ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৪ মার্চ ২০১৫

অগ্নিঝরা মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ১৪ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকার উত্তাল রাজপথে সেদিন ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী চিত্র। মাঝি-মাল্লারা সব লগি-বৈঠা হাতে এদিনে রাজপথে নেমে আসে। সেদিনের রাজপথ ছিল মাঝি-মাল্লাদের দখলে। সামরিক আইনের ১১৫ ধারা জারির প্রতিবাদে সেদিন বেসরকারী কর্মচারীরাও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। দেশের জনগণকে গণতান্ত্রিক অবস্থা থেকে বঞ্চিত করার প্রতিবাদে খ্যাতিমান শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তাঁর ‘হেলাল ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বসার ব্যাপারে পূর্ব শর্তারোপ করেন। প্রেস ব্রিফিংয়েও বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দেন, যদি প্রেসিডেন্ট দাবি পূরণের ইচ্ছা নিয়ে আলোচনায় বসতে চান, তা হলে আমি বসতে পারি। তবে বঙ্গবন্ধু দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসার আহ্বান জানান। তিনি শর্তারোপ করে স্পষ্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দেন, বৈঠকে কোনভাবেই তৃতীয় কোন পক্ষ উপস্থিত থাকতে পারবে না। অন্যপক্ষে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৬ দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিলেও ঢাকায় এসে বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কেননা তখন পুরো বাংলাদেশ চলছে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে। যেখানে পাকিস্তানের ন্যূনতম প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানের প্রভাবশালী ন্যাপ (ওয়ালী) নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে আলাপ-আলোচনা করেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাঙালীর আন্দোলন এবং তাদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেন। একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি জানান। এ সময় দেশের পত্রিকাগুলোতেও আন্দোলনকে সমর্থন করে সম্পাদকীয় লেখা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ অসহযোগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৫ মার্চ পালনে ৩৫টি নতুন নির্দেশনা দেন। এ সময় বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। একাত্তরের অগ্নিঝরা এই দিনে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের এক সমাবেশ থেকে দেশের ৭ কোটি জনতাকে সৈনিক হিসেবে সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদের (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (বর্তমানে সিপিবির সভাপতি)। একই দিনে শিল্প সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা শিল্পী সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। বাঙালীর স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ঢাকার কবি-সাহিত্যিকরা ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ নামে একটি কমিটি গঠন করেছেন। আহ্বায়ক হাসান হাফিজুর রহমান। সদস্য সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, বদরুদ্দীন ওমর, রণেশ দাসগুপ্ত, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রোকনুজ্জামান খান, জহির রায়হান, আবদুল গনি হাজারীসহ অনেকে। সারাদেশেই বীর বাঙালীর একই সেøাগান- ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালী বাঙালী’, তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’।
×