ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোজাম্মেল খান

বিএনপি নেতাদের আত্মোপলব্ধির মুহূর্ত উপস্থিত

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২২ মার্চ ২০১৫

বিএনপি নেতাদের আত্মোপলব্ধির মুহূর্ত উপস্থিত

১ ফেব্রুয়ারি জনকণ্ঠে ‘আন্দোলন জনগণের জন্য না জনগণের বিরুদ্ধে?’ শিরোনামে একটি লেখার উপসংহার টেনেছিলাম এই বলে- ‘প্রকৃতপক্ষে, সর্বস্তরের মানুষ এ পরিস্থিতি কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতায় আশাহত, বিশেষ করে মানুষকে নির্বিচারে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা, তাদের দৈনন্দিন রুটি-রোজগার অর্জনে বাধা দেয়া, এমনকি তাদের চলাফেরায় বাধা দেয়া; যেটা কিনা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মৌলিক উপাদান। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলন, যেটাকে তারা গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করেছে, সেটা জনগণের জন্য না হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’ গত আড়াই মাসে আন্দোলনের নামে পরিচালিত নাশকতার এসব ঘটনায় কমপক্ষে দেড়শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগেরই পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে। এ দুর্ভাগাদের কেউই কোন রাজনৈতিক দলের ‘পদাতিক সৈনিক’ ছিলেন না। এদের সবাই নিরীহ সাধারণ মানুষ, যারা জীবিকা এবং দৈনন্দিন কাজের তাগিদে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলেন। এ দুর্ভাগ্যের সর্বশেষ শিকার সোহেল মিয়া। শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। সোহেল এক এনজিও অফিসের পিয়ন ছিলেন। গত রবিবারের এই ঘটনায় এ নিয়ে চারজনের মৃত্যু হলো। যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন, বিএনপি জোটের পেট্রোলবোমা ও সন্ত্রাসনির্ভর আন্দোলন, যেটা জনগণের নামে পরিচালিত হচ্ছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, সেটা যে ব্যর্থ হয়েছে সে ব্যাপারে কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই। এটা এখন বুমেরাং হয়ে বিএনপির প্রতি যারা সহানুভূতিশীল ছিলেন তাদেরও বিরূপ করেছে। এদেশের মানুষ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ অনেক সফল আন্দোলন দেখেছে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরিক হয়েছে, কিন্তু কোন সময়ই আন্দোলন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি কিংবা তারা এ ধরনের বীভৎসতার শিকার হননি। সেসব আন্দোলনে সাধারণ মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য কর্মীরা সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে; আজকে তার বিপরীতে সাধারণ জনগোষ্ঠী আন্দোলন কর্মীদের নৃশংসতা থেকে রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করছে। এটাই হলো বিএনপি জোটের ‘জনগণের জন্য আন্দোলন’। ‘আমি একজন গরিব ট্রাকড্রাইভার। সামান্য উপার্জন দিয়ে সংসার চালাতাম। আমার ভবিষ্যত এখন অন্ধকার।’ আরমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে একটি বিছানার ওপর শুয়ে আগুনে পোড়া যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা নিয়ে এই কথাগুলো বললেন। ‘আমি এখন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছি। এখন আমাদের সাহায্য করবে কে? আমার দুটি নাবালক সন্তান এবং গর্ভবতী স্ত্রী। আমি একদিন না খেয়ে থাকতে পারি। কিন্তু ওদের এখন দেখবে কে?’ এ মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন আরমান রাখলেন সাংবাদিকদের কাছে। দেশের প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষ আরমান আর শিরিন আক্তারদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন। কেবল যে নেত্রীর নির্দেশে হরতাল আর অবরোধের নামে এ নৃশংসতা পরিচালিত হচ্ছে, তিনি ছাড়া। একমাত্র চরম আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী হওয়ার কারণে প্রো-বিএনপি হওয়া কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ছাড়া দেশের সব মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন যখন এই তথাকথিত আন্দোলন তার স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবে। অন্ধভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী কিছু লেখক আর টকশো বিশেষজ্ঞ এখনও এ নৃশংসতার দায়ভার সরকারের ওপর চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াসে লিপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এমন দুই-একজন শিক্ষক তাঁদের জীবনে নাকি এ ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দেখেননি। এ ধরনের মিথ্যাবাদী বিবেকবর্জিত শিক্ষক আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে কি নৈতিকতা শিক্ষা দিচ্ছেন সেটা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কথা। এ ধরনের কোন শিক্ষকের পশ্চিমা বিশ্বের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করা দুরূহ হতো। একজন বিএনপিপন্থী মানবাধিকার সংস্থার প্রধান, যে সংস্থাটি হেফাজত ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে বিশ্বব্যাপী প্রচার চালিয়েছিল, একটি পত্রিকায় পর পর দুটো নিবন্ধ লিখেছেন মিরপুরে দু’জন বিএনপি কর্মী কিভাবে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে এবং সালাহউদ্দিনের অন্তর্ধানের ঘটনা নিয়ে। তার দুই হাজার শব্দের ওই উপক্ষণে ওই দুই দলীয় ‘পদাতিক সৈনিক’ এবং অজানা স্থান থেকে আল কায়েদার মতো হরতাল আর অবরোধের ঘোষণা দেয়া নেতার নিরুদ্দেশের আর্তনাদই শুধু স্থান পেয়েছে; কিন্তু মানুষের জীবন ধ্বংসকারী ওই আন্দোলন- যার একমাত্র প্রতিফলন পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যার শিকার মরিয়ম আর শিরিন আক্তারদের মৃত্যু বা বোমার আগুনে পোড়া আরমানদের আহাজারি আর আর্তনাদের কথা স্থান পায়নি। আজকের বাংলাদেশে যেখানে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন সাধারণ মানুষের আর্তনাদ আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত সেখানে যে কোন রাজনৈতিক দলের ‘পদাতিক সৈনিক’ বা সালাহউদ্দিন আহমেদের অন্তর্ধান যত দুঃখজনকই হোক না কেন সেটাতে তাদের পরিবারের বাইরে চোখের পানি ফেলার মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। আমেরিকান কমান্ডোদের হাতে বিন লাদেনের নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায় তার প্রতি কিছু মানুষের সহানভূতির উদ্রেক হলেও বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষ নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় নিহত কয়েক হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যুতে চোখের পানি ফেলেছে এবং নিঃসন্দেহে প্রায় সারাবিশ্ব থেকে অপ্রতিরোধ্য শোক প্রকাশিত হয়েছে। কোন বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সমাজে একটি বড় রাজনৈতিক দল ধ্বংস হতে পারে না। একটি দল তার ভুলনীতির কারণে একটি গুরুতর বিপত্তির সম্মুখীন হলে, দলের নেতা সাধারণত পদত্যাগ করেন যাতে করে নতুন নেতৃত্ব নতুন নীতির মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠন করে হারানো অবস্থান ফিরে পেতে সচেষ্ট হন। যদিও বাংলাদেশ একটি নিখুঁত গণতন্ত্র নয় এবং গণতন্ত্র চর্চা আর বেশি অনুপস্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর। কোন দলই তার নেতাদের নির্বাচিত করতে কোন গণতান্ত্রিক চর্চা লালন-পালন করে না। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এটা বেশি প্রযোজ্য- বিশেষ করে বিএনপির ক্ষেত্রে। যদিও পারিবারিক উত্তরাধিকার কমবেশি সব দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব ফেলে, কিন্তু বর্তমান সময়ে শুধু দুটো দেশের মানুষই সুনিশ্চিতভাবে জানতেন- কে হবেন তাদের রাষ্ট্রের পরবর্তী কর্ণধার। দুই বছর আগে ওই দুই ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নামও সংযোজিত হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম অতি গর্বের সঙ্গে ঘোষণার মধ্য দিয়ে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (যদিও এ ধরনের কোন পদ বিএনপির ঘোষণাপত্রে নেই), যিনি তার সমালোচকদের কাছে ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ হিসেবে অভিহিত, তার বিরোধীদের কিছু সমালোচনার জবাবে এক হুঁশিয়ারিতে ওই দলের এক মুখপাত্র বললেন, ‘তারেক রহমানের সম্পর্কে সাবধানে কথা বলবেন, তিনি বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।’ বিএনপি মুখপাত্রের হুঁশিয়ারিতে একটা বক্তব্য খুব দৃঢ়ভাবে পরিষ্কার, আর সেটা হলো- যেহেতু তিনি হবেন প্রধানমন্ত্রী সেহেতু তিনি থাকবেন সমস্ত সমালোচনার উর্ধে, যেমনভাবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজারা তাদের প্রজাদের সমালোচনার সম্পূর্ণ উর্ধে। তদুপরি তারেক রহমানের ছবি তার প্রয়াত পিতা এবং জীবিত মাতার পাশাপাশি দেশের সব বিএনপি অফিসে শোভা পাচ্ছে। জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হিংসাত্মক যুদ্ধে বিএনপি যে জনগণের সহানুভূতি এবং সমর্থন হারিয়েছে সেটা ফিরে পেতে হলে বিএনপিকে জনগণের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। আজকে যদি আমরা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নিজেদের যারা মুক্ত করেছে সে সমস্ত জাতির ইতিহাসের দিকে নজর দেই তাহলে দেখা যাবে খুব কম দেশের সংগ্রামই বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলনের মতো মানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভের সমান্তরাল ছিল। তবে মৌলিক পার্থক্য হলো অন্য দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জনের নীতির পথনির্দেশক শক্তি হিসেবে কাজ করে, যেটা বাংলাদেশ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এ সন্ধিক্ষণ হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক ঘটনা, যেখানে দেশের স্বাধীনতার প্রধান স্থপতিকে নৃশংসভাবে হত্যা। একই সঙ্গে নিহত হলো যেসব বিশ্বাস এবং গুণাবলী প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত নিয়ে নবনির্মিত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেই থেকেই শুরু হলো দুঃখজনক পেছনের দিকে যাত্রা। পরবর্তী দু’দশক ধরে বিকৃতি, ছলচাতুরি, ধ্বংস, বিচ্যুতি ও বৈপরীত্য জাতীয় জীবনের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে স্থান করে নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে কি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের পথ ধরে অর্জিত একটি দেশে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী শক্তিকে বলা হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি’, যার অর্থ হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি’ও থাকবে আমাদের দেশ তথা রাজনৈতিক অঙ্গনে- এটা কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল? আর সে বিপক্ষ শক্তির উত্থান আর তাকে আজ পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়া। যেহেতু মুক্তি সংগ্রাম তথা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের বিপরীতে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি বিকল্প দল হিসেবে গড়ে উঠেছে সেহেতু ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার পার্থিব লোভলালসায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করেন এ ধরনের অনেকেই এই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। যেখানে আমাদের জাতির সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার কথা ছিল আমাদের জাতিকে একত্রিত করার প্রধানতম উপপাদ্য, সেখানে এটা হয়েছে আমাদের জাতিকে বিভক্ত করার প্রধান হাতিয়ার। আর সেটা সুপরিকল্পিতভাবে করেছেন জিয়া এবং খালেদা জিয়া। বিএনপির অনেক সামনের সারির নেতা আছেন যারা যে আদর্শসমূহ নিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলোতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তারা বিএনপি নেত্রীর আস্থা এবং করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সেগুলো উচ্চারণ করেন না। অথচ বিএনপিতে যোগদানের আগে বা বিএনপি ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা সেগুলো বিনাদ্বিধায় আওড়ান। এই নেতাদের যে কেউই দল ও জাতির নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং মহিমান্বিত ইতিহাস লালনকারী যে কোন নাগরিকের পক্ষে ওই দলের সমর্থক হওয়ার কলঙ্ক (মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি) জাতির মানসে যেভাবে বিদ্যমান সেটা থেকে চিরতরে মুক্ত হতে পারবেন। একই সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সমাজের উঁচুস্তর থেকে আসা বিএনপির প্রথম সারির নেতারা তাদের ম্যাডাম (পৃথিবীর কোন দেশে কোন রাজনৈতিক নেতাকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করা হয় বলে আমার জানা নেই) এবং অচিরেই তদীয় ‘গুণধর’ পুত্রের ভৃত্যসম আচরণ থেকে রক্ষা পেয়ে কিছুটা হলেও আত্মসম্মানবোধ ফিরে পেতে পারবেন, যেটা তারা বিএনপি রাজনীতি করার স্বার্থে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। লেখক : কানাডার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক এবং ওই প্রতিষ্ঠানের সিনেটের ডেপুটি স্পীকার
×