ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হরতাল-অবরোধের চিহ্ন নেই, চাঙ্গা ব্যবসাবাণিজ্যও

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৭ মার্চ ২০১৫

হরতাল-অবরোধের চিহ্ন নেই, চাঙ্গা ব্যবসাবাণিজ্যও

রহিম শেখ ॥ সোমবার সকাল দশটা। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা। যানজটে আটকে আছে গাড়ি। ব্যক্তিগত গাড়ি, যাত্রীবাহী বাস-টেম্পো, মালভর্তি ট্রাক সবই আছে গাড়ির এই সারিতে। আর সিএনজিচালিত অটোরিক্সা তো আছেই। বিএনপি জোটের টানা অবরোধ, চলছে হরতালও। কিন্তু সেই অবরোধ-হরতালের ছিটে ফোঁটাও নেই রাজধানীতে। এখন অনেকটাই স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লেনদেন আগের তুলনায় বেড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও চাঙ্গাভাব। কলকারখানায় উৎপাদনও বাড়ছে। গ্রাম কিংবা শহর সর্বত্রই কর্মচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। রাজধানীতে শুধু সড়ক পথেই নয়, নৌপথেও আসছে বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত পণ্য। ব্যাঘাত হচ্ছে না চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য খালাসে। জানা গেছে, গত ৭০ দিনের হরতাল-অবরোধের সহিংসতা ও নাশকতায় অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে দেশের কৃষক, উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরাই বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা পুঁজিহারা হচ্ছেন। এতে ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করে এফবিসিসিআই বলেছে, একদিনের হরতাল বা অবরোধে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এই ক্ষতির সিংহভাগই হয় ব্যবসায়ীদের। চলমান সহিংসতামূলক রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন খাতে এখন পর্যন্ত ৭০ দিনে এক লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। হরতাল-অবরোধের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, গত দুই মাসেরও বেশি সময়ে বিএনপি-জামায়াতের লাগাতার অবরোধ-হরতালে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। জনগণের সমর্থনহীন এই নৈরাজ্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচী দেশের সাধারণ মানুষের মতো ব্যবসায়ীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। চলমান পরিস্থিতি সামলে দেশ ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। সরেজমিনে রাজধানীর ফার্মগেট, গুলিস্তান, গুলশান, নিউমার্কেট, পুরান ঢাকা ও মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় এখন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তীব্র যানজট চোখে পড়ে। পরিবহন শ্রমিকরা জানান, টানা অবরোধের প্রথম দিকে রাজধানীতে যানবাহন চলাচল কম ছিল। এরপর টানা হরতাল শুরু হলে যানবাহন চলাচল আরও কমে যায়। তবে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে রাস্তাঘাটে যানবাহনের চলাচল বেড়েছে। এখন রাজধানী ফিরে পেয়েছে তাঁর চিরচেনা চেহারা। সড়কে যানবাহনের সারিই বলে দিচ্ছে নগর জীবনের স্বাভাবিক চিত্র। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লেনদেনও আগের চেয়ে বেড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের এক ব্যবস্থাপক জানান, ব্যাংকের লেনদেন ভালই হচ্ছে। আগে হরতালে ব্যাংকে কোন লেনদেন হতো না। এখন ওই প্রথা ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া মার্কেট, বিপণি বিতান, শপিংমল এমনকি ফুটপাথ সর্বত্রই সরগরম। তবে বেচাকেনা কম হলেও হতাশ নন ব্যবসায়ীরা। বায়তুল মোকাররমের সামনের ফুটপাথের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শমসের আলী জনকণ্ঠকে জানান, হরতাল-অবরোধে একদিনও দোকান বন্ধ রাখিনি। কিন্তু কোন কোন দিন একেবারেই বিক্রি হয়নি। পুঁজি ভেঙ্গে খেতে হয়েছে। আমরা প্রায় শেষ হয়ে গেছি। তবে এখন বিক্রি বাড়লেও সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠাতে পারছি না। সোমবার নিউমার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, কেনাকাটায় ব্যস্ত অনেক ক্রেতা। তাঁদের মধ্যে একজন রাজধানীর আজিমপুর এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। স্ত্রীকে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন। তিনি বলেন, প্রথমদিকে ভয়ে ভয়ে বের হইনি। এখন প্রয়োজনের তাগিদে বের হতে হচ্ছে। লোকজনও কম নয়। মানুষ আর কত দিন এভাবে কাজ বাদ দিয়ে থাকবে? নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম জানান, দোকান বন্ধ রাখলেও ভাড়া দিতে হবে, খোলা রাখলেও দিতে হবে। তারপর আছে কর্মচারীর বেতন। এই হরতাল-অবরোধের মধ্যেই ঋণ করে দোকান ভাড়া দিয়েছি। তবে এখন বেচাকেনা কিছুটা বেড়েছে। তবে আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে বলে তিনি জানান। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তৌফিক এহসান জনকণ্ঠকে বলেন, দুই মাসের বেশি সময় ধরে সহিংসতা ও তা-বে ব্যবসায়ীরা মারাত্মাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে সবকিছু পেছনে ফেলে ব্যবসায়ীরা এখন দোকানপাট খুলছেন। বাজারে মানুষের সমাগমও বেড়েছে। বেচাকেনাও হচ্ছে ভালো। সর্বত্র ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। তবে ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে দাবি করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। রাজধানীর কাওরান বাজার, শ্যামপুর ও মৌলভীবাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেন আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। প্রতিদিন বাজারে পণ্য বেচাকেনা চলছে। জানা গেছে, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ বস্ত্র ও পোশাক, পাদুকা, পাট, সিরামিক, ওষুধ শিল্পসহ সব কারখানা পুরোদমে চালু রয়েছে। সাভার ডিইপিজেডের একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, এখানে কারখানাগুলোর উৎপাদনও স্বাভাবিক। কারখানার উৎপাদন ও আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক রয়েছে। কাঁচামাল ও তৈরি পণ্য পরিবহনও স্বাভাবিক বলে জানান কারখানার কর্মকর্তারা। তবে এ ক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম পরিবহন খরচ কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (বেপজা) এক কর্মকর্তা বলেন, এখন পণ্য আমদানি-রফতানিতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। আর উৎপাদন স্বাভাবিক। সবকিছু স্বাভাবিক সময়ের মতোই চলছে। আমাদের শ্রমিকরাও প্রতিদিন আসছেন। তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই পরিস্থিতির সঙ্গে। এদিকে হরতাল-অবরোধে বন্দর থেকে পণ্য খালাসে কোন ব্যাঘাত হচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সচল থাকায় মূলত বন্দর থেকে অনায়াসে পণ্য খালাস করে নিতে পারছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দরে এখন গড়ে প্রতিদিন ২ হাজার ৩০০ কনটেনার (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ) খালাস হচ্ছে। আবার রেলপথেও ঢাকার কমলাপুর ডিপো থেকে নিয়মিত কনটেনার আনা-নেয়া হচ্ছে। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, হরতাল-অবরোধে রফতানি পণ্য জাহাজীকরণ হচ্ছে। সব জাহাজ পর্যাপ্ত রফতানি পণ্যভর্তি কনটেনার নিয়ে বন্দর ছাড়ছে। কারখানা থেকে প্রথমে বেসরকারী ডিপোগুলোতে পণ্যভর্তি কাভার্ড ভ্যান আনা হচ্ছে। এরপর বেসরকারী ডিপোতে কনটেনারে বোঝাই করে সেসব পণ্য বন্দর দিয়ে জাহাজে তুলে দেয়া হচ্ছে।
×