ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শহর থেকে গ্রাম জনগণের দোরগোড়ায় আইসিটি সেবা;###;১১ হাজার তরুণ উদ্যোক্তা ইউনিয়ন পর্যায়ে ৬ ধরনের সেবা দিচ্ছেন ;###;৭ কোটি জন্ম নিবন্ধন, সাড়ে চার কোটি পর্চাসহ দিয়েছেন ১২ কোটি সেবা ;###;পাঁচ শ’ ইউডিসিতে স্বাস্থ্যক্যাম্প চালু ;###;আউট সোর্সিং থেকে জুটছে বাড়তি আ

প্রযুক্তি বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৪ মার্চ ২০১৫

প্রযুক্তি বিপ্লব

জসিম উদ্দিন ॥ ‘টানা তিনবার এসএসসি পরীক্ষা দেই। তিনবারই ফেল করি। চরম হতাশ হয়ে পড়ি। এক সময় শুরু করি রেডিও মেকানিকের কাজ। আয় বাড়ানোর চিন্তা থেকে ২০০৮ সালে একটা কম্পিউটার কিনি। এ সময় ইউনিয়ন পরিষদের কিছু কাজ করতাম। ২০১১ সালে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োগ পাই। এরপর আমাকে পেছনে ফিরতে হয়নি’- দৃঢ়তার সঙ্গে এমন প্রত্যয় গাইবান্ধার কামারজানি ইউনিয়নের উদ্যোক্তা মাহবুবুর রহমানের কণ্ঠে। পরের গল্প শুধু এগিয়ে যাওয়ার। এক বছরের মাথায় মাহবুব পান জেলায় দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা পুরস্কার। এরপর ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পান প্রথম শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তার স্বীকৃতি। ২০১৪ সালে পান রংপুর বিভাগের ইউডিসি শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা পুরস্কার। এমন উদ্যোক্তা শুধু মাহবুবই নন। যশোরের আরিফ আর গোপালগঞ্জের লিপিসহ দেশজুড়ে আছেন ১০ হাজার ৯৫০ তরুণ আইসিটি উদ্যোক্তা। যারা ইউডিসি থেকে সহজে, কম খরচ ও ঝামেলাহীনভাবে প্রায় ৬০ ধরনের সরকারী বেসরকারী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ইউডিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১২ কোটি সেবা দিয়েছেন তারা। এতে তাদের মাসিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি টাকা। ব্যক্তিগতভাবে কারও কারও আয় দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। ইউডিসি থেকে দেয়া এ পর্যন্ত অনলাইনে জমা দেয়া হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ১০ হাজার বিল। জন্ম নিবন্ধন হয়েছে প্রায় ৭ কোটি, পর্চার আবেদন করেছেন আরও সাড়ে ৪ কোটিরও বেশি। এছাড়া উদ্যোক্তারা ৫শ’রও বেশি ইউডিসিতে স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প চালু রেখেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে সব ধরনের নাগরিক সেবাকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা এবং সবাইকে সহজে তা দেয়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যান্ডইউথ আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গাইবান্ধার উদ্যোক্তা মাহবুব জানান, প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে তার তথ্যসেবা কেন্দ্র। গড়ে ১শ’ জনকে সেবা দেন তিনি। ইউআইএসসি প্রকল্প অফিসে জমা দেয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি আয় করেছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। মাহবুব জানালেন, এতদূর আসার পেছনে যাদের অবদান রয়েছে তারা হলেন সদর উপজেলা নির্বাহী আশরাফুল মমিন খান ও কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবুল বাশার আহমেদ। তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার পরও এই দুই ব্যক্তিই তাকে ইউডিসি উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। এসএসসি পাস না করার কষ্ট ভুলে এখন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে আরও দক্ষতা অর্জন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন মাহবুব। স্বপ্ন দেখেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার। ইতোমধ্যে দুর্গম চর এলাকায় কামারজানি ইউডিসি-২ নামে আরেকটি তথ্য সেবা কেন্দ্র পৌঁছে দিতে চান চরাঞ্চলের মানুষের কাছে তথ্য প্রযুক্তি সেবা। সাত বছরের মেয়ে ও তিন বছরের ছেলেকে গড়ে তুলতে চান তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে। ‘ছাত্র জীবনে ছিলাম সাংস্কৃতিক কর্মী। ২০০৫ সালে এমএম কলেজ থেকে এমএ পাস করার পর বেকার। সাংস্কৃতিক কাজ করে যাই। টিউশনি করে নিজে চলি। কোন চাকরি না করে নিজে কিছু করার ইচ্ছা থেকে ২০০৯ সালে একটা কম্পিউটার নিয়ে গ্রামের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দিতে শুরু করি। ২০১০ ইউনিয়ন পরিষদে তথ্য সেবা কেন্দ্র চালু হলে আমি কাজ শুরু করি। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন করে নারী উদ্যোক্তা থাকা বাধ্যতামূলক। তাই সঙ্গে যিনি ছিলেন কয়েক মাস পর তিনি ছেড়ে দেন। এরপর আরেকজন আসেন, তিনি কয়েক মাস পর ছেড়ে দিলে ব্যবসায়িক অংশীদার হন স্ত্রী রাবেয়া খাতুন। তিনিও এমএ পাস। এরপর আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি।’ এসব কথা বলেন যশোরের আরবপুর ইউডিসির উদ্যোক্তা এসএম আরিফুজ্জামান। তিনি জানালেন, ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিক সেবা কেন্দ্রের এমএম কলেজের দুই গেটে দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও আউটসোর্সিং সেন্টার স্থাপন করেন। যেখানে কাজ করছে আরও মোট ৮ কর্মী। এছাড়া রয়েছে ১৫ ফ্রিল্যান্সারের একটি গ্রুপ। একটি কম্পিউটার নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন তার প্রতিষ্ঠানে ২৪ কম্পিউটার ও ৪ ল্যাপটপ রয়েছে। আরবপুর ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র এখন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে কম্পিউটার বিষয়ে ৬ মাস মেয়াদী ডিপ্লোমার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গত সেমিস্টারে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ৫৭ জন চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়। এছাড়া আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষার জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন ১০২ প্রশিক্ষনার্থী। এছাড়াও তিন মাস ও এক মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স করানো হয় বলে জানান উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান। এটুআই প্রকল্পের আওতায় সরকারী বেসরকারী ৬০ ধরনের সেবা দানের বাইরেও তিনি নতুন নতুন সেবা চালু করছেন বলে জানান আরবপুর ইউডিসির এই উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, যশোরে প্রথম অনলাইনে গণশুনানির আয়োজন করি আমরা। আরও নতুন সেবা হিসেবে গ্রামের কৃষকদের জন্য একটা ই-কমার্স সাইট তৈরি করছি। ‘গ্রামের হাট ডট কম’ নামের এই সাইট সত্বর উদ্বোধন করা হবে। শূন্য থেকে শুরু করে এখন তিনটি সেন্টার পরিচালনা করেন। প্রতি মাসে আয় করেন গড়ে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে চান আরিফ। তিনি বলেন, আগে ‘একা’ স্বপ্ন দেখতাম বড় কিছু করার। এখন ‘আমরা’ স্বপ্ন দেখি আরও বড় কিছু করার। সবার কাছে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বশেষ সেবা পৌঁছে দিতে চাই। গড়ে তুলতে চাই প্রযুক্তিনির্ভর একটা সমাজ। গোপালগঞ্জ জেলার মোকসেদপুর উপজেলার ননী‘ক্ষীর ইউডিসির উদ্যোক্তা লিপি দাস। ছোট বেলা থেকে কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ ছিল। স্বপ্ন দেখতেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়বেন। বাবার মৃত্যুর পর সব ওলটপালট হয়ে যায়। বড় ভাইয়ের কাঁধে দায়িত্ব যায় ৪ বোন আর ২ ভাইসহ সংসারের। কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ আর সংসারে সহযোগিতা করতেই নেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। ২০১০ নবেম্বর শুরু করেন উদ্যোক্তা জীবন। পাশাপাশি পড়েন গোপালগঞ্জ সরকারী বঙ্গবন্ধু কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স প্রথম বর্ষে। তিনি জানালেন, গড়ে প্রতিমাসে ১৬ হাজার আয় করেন। সরকারের রূপকল্প ২০২১ এর লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া। এই লক্ষ্যে দেশজুড়ে স্থাপন করা হয় ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্র। এসব সেবা কেন্দ্র গ্রাম, শহর আর নগরে কাজ করছে ভিন্ন ভিন্ন নামে। দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা আর সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ডে রয়েছে কার্যক্রম। প্রতিটি সেন্টারে রয়েছে একজন নারী ও একজন পুরুষ উদ্যোক্তা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের আওতায় দেশজুড়ে রয়েছে ৪৫৪৭ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি), ৩২১ পৌরসভা ডিজিটাল সেন্টার (পিডিসি) ও ৪০৭ সিটি ডিজিটাল সেন্টার (সিডিসি)। এছাড়া সার্ক ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (এসডিএফ) আওতায় ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় দেশের পিছিয়ে পড়া দুর্গম এলাকায় স্থাপন করে আরও ২শ’টি ইউডিসি। ইউডিসির দেয়া উল্লেখযোগ্য সরকারী সেবা হলো- ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ‘ডিজিটাল মানি’ বা মোবাইল পেমেন্ট সেবার আওতায় সরকারের পক্ষে বেতন পরিশোধ, পেনশন পরিশোধ, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা, বয়স্ক ভাতা, গর্ভবতী মায়েদের ভাতা, কৃষি ভর্তুকি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর ভাতা, ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান ও নগদ সহায়তা দেয়া। এছাড়া জমির পর্চা, জীবন বীমা, পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, সরকারী ফরম, পাবলিক পরীক্ষার ফল, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, অনলাইন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ভিজিএফ-ভিজিডি তালিকা, নাগরিক সনদ, নাগরিক আবেদন, কৃষি তথ্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ ইত্যাদি। বেসরকারী সেবার মধ্যে রয়েছে- অনলাইনে কেনাকাটা, চিকিৎসকের পরামর্শ, টেলিমেডিসিন, বীমা সেবা, মোবাইল ব্যাংকিং, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ছবি তোলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ইমেল, চাকরির তথ্য, ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজী শিক্ষা, ভিসা আবেদন ও ট্র্যাকিং, ভিডিও কনফারেন্সিং, কম্পোজ, প্রিন্টিং, স্ক্যানিং, ফটোকপি ও লেমিনেটিং ইত্যাদি। মাসিক আয় ৫ কোটি টাকা ॥ দেশের এসব উদ্যোক্তা এখনই ব্যক্তিগতভাবে এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করছেন। পাশাপাশি আরও অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। এভাবে প্রতি মাসে ৪০ লাখের বেশি মানুষ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী ই-সেবা গ্রহণ করছেন ইউডিসি থেকে। আগামীর সম্ভাব্য সেবা ও কর্মসংস্থান ॥ আগামী দিনে এর সঙ্গে যোগ হবে ডিজিটাল স্টক এক্সচেঞ্জ। যার মাধ্যমে ডিজিটাল সেন্টারগুলোতেও সাধারণ মানুষ শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ পাবেন। এতে আরও প্রায় ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া নতুন সেবার মধ্যে আরেক সম্ভাবনাময় সেবা হতে পারে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা। প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে কোন ব্যাংকের শাখা নেই, সেখানে তাদের প্রতিনিধি হয়ে ব্যাংকিং সেবা দেবে। কিছু অর্জন ॥ ইউডিসির মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষকে তথ্য আর সেবা দানের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ এখন ‘কার্যকর ও জনগণের প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত হয়েছে। এই পথ পরিক্রমায় রয়েছে বেশ কিছু অর্জন। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ॥ প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ গড়তে দক্ষ জনশক্তি খুবই প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়া ইউডিসির একটি অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা। ৩ হাজার ৭৭৮ ইউডিসি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে স্বল্পমূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সেবা দিচ্ছে। এক লাখের বেশি তরুণ-তরুণী ইউডিসি থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। বিদ্যুত বিল ॥ বিদ্যুতের বিল জমা দিতে এখন আর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে উপজেলায় বা থানায় যেতে হয়না। উল্টো জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে হাজির হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। ইউডিসি’র মাধ্যমে তারা এই বিল আদায় করছে। এ পর্যন্ত ৫ লাখ ১০ হাজারটি বিল অনলাইনে জমা পড়েছে। বীমা সেবা ॥ রাষ্ট্রীয় বীমা প্রতিষ্ঠান- জীবন বীমা কর্পোরেশন গ্রামের প্রান্তিক মানুষকে দিতে ইউডিসিতে জীবন বীমা সেবা চালু করেছে। এ পর্যন্ত ২,৭৬৮ ইউডিসি থেকে মোট ৩৬ হাজার নাগরিক বীমা সেবা গ্রহণ করেছেন। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ॥ প্রত্যন্ত অঞ্চল আর তৃণমূল মানুষ ব্যাংকিং সুবিধা বঞ্চিত। তাদের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে একযোগে কাজ করছে বেসরকারী ব্যাংক Ñডাচ-বাংলা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ। দেশের ৩ হাজার ৮ ইউডিসি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার নাগরিক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করেছেন। ৭ কোটি জন্ম নিবন্ধন ॥ এখন প্রতিটি শিশুর জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির নিবন্ধনও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইউডিসিগুলো এ পর্যন্ত প্রায় ৭ কোটি জন্ম নিবন্ধন করেছে। স্বাস্থ্যসেবা ॥ গ্রামীণ জনপদের মানুষ অবস্থানগত কারণেই স্বাস্থ্য সুবিধা বঞ্চিত থাকে। তাদের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সুবিধা পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর। তাদের সহায়তায় ৩০ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে দেয়া হচ্ছে টেলিমেডিসিন সেবা। এছাড়া প্রায় ৫শ’টিরও বেশি ইউডিসিতে নিয়মিত স্বাস্থ্য ক্যাম্প চালু রয়েছে। কৃষিসেবা ॥ ইউডিসি থেকে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য পাওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায়ন হচ্ছে গাঁয়ের গরিব চাষীর। এতে বাড়ছে তার কৃষি উৎপাদন এবং উপার্জন। ইউডিসি থেকে কৃষি উপকরণ বিতরণের কার্ড তৈরি করা হয়। এছাড়া যে কোন নাগরিক উপজেলা বা জেলা অফিসে না গিয়েও জমির পর্চার নকলের জন্য আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন ইউডিসিতে। এতে তার সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। এ পর্যন্ত ইউডিসিগুলো থেকে সাড়ে ৪ কোটি পর্চার আবেদন করা হয়। ৩৫০ ইউডিসিতে স্ট্যাম্প বিক্রি করা হয়। শিক্ষাসেবা ॥ একটা সময় ছিল গ্রামের শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির আবেদন করতে যেতে হতো শত মাইল পাড়ি দিয়ে। সেখানেও অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘ লাইন ধরে। এর পরও দালালচক্রের নানা প্রতারণা। এখন তা মাত্র একটা এসএমএসের বিষয়। বাড়িতে বসেই এসএমএসের মাধ্যমে করতে পারছেন এই কাজ। উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহী ছাত্র বা অভিবাসনে আগ্রহী শ্রমিক ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ইংরেজী শেখা ও দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও একজন সাধারণ মানুষ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চাকরি বা উচ্চ শিক্ষার সাক্ষাতকার অথবা চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন। চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক ২০ লাখ ২৫ হাজার কর্মী নিবন্ধিত হয়েছে। ২৭০ ইউডিসিতে পাসপোর্ট, ভিসা আবেদন, ভিসা চেকিং সেবা দেয়া হয়। ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ই-মেল ও ভিডিও কল সেবা নিয়েছে দেড় লাখেরও বেশি বার। দুর্যোগ পূর্বাভাস ॥ ভূ-প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এছাড়া রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। তাই যে কোন দুর্যোগ আঘাত হানার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্থানীয় দুর্যোগ পূর্বাভাস জানার সুযোগ পাচ্ছেন। উদ্যোক্তা তৈরি ও নারীর ক্ষমতায়ন ॥ প্রতিটি ইউডিসি উদ্যোক্তাই ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার কার্যকর করার নেপথ্যের কারিগর। প্রতিটি কেন্দ্রে থাকেন দু’জন করে উদ্যোক্তা। একজন ছেলে ও একজন মেয়ে। একজন নারী উদ্যোক্তা থাকার ফলে কেন্দ্রে নারীদের সহজে প্রবেশগম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্যোক্তা একজন বিনিয়োগকারী, চাকরিজীবী নয় এবং জনগণকে সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্জিত আয় থেকেই উদ্যোক্তা তার জীবিকা নির্বাহ করেন। দেশের মোট ৫ হাজার ৪৭৫ কেন্দ্রে মোট ১০ হাজার ৯৫০ তরুণ আইসিটি উদ্যোক্তার আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে। প্রাণের সঞ্চার ইউপিতে ॥ এক সময়ে মানুষের ধারণাই ছিল, ইউনিয়ন পরিষদ নিয়মিত খোলা হয় না। ইউনিয়ন পরিষদ খুব বেশি ব্যবহার হতো না। কেবল গ্রাম্য সালিশ-বিচারের কাজে ইউনিয়ন পরিষদ মাঝেমধ্যে ব্যবহার হতো। অনেক চেষ্টা করেও প্রাচীনতম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করা যায়নি। ‘জনগণের দোরগোড়ায় সেবা’ সেøাগান সামনে রেখে ইউডিসির যাত্রা শুরু হয়। ইউডিসি চালু হওয়ার পর সেই ধ্যান-ধারণা বদলে যায়। এর মূল লক্ষ্য হলো ইউনিয়ন পরিষদকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা; যাতে ২০২১ সালের মধ্যে তথ্য ও জ্ঞানভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে এই প্রতিষ্ঠান। সরকারী-বেসরকারী তথ্য ও সেবাদানের মাধ্যমে জনগণের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে ইউনিয়ন পরিষদকে। তাই মানুষকে এখন সেবার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে না, উল্টো সেবাই এখন পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়। ইউনিয়ন পরিষদ এখন মানুষের তথ্যসেবার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পেছনের কথা ॥ প্রশাসনিক কাঠামোতে দেশের প্রাচীনতম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ। তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের সবচেয়ে কাছের স্থানীয় সরকার কাঠামো। তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক কেন্দ্র বা ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার’ এতে নতুন মাত্রা এনেছে। সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে জনগণের দোরগোড়ায় সহজে, দ্রুত ও স্বল্পব্যয়ে সেবা পৌঁছে দিতে যাত্রা শুরু এসব সেবাকেন্দ্রের। ২০১০ সালের ১১ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একযোগে উদ্বোধন করেন দেশের ৪৫৪৭ ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র (ইউআইএসসি)। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাঁর কার্যালয়ে আর নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর (ইউএনডিপি) প্রশাসক হেলেন ক্লার্ক ভোলা জেলার চর কুকরিমুকরি ইউআইএসসি থেকে ওই ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন। ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের সাফল্য দেখে ২০১৩ সালে দেশের ৩ শ’ ১৯ পৌরসভায় পৌর তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (পিআইএসসি) এবং ১১ সিটি কর্পোরেশনের ৪শ’ ৭ ওয়ার্ড কার্যালয়ে নগর তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (সিআইএসসি) চালু হয়। ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র, পৌর তথ্য ও সেবাকেন্দ্র এবং নগর তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের নামের ভিন্নতা থাকলেও অভিন্ন উদ্দেশে কাজ করে। দীর্ঘ ও ভিন্ন ভিন্ন নাম সাধারণ মানুষের মনে রাখার সুবিধা ও ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে মিল রেখে ‘ডিজিটাল সেন্টার’ নামকরণ করা হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ইউডিসি প্রতিষ্ঠা হলেও এ কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত সরকারের স্থানীয় প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা ই-গব: ফোকাল পয়েন্ট ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জেলা ই-গবঃ ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে তদারকিসহ ইউডিসি টেকসই করার কাজ দেখভাল করেন। জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। মন্ত্রিপরিষদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ এ কাজের সমন্বয় করে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইউডিসি পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে ইউডিসির কার্যক্রমসমূহ মনিটরিং করে থাকেন। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন ইউপি সচিব। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ॥ জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এম্পাওয়ারিং রুরাল কমিউনিটি রিচিং দ্য আনরিচ ইউনিয়ন ইনফরমেশন এ্যান্ড সার্ভিস সেন্টার (ইউআইএসসি) প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, সার্ক ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (এসডিএফ) বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে এই প্রকল্প চলছে। এর আওতায় আমরা নদী বা পাহাড়ে, বিচ্ছিন্ন দুর্গম অঞ্চলে কাজ করছি। দেশের পিছিয়েপড়া দুর্গম এলাকায় ২০০ ইউডিসি স্থাপনে আমরা হার্ডওয়্যার সহায়তা দিয়েছি। এছাড়া তাদের বেসিক প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। তারা জনগণকে তথ্য সেবা দেয়ার মাধ্যমে বেশ ভাল আয় করছে বলেও জানান তিনি। সুশান্ত কুমার সাহা বলেন, এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষে অন্যান্য প্রকল্পের মতো এটাও সরকারের স্থানীয় সরকার প্রশাসন তদারকি করবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ্যাকসেস টু ইনফর্মেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ নাইমুজ্জামান মুক্তা বলেন, আমাদের মূল সেøাগান জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো। সেবার পেছনে মানুষ ঘুরবে না, সেবা মানুষের কাছে যাবে। এই লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করি। এসময় আমাদের বড় সমস্যা ছিল সবার কাছে ডিজিটাল ডিভাইস না থাকা ও স্বল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষকে সেবা দেয়া। তাই সবাইকে সেবা পৌঁছে দিতে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়। তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা যায় প্রায় ৪১০ ধরনের সেবার জন্যনাগরিকদের বিভিন্ন অফিসে যেতে হয়। কিছু সেবার জন্য যেতে হয় উপজেলা বা জেলায়। কিছু সেবার জন্য রাজধানীতে। অনেক সময় সেবা নেয়ার প্রক্রিয়া জানা না থাকার কারণেও প্রতারিত হয় নাগরিকরা। তাই আমরা ‘সেবাকুঞ্জ’ নামে পোর্টাল তৈরি করছি; যেখানে এসব সেবা পাওয়ার নিয়ম ও সেবা পাওয়া যাবে। এছাড়া ২৫ হাজার সরকারী অফিসের পোর্টাল তৈরি করি; যাতে নাগরিকরা অনলাইনে সেবা পেতে পারে। নাইমুজ্জামান মুক্তা বলেন, এক ছাতার নিচে সব সেবা নিয়ে আসা এবং সবাইকে সহজে তা দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ। তিনি বলেন, বিটিসিএল জানিয়েছে, তারা এক হাজার ইউনিয়ন পরিষদে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ দেবে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সকল জেলা ও উপজেলায় অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ দেবে। পাশাপাশি আরও দুই হাজার ইউনিয়ন পরিষদে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তাহলে খুব সহজে সবাইকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, পৃথিবীর সব দেশে প্রযুক্তি বিপ্লব হয়েছে শহরকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘বাটন-আপ’ পলিসির কারণে আজ সারাদেশ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় জেগেছে। তিনি বলেন, এমন কোন দেশ নেই যারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে একযোগে উদ্বুদ্ধ করে সারাদেশে তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করে এবং কেন্দ্রসমূহকে গণমুখী করতে পেরেছে। আমরা সেখানে মডেল স্থাপন করেছি। জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, ইউডিসি স্থাপনের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সরকারী-বেসরকারী সেবা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে করা হয়েছে আরও বেশি শক্তিশালী ও জনমুখী। নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে দেশের ডিজিটাল কর্মকা- আরও গতিশীল করা হবে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ’২১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল করার অংশ হিসেবে ইউনিয়ন পর্যায়েও অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন করা হবে। প্রতিটি ইউডিসিকে মিনিবিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
×