলছে না। সামনের গ্রীষ্মে নগরীতে অন্তত লোডশেডিং নয়, স্থানীয়ভাবে সরবরাহ লাইনে ত্রুটিজনিত কারণে বিদ্যুতের সমস্যা দেখা দিলে আইপিএস বিক্রির হার বৃদ্ধি পাবে এমন আশায় বুক বেঁধেছেন অনেক ব্যবসায়ী। নগরজুড়ে অসংখ্য স্থানে বর্তমানে গজিয়ে উঠেছে আইপিএসের সরঞ্জামাদি, ব্যাটারি ও পানির দোকান। এসব ক্ষুদ্র দোকানগুলোতেও এখন ক্রেতাশূন্য। বিদ্যুতের সমস্যা কমে যাওয়ায় আগের মতো তারা ব্যাটারি এবং ভারী পানি বিক্রি করতে পারছে না। তারাও পড়েছেন মন্দার মুখে। আবার চকবাজার ও দেওয়ানহাট শেখ মুজিব রোডের ব্যাটারি দোকানগুলোতেও ক্রেতা নেই। আগে দীর্ঘ লাইন থাকত ব্যাটারি ক্রয় এবং পরিবর্তনে। আইপিএসের ব্যবহার কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসায়ও মন্দাভাব। ব্যাটারির জন্য ক্ষতিকর সীসা ব্যবহারের পরিমাণও কমেছে। সব মিলিয়ে আইপিএস ব্যবসা যেন ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাওয়ার পথে। আইপিএসের পথ অনুসরণ করছে জেনারেটর ব্যবসায়ীরাও। প্রাক গ্রীষ্ম এবং গ্রীষ্মে আমদানি করা জেনারেটর কেনার হার বেড়ে যেত। গৃহস্থালী ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উপযোগী ৫ থেকে ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতার জেনারেটর বিক্রি হত। কিন্তু এখন পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। জুবিলী রোডের মেশিনারিজ মার্কেটগুলোতে জেনারেটর শোভা পেলেও ক্রেতা নেই। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, জেনারেটর বিক্রি করা এখন সোনার হরিণ হয়ে পড়েছে। আর পাড়ায় পাড়ায় জেনারেটর বসিয়ে বিকল্প বিদ্যুত সরবরাহের ব্যবসায়ও মন্দাভাব। শহর এবং গ্রামে লোডশেডিংয়ের সময় বিশেষ করে সান্ধ্যকালীন সময়ে জেনারেটর সার্ভিস দিয়ে বিদ্যুত সরবরাহ করা হতো। এখন আর এ ব্যবসা চলছে না। বিশেষ করে বাজার এবং বিভিন্ন মহল্লায় গ্রাহকপ্রতি একটি এনার্জি লাইট ও ফ্যানে সংযোগ দিয়ে অনেকে উপার্জনের উপায় বের করত। তাও আর চলছে না বিদ্যুতের অভূতপূর্ব উন্নতিতে। এদিকে আইপিএস ব্যবসায়ীদের জন্য পিডিবি আরও দুঃসংবাদ দিয়েছে। চট্টগ্রামে বেসরকারী পর্যায়ে বিদ্যুত উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়ছে। আগামী বছর কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র চালু হলে সেখান থেকে প্রথম পর্যায়ে ১২শ মেগাওয়াট ও পরবর্তীতে আরও ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া গেলে বিদ্যুত সরবরাহের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমানে চট্টগ্রামে পিডিবির সাড়ে ৭ মেগাওয়াট ও বেসরকারী পর্যায়ে ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে প্রায় ৭৫০ থেকে ৮শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হয়। গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি হতে পারে। চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা ৭শ’ মেগাওয়াটের নিচে। চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের সামঞ্জস্য থাকায় এ মুহূর্তে জাতীয় গ্রিডের নির্ভরতাও নেই। নেই সঙ্কট। রয়েছে শুধু স্থানীয়ভাবে সরবরাহ লাইন এবং বিভিন্ন স্থানে ট্রান্সফরমারের ওভারলোডজনিত কারণে ত্রুটি। লোডশেডিং প্রায় নিম্নপর্যায়ে। স্থানীয় ত্রুটিগুলো পুরোপুরি মুক্ত করা গেলে বিদ্যুত সঙ্কট হবে অকল্পনীয়। পিডিবির প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার বিদ্যুত সঙ্কট নিরসনে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা দ্রুত বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।
×