ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমস্যাটা রাজনৈতিক নয়, আদর্শিক

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১৬ মার্চ ২০১৫

সমস্যাটা রাজনৈতিক নয়, আদর্শিক

কিছুদিন আগে টিভি সঞ্চালক মুন্নি সাহার উপস্থাপনায় এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক। আলোচকদের বক্তব্যে মূলত বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। মানিকের আলোচনায় মূল যে কথাটি ছিল, তাই আজকের লেখার শিরোনাম করেছি। উদ্দেশ্য এর গভীরে গিয়ে আরও কিছুটা আলোচনা করা। তার আগে দেখি মানিক কী বলেছিলেন। সাংবাদিক মানিকের ভাষায়, বাংলাদেশের চলমান যে সমস্যা তা মূলত ‘আদর্শিক’। বাংলাদেশে দুটি ধারা চলে এসেছে, একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অন্যটি বিপক্ষের। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ ধারা চায় না বাংলাদেশ শান্তিতে থাকুক। তাই অশান্তি সৃষ্টিতে এই ধারাটি সন্ত্রাসকে আশ্রয় এবং প্রশ্রয় দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘বিগত বছরটিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ শান্ত ছিল, যার কারণে সেসময়ে দেশে উল্লেখযোগ্য উন্নয়নও সাধন হয়েছে। দেশের মানুষ শান্তি চায়, উন্নয়ন চায়। সরকার সেই উন্নয়নের ধারায়ই এগোচ্ছিল। কিন্তু বিএনপি সেই উন্নয়নে বাধা দিচ্ছে। তা করতে গিয়ে দেশের মানুষকে আন্দোলনের নামে পুড়িয়ে মারছে। কিন্তু এভাবে আন্দোলন সফল হবে না।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটকে মোকাবেলার জন্য মানিক এটাকে শুধু রাজনৈতিক সমস্যা বলে মানতে রাজি হচ্ছেন না। বরং সমস্যার জায়গাটিকে ‘আদর্শিক সমস্যা’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন এবং তার মোকাবেলাও ‘আদর্শিকভাবে’ করার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। সাংবাদিক মানিকের বক্তব্য এবং তাঁর ভাবধারার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করি। ১৯৭৫ সালের আগস্টে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি অত্যন্ত সুকৌশলে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সক্ষম হয়েছিল একাত্তরের পরাজিত আদর্শকে এই মাটিতে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই থেকে শুরু হয়েছে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া, আর মুক্তিযোদ্ধা নিধনের রাজনীতি- যা এখনও চলমান। চুয়াত্তরে বাকশালের অতিউৎসাহী একজন সদস্য হয়েও পঁচাত্তরের পরে জেনারেল জিয়া বাকশাল আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে বহু দলীয় গণতন্ত্রের ধোয়া তুলে প্রথমেই তিনি বাংলার মাটিতে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন তখনকার সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ, স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামকে। বহু দলীয় গণতন্ত্রের আবরণে তা ছিল মূলত জামায়াত ইসলামীকে বাংলাদেশে পুনর্প্রতিষ্ঠা করার একটি কৌশল মাত্র। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে তা না বোঝার কোন কারণ থাকে না। এই প্রক্রিয়ার পক্ষে নেপথ্যে থেকে যে কয়েকটি দেশ কাজ করেছিল তখন, তাদের মধ্যে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের নাম ছিল সর্বাগ্রে। এমনকি বর্তমানে খালেদা জিয়ার হুকুমে বাংলাদেশে অবরোধের নামে যে মানুষ হত্যা এবং জ্বালাও-পোড়াও চলছে, তার নেপথ্যের প্রেরণাদাতা দেশগুলোর নামও সেই পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রকারী দেশগুলোর সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত। পেট্রোলবোমায় যখন মানুষ মরছে, দেশ জ্বলছে, ঠিক তখনই খবরের কাগজে দেখেছি এর পেছনে ইন্ধনদাতা হিসেবে ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া পাকিস্তানী একজন কূটনীতিকের নাম। স্বাধীন বাংলাদেশে আদর্শিক যে বিভাজনের কথা সাংবাদিক মানিক বলেছেন, তার গোড়াপত্তন হয়েছিল মূলত ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত ইসলাম সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে পুনরায় ফিরে আসার মাধ্যমেই শুরু হয় বাংলাদেশে ‘আদর্শিক বিভক্তির রাজনীতি’। ইদানীং হরহামেশাই ড. কামাল হোসেন অথবা ড. মুহম্মদ ইউনূসদের মতো বিজ্ঞ ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের মুখ থেকে অনবরত নিসৃত হয় একটি কথা যে, ‘উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং বিশ্ব অর্থনীতির অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বাংলাদেশকে বিভক্তির রাজনীতি পরিহার করতে হবে।’ ওনারা যখন রাজনীতির আদর্শিক বিভক্তি এবং তার গোড়াপত্তনের কথা জেনেও ফড়িয়াদের মতো উন্নয়নের গালভরা বুলি আওড়ান, তখন তাঁদের কথাকে গুরুজন বাক্য হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হয়। আগেই উল্লেখ করেছি, বিভক্তিটা মূলত ধর্ম-বর্ণ বা সামাজিক নয়। এটা সম্পূর্ণ আদর্শিক বিভক্তি। এই বিভক্তির ওপরে ভিত্তি করেই বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। এই বিভক্তির ওপরে ভিত্তি করেই সেই সময়ে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণও তৈরি হয়েছিল, যার কারণে শুরু হতে পারত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ ঘটনা। একাত্তরে নয় মাসের যুদ্ধ সারাবিশ্বকে আদর্শিক প্রশ্নের সরল রেখায় সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছি, অথচ তাকে অস্বীকার করে সুশীলের তকমায় আঁটা ব্যক্তিবর্গরা সমস্যার অতি সরলীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশীদের মনে সুখ এনে দেয়ার ঠিকাদারি নিতে চান। সুতরাং তাঁদের অবকাঠামোতে যে ‘ইসলামী রিপাবলিক’ আতরের সুভাষিত গন্ধ জড়ানো থাকবে এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে! পঁচাত্তরের পর থেকে এই বিভক্তির কালো ছায়া দেশে বিরাজ করা শুরু করলেও, এটা ছিল অনেকটা একপেশে যুদ্ধের মতো। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে কোণঠাসা করা ছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে তাকে নিঃশেষ করে দেয়ার মতো ঘটনাও দেখেছি এই দেশে। ২০০৪ এর ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ওপর গ্রেনেড হামলা ছিল তার উদাহরণ। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অন্য শীর্ষনেতৃবৃন্দ যদি সেদিন নিহত হতেন, তাহলে একাত্তরের এই পরাজিত শক্তিকে ঠেকানোর মতো অন্য কোন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে থাকত না এবং একাত্তরের পরাজিত শক্তির এটাই ছিল পরিকল্পনার মূল অংশ। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছিল সেদিন, যদিও কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয় সেদিন। পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে বিএনপি এবং জামায়াত ইসলামী যা কিছু করেছে, তার একটিও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় করেছে বলে প্রতিয়মান হয় না। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল যে প্রত্যয় নিয়ে, স্বাধীনতাবিরোধী অশুভ শক্তি পেট্রো-ডলার, আর আইএসআইয়ের মদদে পরিপুষ্ট হয়ে বাংলাদেশকে আবার সেই একাত্তরের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে তৎপর থেকেছে সর্বক্ষণ। আর তাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছে পঁচাত্তর পরবর্তী জামায়াতের ‘আদর্শিক ক্লোন’ বিএনপি। সুতরাং দেশের চলমান সঙ্কটকে বাংলাদেশের তথাকথিত নাগরিক সমাজ তথা ক্ষেত্রবিশেষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিতকরণের যে চেষ্টা করেছে, তা সঠিক নয়। রোগের ভুল চিকিৎসায় রোগী অধিকতর বেশি কষ্ট পাবে বা মারা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও কথাটি একইভাবে প্রযোজ্য। যে আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে পাথেয় করে জামায়াত-বিএনপি সেই পঁচাত্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে, তা যদি রাজনৈতিক সমস্যাই হতো, তাহলে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হতো না বা হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। রাজনৈতিক সংলাপই যথেষ্ট ছিল তার সমাধানের জন্য। সংলাপে ব্যর্থ হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাই ছিল বাঙালী জাতির জন্য আদর্শিক মেরুকরণ, যার পরিসমাপ্তি ঘটে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে ‘সংলাপ’ ঈড়হপবঢ়ঃ বা ধারণাটাই ভুল। একাত্তরেও ভুল প্রমাণিত হয়েছে, এখনও ভুল হতে বাধ্য। কারণ সমস্যাটা রাজনৈতিক নয়, আদর্শিক। সুতরাং বাংলাদেশের চলমান সঙ্কটকে রাজনৈতিক সমস্যা বলে এর প্রতিকারের চেষ্টা করা হবে ‘রোগের ভুল চিকিৎসা’র মতোই হঠকারী এবং অন্তঃসারশূন্য। বাংলাদেশে যা মূলত আদর্শিক সমস্যা, তাকে আড়াল করতে গিয়ে দেখানো হচ্ছে এক ভিন্ন সমস্যা এবং তাকে বলা হচ্ছে ‘রাজনৈতিক সমস্যা’। এতে মদদ দিচ্ছে অদৃশ্য একাধিক আন্তর্জাতিক শক্তি, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এবং বর্তমান সরকারকেও তাদের বান্ধব সরকার হিসেবে মেনে নিতে পারছে না। এছাড়াও রয়েছে পেট্রো-ডলারে মদদ পুষ্ট বাংলাদেশেরই এক ধরনের আজগুবি ‘নাগরিক সমাজ’, যারা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মূল আদর্শের বিপরীত মেরুতে কাজকর্মে লিপ্ত থাকে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টিতে এদের জুড়ি নেই। সম্পূর্ণ মৌলবাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একাত্তর পূর্ববর্তী পাকিস্তান আদলে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিতে যে ‘আদর্শিক সমস্যা’ সৃৃষ্টির দরকার, বাংলাদেশে বর্তমানে তাই বিদ্যমান। একাত্তরের পক্ষ শক্তিগুলোর ক্রমবর্ধমান নৈতিক অবক্ষয়ই বর্তমানে বিরাজমান সমস্যাগুলোর আদর্শিক মোকাবেলার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে গণসচেতন না হলে মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ এবং মওদুদীবাদ শব্দগুলো নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নামের আগে বিশেষণ হিসেবে লিখতে হবে। বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধে একশ’র উপরে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট করা এবং সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তচিন্তার যুক্তিবাদী লেখক অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকা-ই তার জ্বলন্ত ইঙ্গিত বহন করে। সুতরাং সময়ক্ষেপণ হবে বোকার মতো আত্মাহুতিসম। [email protected]
×