ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খালেদার বক্তব্যে সবাই হতাশ, সন্ত্রাসের পথেই থাকলেন

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৪ মার্চ ২০১৫

খালেদার বক্তব্যে সবাই হতাশ, সন্ত্রাসের  পথেই থাকলেন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে সারাদেশে হত্যা, সন্ত্রাসের নাটাই যে ২০ দলীয় জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার হাতেই সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্য থেকে নিজেই বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তিনি ইচ্ছা করলেই দেশবাসীকে হত্যা, সন্ত্রাস আর চলমান অরাজকতা থেকে মুক্তি দিতে পারেন। কিন্তু এতে রাজি নন তিনি। অর্থাৎ অচিরেই সন্ত্রাসের হাত থেকে দেশবাসীর মুক্তি নেই; তাও স্পষ্ট হয়েছে খালেদা জিয়ার শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যে। অর্থাৎ পেট্রোলবোমা, জ্বালাও পোড়াও আর মৃত্যুর মিছিল থামছে না। আর কত মৃত্যু? সম্পদহানী আর সহিংসতা দিয়েই খালেদা জিয়া রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চান এ প্রশ্নই সবার। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য আরও সহিংস আন্দোলনের জন্য বিএনপি তথা জামায়াত-শিবির ও উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীকে উসকে দিয়েছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে আরেকবার খালেদা জিয়া দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। সংবাদ সম্মেলনে অবলীলায় মিথ্যাচার করেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। নাশকতা আর সকল অপকর্মের দায় চাপিয়েছেন অন্যের ওপর। তিনি বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দ্রুত সংলাপের আয়োজন করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে চলমান আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে। অর্থাৎ সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের আয়োজন না হলে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা থামবে না। তাঁর লিখিত বক্তব্যে, সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। প্রত্যাহারের ঘোষণা আসেনি চলমান সহিংস আন্দোলনের। উল্টো অযৌক্তিক দাবি আদায়ে দেশকে আরও চরম নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে নেতাকর্মীদের উসকে দিয়েছেন তিনি। জনস্বার্থ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবর্তে সরকারের পরিণতি নিয়েও হুমকি দিয়েছেন। যারা আন্দোলনে আছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। অর্থাৎ সন্ত্রাস ও নাশকতার জন্য ধন্যবাদ পেয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। খালেদা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এই প্রক্রিয়ায় চললে খুব তাড়াতাড়ি আমরা সফলতায় পৌঁছাতে পারব। দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা ২০ দলীয় জোটের সহিংস আন্দোলন নিয়ে বিতর্ক আর সমালোচনার শেষ নেই। যদিও খালেদা জিয়ার দাবি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন তিনি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে তাহলে চলমান হত্যা, সন্ত্রাস, পেট্রোলবোমাসহ দেশজুড়ে চোরাগোপ্তা হামলা ও ভয়ঙ্কর নাশকতার জন্য দায়ী কারা? যদিও তিনি সহিংস কর্মকা-ের জন্য সরকারকে দোষারোপ করেছেন। বাস্তবতা হলোÑ নাশকতার অভিযোগে এ পর্যন্ত যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে এর মধ্যে বেশিরভাগই বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মী। বোমা বানাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ২০ দলের অনেকেই। নাশকতার সময় গণধোলাইয়ের যারা শিকার হয়েছেন; এদের প্রত্যেকেই বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। সঙ্গত কারণেই বলা যায় খালেদা জিয়ার দাবির সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল নেই। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে তিন ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন খালেদা জিয়া। প্রথমত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলে চলমান কর্মসূচী চালিয়ে নেয়ায় নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। দ্বিতীয়ত সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের আয়োজন করা হলে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ হবে, অর্থাৎ তিনি ইচ্ছা করলেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ স্থাপন করতে পারেন। বক্তব্যে পরোক্ষভাবে তার ইশারায় যে দেশে সন্ত্রাস নাশকতা চলছে; তাও পরিষ্কার করেছেন। তৃতীয়ত হলোÑ বিজয় নিশ্চিত করতে আন্দোলনের গতি বাড়ানোর জন্য জোটের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যদিকে নাশকতার জন্য দোষ চাপিয়েছেন সরকারপন্থী নেতাকর্মীদের ওপর। ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি জামায়াত জোটের সহিংস আন্দোলন অব্যাহত। পেট্রোলবোমা হামলায় এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ঢাকা মেডিক্যালেই মারা গেছেন ১৫। সোমবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী হরতাল অবরোধের চিত্র তুলে ধরে বলেন, গত ৬৪ দিনের হরতাল-অবরোধে পেটের তাগিদে কাজে বের হয়ে ১১৯ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এর অধিকাংশই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। পেট্রোলবোমাসহ নানা নাশকতামূলক কাজে সহস্রাধিক ব্যক্তি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। এ ক’দিনে ২ হাজারের অধিক যানবাহনে আগুনে পুড়ে ও ভাংচুর করা হয়েছে, ছয়টি লঞ্চে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, ৩৪ দফায় ট্রেনে নাশকতা হয়েছে। তিনি বলেন, এ নৈরাজ্য দীর্ঘদিন চলতে দেয়া যায় না। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর আছে। প্রয়োজনে তারা আরও কঠোর হবে। অনেকটা নির্লজ্জভাবেই খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকারের মদদে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিচ্ছে ও পেট্রোলবোমা মারছে। খালেদা জিয়া বলেন, নিরাপত্তার কথা বলে রাস্তায় গাড়ি নামালেও তাদের নিজেদের লোকই বাসে আগুন ও পেট্রোলবোমা দিয়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে। আর এর দায় চাপাচ্ছে বিরোধীদের ওপর। দিন পরিবর্তন হলে এসব মানুষের পাশে থাকব আমরা। বিএনপির চলমান আন্দোলন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বলে দাবি করেছেন তিনি। তিনি বলেন, এই আন্দোলন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। কোন দলের বিরুদ্ধে নয়। এই আন্দোলন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার। এই আন্দোলন ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ দেশ গড়ার। খালেদা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এই প্রক্রিয়ায় চললে খুব তাড়াতাড়ি আমরা সফলতায় পৌঁছাতে পারব। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো সাধারণ মানুষকে হত্যা ও সন্ত্রাসের অনুমতি দিয়ে, মায়ের বুক খালি করে কেমন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। এ প্রশ্ন দেশের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষের। শুধু তাই নয়, বিএনপি নেতাকর্মীরাও সহিংসতা চান না। হরতাল অবরোধে মাঠের চিত্রই তা প্রমাণ করে। যদিও বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেছেন, আন্দোলনে নাকি জনসমর্থন রয়েছে! সব মিলিয়ে কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন ২০ দল এ প্রশ্ন সবার। চলমান সহিংস আন্দোলন কোন্ দিকে নিয়ে যেতে চান ২০ দলের নেত্রী? চলমান কর্মসূচী হালে পানি পাচ্ছে না; এ বিষয়ে তিনি নিজেও পরিষ্কার। সচল যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাজধানীতে দিনভর যানজট। হরতাল অবরোধ উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন সবাই। নিজ দলের নেতাকর্মীরাও কর্মসূচী মানছেন না। তাঁদেরও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলছে। চলছে পরিবহনসহ সবকিছুই। এজন্য হয়ত দাবি আদায়ে সহিংসতার মাত্রা বাড়াতে চান! সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেছেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে কারা তাদের পক্ষে দেশ পরিচালনা করবে। আন্দোলনে এখনও যারা নিষ্ক্রিয় রয়েছেÑ তাদের যার যার জায়গা থেকে আন্দোলনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আমরা সফল হব। তাঁর এই আহ্বান সহিংসতার মাত্রা হয়ত বাড়িয়ে দেবে এমন ধারণা অনেকের। মানুষ হত্যা, সম্পদ ধ্বংস করে কেমন গণতন্ত্র, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। হয়ত যিনি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন; তিনিই এর ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরকার ব্যবহার করছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, যখন আমরা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছি, তখন জনবিচ্ছিন্ন সরকার পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি সদস্যদের বিরোধী দল নিপীড়নের কাজে ব্যবহার করছে এবং বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, দেশ আজ গভীর সঙ্কটে। এই সঙ্কট আওয়ামী লীগের তৈরি, আরও নির্দিষ্ট করে বললে শেখ হাসিনার তৈরি। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জঙ্গীবাদ বলে দেশ-বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে। জঙ্গীবাদের নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু এখন তাদের পালানোর সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে অব্যাহত বোমা হামলা, আদালতে হামলা, বিচারক হত্যা, গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা, বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান, ১০ ট্রাক অস্ত্রসহ সকল অপকর্মের হোতা ছিল তারাই। সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদের কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশের মানুষ তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। অথচ খালেদা জিয়ার বক্তব্যে এ বিষয়ে কোন অনুশোচনা ছিল না। সহিংসতা থেকে দূরে সরে বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচীর কথাও ভাবেননি তিনি। দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া আরও কিছু বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সংঘাত সংঘর্ষের পথ বেছে নিয়েছে! আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজয় নিশ্চিত করতে জাতিকে সাময়িক কষ্ট সহ্য করতে অনুরোধ জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। এ কষ্ট কত সময় পর্যন্ত চলবে, তা পরিষ্কার করেননি। অর্থাৎ নৈরাজ্য, সহিংসতা চলবেই, হয়ত একথাই সবাইকে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। খালেদা জিয়া আরও বলেছেন, বিএনপি হত্যার রাজনীতি বিশ্বাস করে না? রাজনীতিতে হত্যা ও সন্ত্রাসের স্থান নেই? তবে হত্যাকারী কারা? এ প্রশ্নের জবাবও তিনি নিজেই দিয়েছেন। বাসে পেট্রোলবোমা হামলা ও হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের দাবি জানিয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এতে নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিলেন তিনি। সহিংসতার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করে কতটুকু নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। হয়ত পুরো বিষয়টি না বুঝেই বলেছেন বেগম জিয়া। তিনি হয়ত ভুলে গেছেন, আন্দোলন ও সহিংস তা-বের নির্দেশ তারই দেয়া। এজন্য তাকে হুকুমের আসামি করে মামলাও দেয়া হয়েছে।
×