ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উপাদেয় স্ট্রবেরি

দেশী আবহাওয়ায় বিদেশী ফল- লাভজনক চাষ, চাহিদা বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৯ মার্চ ২০১৫

দেশী আবহাওয়ায় বিদেশী ফল- লাভজনক চাষ, চাহিদা বাড়ছে

মোরসালিন মিজান ॥ পশ্চিমা বিশ্বের উপাদেয় ফল বলে কথা। স্ট্রবেরি তাই খুব বিখ্যাত। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও যথেষ্ট চাহিদা। এক সময় আমদানি করা হতো। এখন হয় না, তা নয়। তবে আগের তুলনায় কম। কারণ, এখন বাংলাদেশেও চাষ হচ্ছে স্ট্রবেরির। বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত ফল সরাসরি চলে আসছে রাজধানী শহরে। ঠিক এই মুহূর্তে ফলের দোকানগুলোতে আঙুর আপেলের মতোই বিক্রি হচ্ছে স্ট্রবেরি। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে। এভাবে যত দিন যাচ্ছে, দেশীয় হয়ে উঠছে এ ফল। বিদেশী ফল নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা ও লেখালেখি করছেন মৃত্যুঞ্জয় রায়। তিনি জানান, স্ট্রবেরি এক ধরনের ফ্র্যাগারিয়া জাতীয় উদ্ভিদ। গুল্ম ও লতা জাতীয় গাছ। এর লতাপাতা মাটির উপর ছড়ানো থাকে। অনেকটা তরমুজ গাছের মতো। মাটির সংস্পর্শে লতার গিঁট থেকে শিকড় গজায়। শিকড়যুক্ত গিট কেটে নিয়ে মাটিতে পুঁতে দিলে নতুন চারা তৈরি হয়। কাঁচা ফল প্রথমে হলদে এবং ক্রমশ লালচে রং ধারণ করে। পুরো পাকলে রংটি হয় টকটকে লাল। দেখতে কিছুটা লাল মরিচের মতো। তবে একদমই ঝাল নয়। মাংসল ফল টকমিষ্টি ধরনের। সরাসরি খাওয়া যায়। এ ফল ও ফলের রস জ্যাম, আইসক্রিম, মিল্ক শেকসহ বিভিন্ন খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। স্ট্রবেরির ঘ্রাণও বিশেষ আকৃষ্ট করে। শিল্পায়িত খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এর ঘ্রাণ। যতদূর তথ্য, ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলে সর্বপ্রথম স্ট্রবেরির চাষ করা হয়। এর পর পরই দৃশ্যমান হয় চিলি, আর্জেন্টিনায়। বর্তমানে পৃথিবীর বহু দেশে চাষ হয় স্ট্রবেরির। পশ্চিমা ফল একটু দেরি করে হলেও এসেছে বাংলাদেশে। প্রচুর চেষ্টার পর এখানে স্ট্রবেরি চাষ সম্ভব হয়েছে। জানা যায়, বিপ্লবটি ঘটান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মনজুর হোসেন ও নাটোর উদ্যান তত্ত্ববিদ কামরুজ্জামান। স্ট্রবেরি নিয়ে অনেক বছর ধরে গবেষণা করেন ড. মনজুর হোসেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপানে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন স্ট্রবেরির চারা। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর গবেষণার মাধ্যমে তিনি ফলটিকে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপযোগী করে তোলেন। জাপানের একটি স্ট্রবেরি জাতকে উৎস গাছ হিসেবে ব্যবহার করে সোমাক্লোনাল ভ্যারিয়েশনের মাধ্যমে টিস্যুকালচার পদ্ধতিতে কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেন তিনি। জাতগুলো রাবি-১, রাবি-২ এবং রাবি-৩ নামে পরিচিত। তার সফল গবেষণার পর ২০০৯ সালে দেশের ৪৫ জেলার ৮ দশমিক ৫ একর জমিতে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে চাষ কর হয়। উৎপাদিত হয় ২৫ টন স্ট্রবেরি ফল। আমেরিকান স্ট্রবেরির দু’টি জাত নিয়ে গবেষণা করেন কামরুজ্জামান। সফলও হন তিনি। তাঁর দেয়া তথ্য মতে, আমেরিকান জাত ওজন বর্ণ গন্ধ ও স্বাদের দিক থেকে বিশেষ উন্নত। প্রতিটির ওজন কমপক্ষে ৭৫ গ্রাম। প্রতি গাছে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম ফল ধরে। বিঘাপ্রতি ২০ হাজার টাকা খরচ করে ২০০০ কেজি ফল পাওয়া যায়। ফলে চাষ বাড়ছে। জানা যায়, শীতপ্রধান দেশগুলো স্ট্রবেরির জন্য বিশেষ উপযুক্ত। গরমের দেশে গাছ হলেও ফলন বিলম্বিত হয়। দেশের যেসব জেলায় শীত বেশি এবং অনেকদিন স্থায়ী হয় সেসব জেলায় চাষ হচ্ছে। উত্তর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় স্ট্রবেরি ফলানো সম্ভব হয়েছে। স্ট্রবেরির চারা মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যায়। তবে নবেম্বর মাস স্ট্রবেরি চারা রোপণের জন্য সবচে ভাল সময়। গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্ট্রবেরির চারা রোপণ করা যায় তিনটি পদ্ধতিতে। এগুলো হলো ম্যাটেড সারি পদ্ধতি, প্লাস্টিকলচার বা বেড পদ্ধতি এবং রিবোন সারি পদ্ধতি। বেড পদ্ধতিতে চাষ করাই ভাল। কারণ বেডে জন্মানো স্ট্রবেরি গাছে আগাম ফুল আসে। সেচ দেয়া সহজ হয়। ফল সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি সহায়ক। ঠিক এই মুহূর্তে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ফলের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে স্ট্রবেরি। ফুটপাথের উপর ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে বিক্রেতাদের। আর কাওরান বাজারের কথা তো বলাইবাহুল্য। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই আসছে স্ট্রবেরি। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ স্ট্রবেরি আসছে রাজশাহী, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও মধুপুর থেকে। কাওরান বাজার থেকে পাইকারি কিনে নিজেদের মতো করে বিক্রি করছেন দোকানিরা। তাঁদের একজন আওয়াল জানালেন, স্ট্রবেরি বাজারে এসেছে ১৫ থেকে ২০ দিন আগে। আর কিছুদিন থাকবে। প্রতি কেজি স্ট্রবেরি ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে এখানেই শেষ নয়, দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে স্ট্রবেরি রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ স্ট্রবেরি এ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সদস্যদের মতে, ফলটি দেশে এখনও নতুন। চাষের ক্ষেত্রে ঝুঁকি দূর হয়নি। তবে যথাযথভাবে মেধা ও শ্রম প্রয়োগ করা সম্ভব হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে স্ট্রবেরি বিদেশে রফতানি করা যাবে বলে আশা তাঁদের।
×