ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রুবেল তোপে উড়ে গেল ইংল্যান্ড

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১০ মার্চ ২০১৫

রুবেল তোপে উড়ে গেল ইংল্যান্ড

মোঃ মামুন রশীদ ॥ দুয়েকটি বলই যথেষ্ট পুরো এক জাতিকে আনন্দের জোয়ারে ভাসানোর জন্য। দুটি বলেই বাংলাদেশের ষোলো কোটি ক্রিকেটপ্রেমীকে উচ্ছ্বাসে ভাসালেন পেসার রুবেল হোসেন। আর যে প্রাপ্তির আশায় বুক বেঁধে ছিল বাংলাদেশ দল সেটা একাই করে দিলেন এ পেসার। তাঁর গতির তোপের কাছে নতজানু হলো শক্তিশালী ইংল্যান্ড। একই ম্যাচে দুটি ম্যাজিক দেখালেন রুবেল। প্রথম ম্যাজিক ২৭তম ওভারের প্রথম বলে বিপজ্জনক হয়ে ওঠা ইয়ান বেলকে উইকেটের পেছনে ক্যাচে পরিণত করে এবং চতুর্থ বলে ইংলিশ অধিনায়ক ইয়ন মরগানকে সাকিব আল হাসানের ক্যাচে পরিণত করে ঘুরিয়ে দিলেন ম্যাচ। আর দ্বিতীয় ম্যাজিক ৪৯তম ওভারের প্রথম ও তৃতীয় বলে স্টুয়ার্ট ব্রড ও জেমস এ্যান্ডারসনকে সরাসরি বোল্ড করে। রুবেলের ম্যাজিক দুটোই ইংল্যান্ডের মেরুদ- ভেঙ্গে দিল আর বাংলাদেশকে ভাসাল বিজয়ের আনন্দে। ৯.৩ ওভারে ৫৩ রান দিয়ে রুবেল শিকার করেন ৪ উইকেট। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয় সেরা বোলিং নৈপুণ্য এটি। আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে বাংলাদেশী কোন বোলারের সেরা বোলিং নৈপুণ্য। সুদূর অস্ট্রেলিয়ার এ্যাডিলেড ওভালে শুধু লাল-সবুজের পতাকা মর্যাদার সঙ্গে পতপত করে উড়ল রুবেলের ওই দুটি বলের কারণে। ইংলিশদের ২০১১ বিশ্বকাপের পর আবারও পরাজিত করে স্বপ্নের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেল বাংলাদেশ দল। দুর্দান্ত ব্যাটিং করছিলেন ক্রিস ওকস। বাংলাদেশের স্বপ্নকে ভেঙ্গে দেয়ার সব কাজই করে যাচ্ছিলেন। সব ব্যাটসম্যান যখন সাজঘরে ওকস একাই বাংলাদেশের বহুল আকাক্সিক্ষত জয়টাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তবে ৪৭তম ওভারে তাঁকে বধ করেই ফেলেছিলেন তরুণ পেসার তাসকিন আহমেদ। লং অনে ক্যাচ তুলে দিলেও সহজ সেই ক্যাচটা ধরতে পারেননি তামিম ইকবাল। মুষড়ে পড়েছিল এ্যাডিলেডে উপস্থিত বাংলাদেশী ক্রিকেটপ্রেমী দর্শক-ভক্তরা। সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় খেলা চললেও টিভি পর্দায় দুরু দুরু বুকে জয়ের অপেক্ষা করা বাংলাদেশীরাও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ ওকস আউট হলেই প্রায় নিশ্চিত হয়ে যেত বাংলাদেশের জয়টা। কিন্তু তামিম ক্যাচটা ছেড়ে দেয়ার কারণে স্বপ্নভাঙ্গার বেদনা গ্রাস করে ফেলেছিল বাংলাদেশকে। শেষ দুই ওভারে জয়ের জন্য মাত্র ১৬ রান প্রয়োজন ইংল্যান্ডের। শেষ দুই ওভারে বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্ন বাস্তব করার ক্ষমতা শুধু দু’জনের। রুবেল আর তাসকিন। তবে ৪৫তম ও ৪৭তম ওভারে যত রান দিয়েছেন তাসকিন, শেষ ওভারে তরুণ এ পেসারের ওপর নির্ভর করাও যাচ্ছিল না। তাই ৪৯তম ওভারে অভিজ্ঞ রুবেলের ওপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকল সবার। বড় দলের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে দুরন্ত বোলিং করে দলকে জেতানোর অতীত রেকর্ড ছিলই এ পেসারের। ২০১০ সালে প্রথমবার রুবেলের গতির ছোবলটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল বাংলাদেশ সফরকারী নিউজিল্যান্ড। সেবারই প্রথম কোন ওয়ানডে সিরিজে টেস্ট খেলুড়ে বড় কোন দলকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। ১৭ অক্টোবর ২০১০, পঞ্চম ওয়ানডেতে ২৫ রানে ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে জিতিয়েছিলেন রুবেল। দারুণ ব্যাটিং করে পেসার কাইল মিলস একাই জিতিয়ে দিচ্ছিলেন কিউইদের। কিন্তু তাঁকে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে সরাসরি বোল্ড আউট করে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন রুবেল। একই কা- তিনি ঘটান তিন বছর পর একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। ২৯ অক্টোবর ২০১৩, দারুণ ব্যাটিং করতে থাকা গ্র্যান্ট ইলিয়টকে বধ করে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন রুবেল। ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করে সেদিন দখল করেন মাত্র ২৬ রানে ৬ উইকেট। একই সিরিজে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ঢাকায় ৩৩ রানে ৪, ২০১১ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ৩১ রানে ৪ উইকেট শিকার করে দলকে জিতিয়েছিলেন। বাংলাদেশের দেয়া ২৭৬ রানের লক্ষ্যটাকে ছোট করে ফেলছিলেন ভয়ানক হয়ে ওঠা বেল ৬৩ রান করে। ততক্ষণে তেমন কিছুই করতে পারেননি রুবেল, ৫ ওভারে দিয়ে ফেলেছিলেন ২৯ রান। বিধ্বংসী রূপে আবির্ভূত হলেন তখনই। ২৭তম ওভারের প্রথম বলে বেলকে এবং চতুর্থ বলে মরগানকে শিকার করলেন। অতীত রেকর্ড এবং এ্যাডিলেডে ম্যাচের ভাগ্য বাংলাদেশের দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য তাই তো রুবেলের ওপর ছিল প্রত্যাশা। রুবেল আছেন, স্বপ্ন বেঁচে আছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জিতলেই কোয়ার্টার নিশ্চিত, প্রায় জয়ের দোরগোড়ায় বাংলাদেশ। মোক্ষম সুযোগটা আর আসবে না। ৪৯তম ওভারে ব্যাটিংয়ে ব্রড। মাথা ঠা-া রাখলেন রুবেল। এ্যাডিলেডবাসী এবং বিশ্ববাসী চমকপ্রদ এ ম্যাচটির দিকে তাকিয়ে ছিল। কারণ, ‘এ’ গ্রুপ থেকে কোয়ার্টার নিশ্চিত হওয়ার ম্যাচ ছিল এটিই। সবাই সাক্ষী হলেন আকর্ষণীয় এক ম্যাচের। সবার মনে ঠাঁই করে নেয়ার মতো একটি বোলিং নৈপুণ্য দেখালেন রুবেল। প্রথম বলেই ইন সুইঙ্গারে পরাস্ত করলেন ব্রডকে, সরাসরি বোল্ড করে দিলেন তাঁকে। বাংলাদেশ শিবিরে নতুন করে আনন্দ এবং উজ্জীবিত মনোভাব ফিরিয়ে আনলেন। কারণ আর একটি মাত্র উইকেট দূরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ স্বপ্নের জয় থেকে। দ্বিতীয় বলে জেমস এ্যান্ডারসন কোন রান নিতে পারলেন না। উজ্জীবিত রুবেল আত্মবিশ্বাসে হয়ে উঠলেন আরও দুরন্ত। তৃতীয় বলেই তিনি বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তব করলেন। প্রায় ইয়র্কার লেন্থের বলে পুরোপুরি পরাস্ত হয়ে এ্যান্ডারসন বোল্ড। বাংলাদেশ, এ্যাডিলেড এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের অসংখ্য ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থক আনন্দে ভেসে উঠলেন। জিতে গেল বাংলাদেশ ১৫ রানে। কোন রান না দিয়েই স্নায়ুচাপকে জয় করে রুবেল বাংলাদেশকে পৌঁছে দিলেন শেষ আটে মাত্র দুই বলে! ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডের ইতিহাসে কোন বাংলাদেশীর সেরা বোলিং নৈপুণ্য রুবেলের (৫৩/৪)। এর আগে ২০১০ সালের ১২ জুলাই বার্মিংহামে মাশরাফি বিন মর্তুজা ৩১ রানে ৩ উইকেট শিকার করেছিলেন ইংলিশদের বিরুদ্ধে। আর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয় সেরা বোলিং এটি। গত বিশ্বকাপে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে শফিউল ইসলাম ২১ রানে এবং ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে মাশরাফি ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন।
×