শরীফুল ইসলাম ॥ আসন্ন ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দু-একদিনের মধ্যেই দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে দলের সিদ্ধান্ত কি হবে তা নির্ভর করছে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর।
বেশ ক’দিন ধরে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলেও বিএনপি এ ব্যাপারে নীরব রয়েছে। তবে দলের কোন কোন নেতা বলেছিলেন তফসিল ঘোষণার পর এ ব্যাপারে অবস্থান পরিষ্কার করবে। বুধবার নির্বাচন কমিশন ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তফসিল ঘোষণা করে। এ তফসিল অনুসারে ২৮ এপ্রিল ৩ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে কি করা যায় চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। দু-একদিনের মধ্যেই এ বিষয়টি সিদ্ধান্ত হবে। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে এখন আমাদের কাছে অগ্রাধিকার জাতীয় নির্বাচন। তাই জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সকলের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারপরও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচন তাই এ বিষয়েও সবকিছু চিন্তাভাবনায় রেখে একটি সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি।
সূত্র মতে, বিএনপি হাইকমান্ড মনে করছে যদি সহসা চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্ত হয়ে অবাধে সভা-সমাবেশ করা, রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির আশ্বাস ও আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা নির্বিঘেœ রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিতে পারবে এমন পূর্বাভাস পান তাহলে বিএনপি সরাসরি মাঠে থেকে ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে। আর তা না হলে গোপনে প্রচার চালিয়ে দল সমর্থক অথবা ক্লিন ইমেজের কোন বিকল্প প্রার্থীকে বিজয়ী করার চেষ্টা করবে। আর যদি পরিস্থিতি বেশি প্রতিকূলে থাকে সেক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিরোধিতা করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে থাকবে। তবে বিভিন্ন সূত্র জানায়, বিএনপি যদি ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা বলে ভাল প্রার্থী দিয়ে মাঠে সক্রিয় হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে সরকারও বিএনপির প্রতি কিছুটা নমনীয় হবে। সেক্ষেত্রে সিটি নির্বাচনে ভাল ফল করার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও সুবিধা আদায়ের সুযোগ পাবে বিএনপি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে বিএনপি স্বেচ্ছায় এগিয়ে না এলে সরকার বা সরকারী দল আপনা থেকে তাদের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাবে না। কারণ ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ৬ সিটি কর্পোরেশনের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৩ সিটিতে সরকারী দলও হারতে চাইবে না। তাই সরকারী দল এমন কৌশলে নির্বাচন করবে যাতে বিজয়ের ফসল তাদের ঘরে আসে। জানা যায়, সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়া-না নেয়ার ব্যাপারে বিএনপিতে এখনও ২ ধরনের মত রয়েছে। দলের একাংশের মতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান অবরোধ-হরতাল কর্মসূচীতে সফল হতে পারেনি বিএনপি। তার ওপরে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকায় দলের ভবিষ্যত গন্তব্য চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। দলের অনেক নেতাকর্মী কারাগারে। আবার অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলে আন্দোলন মাঠে মারা যাবে। এছাড়া দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এ পরিস্থিতিতে সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়া দলের জন্য নেতিবাচক হবে।
বিএনপির অন্য অংশটি মনে করছে কোন স্থানীয় সরকার নির্বাচনই দলের নেতাকর্মীরা বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়নি। তাই ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকেও ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। প্রয়োজনে আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিত রেখে নির্বাচনে অংশ নিলে নেতাকর্মীরা নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মসূচীতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে। সেই সঙ্গে ভাল প্রার্থী দিয়ে সবাই মিলে চেষ্টা করলে গুরুত্বপূর্ণ ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয় লাভ করা সম্ভব হবে। এতে করে একদিকে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে আর অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন কর্মসূচী সফল করার ব্যাপারে অবস্থান সুদৃঢ় হবে। আর কোন কারণে দল সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হলে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে চলমান আন্দোলন জোরদার করা সম্ভব হবে। দলের এই অংশের নেতাদের মতে বিএনপি কোন কারণে দলের নেতাদের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মনোনয়ন না দিলেও ক্লিন ইমেজ রয়েছে এমন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অথবা কোন ব্যবসায়ী নেতাকে মনোনয়ন দেয়া উচিত। এমন প্রার্থীদের পেছনে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা কাজ করলে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, কুমিল্লা, ও গাজীপুরের মতো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেও সহজেই বিজয় লাভ করতে সক্ষম হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনকে প্রার্থী করার পূর্ব সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। তবে পরিবেশ অনুকূলে থাকলে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস, সাবেক সদস্য সদস্য সচিব আবদুস সালামও প্রার্থী হতে চান। এছাড়া পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারী দলের কোন বিদ্রোহী প্রার্থীকেও দলে টেনে প্রার্থী করার পক্ষে দলের কিছু নেতার মত রয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ এর আগে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুর আলমকে প্রার্থী করে সুফল পেয়েছিল বিএনপি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে সরকারী দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছেন সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন। এছাড়া নগর আওয়ামী লীগ নেতা সংসদ সদস্য হাজী সেলিমও মাঠে প্রচারণায় রয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে প্রার্থী করার পূর্ব সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। এই সিটি কর্পোরেশনে সরকারী দলের প্রার্থী হিসেবে ইতোমধ্যেই মাঠ গরম করেছেন ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারও প্রচার শুরু করেছেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে এবারও বিএনপি মঞ্জুর আলমকেই প্রার্থী করতে চায় বলে জানা গেছে। অবশ্য সরকারী দলের প্রার্থী হিসেবে ইতোমধ্যেই জোরেশোরে প্রচারণা শুরু করেছেন সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তবে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সালাম ও আ জ ম নাসিরও নির্বাচন করতে চান।
এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন আগে বিএনপির পক্ষ থেকে বার বার সিটি নির্বাচনের দাবি করলেও সরকার ও আওয়ামী লীগ তা কর্ণপাত করেনি। কিন্তু যখন দলের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে এবং বাকিদের মধ্যে অধিকাংশই আত্মগোপনে রয়েছেন তখন বিএনপিকে দূরে রেখে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায় আওয়ামী লীগ। যে কারণে হঠাৎ করে নির্বাচনের কথা বলে তড়িঘড়ি করে তফসিলও ঘোষণা করা হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন যখন মে মাসে নির্বাচনের কথা ভাবছিল তখন পুলিশের আইজি বলেছেন এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন দিতে। শেষ পর্যন্ত ২৮ এপ্রিল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এটা বিএনপিকে বেকায়দায় রেখে সরকারী দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করার কৌশল কি না এমন প্রশ্নও রয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০০২ সালে ডিসিসি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বয়কটের ফলে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা ভোটার বিহীন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন। সেবার ৯০টি ওয়ার্ডের মধ্যে কমিশনার পদে অধিকাংশ ওয়ার্ডেই বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ২০০৭ সালে সাদেক হোসেন খোকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নির্বাচন না হওয়ায় ২০১১ সাল পর্যন্ত খোকাই মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালের নবেম্বর মাসে সরকার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে ২ ভাগে ভাগ করে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন করে। সেই সঙ্গে সাদেক হোসেন খোকাকে সিটি মেয়রের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ২ সিটি কর্পোরেশনে ২ জন প্রশাসক নিযোগ করে। সেই থেকে ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে করা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সদর দফতর থেকে যায় পুরনো নগর ভবনে। আর ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে করা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সদর দফতর নিয়ে যাওয়া হয় বনানীতে। এর আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে বিএনপির প্রার্থী মঞ্জুর আলম বিজয়ী হন।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: