ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

এনাফ ইজ এনাফ

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৯ মার্চ ২০১৫

এনাফ ইজ এনাফ

বাংলাদেশে এবং ভারত উপমহাদেশে মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষার ইতিহাস দুই শ’ বছরের বেশি। কালের পরিক্রমায় এখন ভাবার সময় এসেছে যে, এই মাদ্রাসায় ধর্ম শিক্ষার নামে যুগ যুগ ধরে জাতিকে প্রতিদান হিসেবে কি দিয়েছে? মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়ে কতগুলো লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ প্রথমত ব্রিটিশ আমলে রক্ষণশীল মাদ্রাসা শিক্ষার বিপরীতে নিউ স্কীম মাদ্রাসা গড়ে উঠলে মাদ্রাসা শিক্ষায় ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজী, বাংলা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান বিষয় পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই নিউ স্কীম মাদ্রাসা থেকেই বের হয়ে আসা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত মুসলমান ব্যক্তিরাই প্রধানত শিখা গোষ্ঠী গঠন করে, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, নারীর শিক্ষা ও অবগুণ্ঠন মুক্তির আন্দোলনের সূচনা করেন। বিপরীতে রক্ষণশীল মাদ্রাসাগুলো যুগের উপযোগী, যুগের প্রেক্ষিতকে বিবেচনা করে জাতির উন্নয়নে, পুরুষ-নারী, কারও এগিয়ে যাওয়ার পথে সহায়ক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম, এমন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্ম দিতে সক্ষম হয়নি। বরং এই প্রাচীনপন্থী মাদ্রাসাগুলো ‘হেফ্জখানা’ তৈরি করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে যুগের অনুপযোগী, রক্ষণশীল, অনুদার, ভেদবুদ্ধি দ্বারা চালিত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর জন্ম দিয়ে জাতি ও দেশকে দ্বিধাবিভক্ত, বিভ্রান্ত ও উন্নয়নবিরোধী কর্মতৎপরতার মাধ্যমে সমাজে জঙ্গীত্বের বীজ বপনে সহায়তা করেছে! দ্বিতীয়ত নিউ স্কীম মাদ্রাসার আদলে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার, সরকারী মাদ্রাসার কারিকুলামে ধর্মের কোরান-হাদিসের পাশাপাশি ইংরেজী, বাংলা, গণিত, বাংলাদেশের ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিজ্ঞান অবশ্য পাঠ্য হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং সেই অনুসারে সরকারী মাদ্রাসা শিক্ষার নতুন পাঠ্যবই লিখিত হয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে, এসব পাঠ্যবই মাদ্রাসাগুলোতে কতটা ব্যবহার হচ্ছে, এসব বই ব্যবহার না করে পুরনো চিন্তার বাহক মৌলানাদের পুরনো বই ব্যবহার হচ্ছে কিনা, এমন কি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, সাঈদীদের বিভ্রান্তিমূলক-যুক্তি পূর্ণ-রচনাগুলো পড়ানো হয় কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। তৃতীয়ত জঙ্গী-মৌলবাদ ও মাদ্রাসাকে কেন সম্পর্কযুক্ত ভাবা হচ্ছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ- ২০১৩-এর বিএনপি-নেত্রী খালেদার উস্কানি গ্রহণ করে মৌলানা শফির হেফাজতে ইসলামের নেতা ও অংশগ্রহণকারী তরুণ-কিশোররা সবাই হাটহাজারীসহ বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী! যদিও ঐদিন তা-ব চালিয়েছিল শিবির-জামায়াত, বিএনপির সন্ত্রাসী, অর্থাৎ, মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণরত শিশু, কিশোর, তরুণদের শিক্ষার দ্বারা নিজস্ব বুদ্ধি ও যুক্তিবোধ অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের পঙ্গু করে রাখা হয় যারা কেবলমাত্র এই ওহাবী ও পরে মওদুদীবাদী সুন্নী মুসলিমরাই প্রধানত মুসলমানদের মধ্যে গোষ্ঠী বা সেক্টরবিরোধী সাম্প্রদায়িক হানাহানির জন্ম দিয়েছে! অপরদিকে এই মৌলবাদী সুন্নীরাই আবার উদার, প্রগতিপন্থী, অসাম্প্রদায়িক মুক্তবুদ্ধির ব্যক্তিদের ‘মুরতাদ’ আখ্যা দিয়ে ‘কতল’ করার ঘোষণা দিয়ে থাকে! আশ্চর্য এই যে- পৃথিবীতে ইসলামের নামে এই সুন্নী মুসলিমরাই মুসলিম শিয়া, আহমদীয়া হত্যাকা- যেমন ঘটিয়েছে, তেমনি এরাই বাংলাদেশে ’৭১-এর আলবদর, আলশামস, রাজাকারের জন্ম দিয়ে স্বজাতির নিধনে, স্বজাতির স্বাধীনতার বিরোধিতা করে জামায়াতের নেতৃত্বে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করেছে! আশ্চর্য নয় কি যে কোন শিয়া, আহমদীয়া কোন দেশে কোন সময় সুন্নী হত্যা, খ্রীস্টান হত্যা বা হিন্দু হত্যা, আদিবাসী হত্যা সংঘটন করেনি! যা সুন্নী মুসলিমরাই বার বার করেছে ও বর্তমানে করেও চলেছে! চতুর্থত দেশে গোয়েন্দা বাহিনীও পুলিশের হাতে যত বোমা-গ্রেনেড উদ্ধার হয়েছে, দেখা গেছে তার বেশিরভাগ সুন্নী হুজুরদের দ্বারা পরিচালিত মাদ্রাসায় এগুলো তৈরি হচ্ছে। আর তৈরি করছে ঐসব মাদ্রাসার ছাত্ররাই! জঙ্গী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে বার বার নাম এসেছে চট্টগ্রামের লালখান বাজারের মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মাদ্রাসার নাম! আজ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার কোন মাধ্যমিক স্কুলে বা কলেজের নাম বা এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নাম, শিক্ষকের নাম জঙ্গী হিসেবে দেখা যায়নি! কিন্তু, ইংরেজী মাধ্যম থেকে পাস করা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের, আবার বুয়েটের শিক্ষক ও ছাত্রদের নাম জঙ্গীবাদী হিসেবে উঠে এসেছে! এখানে একটি বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছেÑ এই মাদ্রাসা ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জঙ্গী সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে। কওমি মাদ্রাসাগুলোর সংখ্যা দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় বা একটি বুয়েটের পাশে প্রায় অর্ধলাখের কাছাকাছি, যে সংখ্যাটি বলাবাহুল্য নিজেই জাতির জন্য বর্তমানে হুমকিস্বরূপ। প্রসঙ্গত এখানে ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হয়Ñ ক. মুসলমানই শ্রেষ্ঠ, ইসলামই শ্রেষ্ঠ ধর্ম! খ. সুন্নীরাই শ্রেষ্ঠ, শিয়া, আহমদীয়া, হিন্দু, খ্রীস্টান ও অন্যেরা অমুসলিম, কাফের, মুরতাদ। গ. ইসলাম যখন প্রয়োজন ‘জেহাদ’ সমর্থন করে, সুতরাং জিহাদী জঙ্গীদের ইসলাম সমর্থন করে! ঘ. অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা, আল্লায় অবিশ্বাস! ঙ. মুসলমানরা ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না, তাদের রাষ্ট্র হবে ইসলামী বা খেলাফতি রাষ্ট্র যা কোরান-হাদিস দ্বারা পরিচালিত হবে, তাগুদি বা আধুনিক সমাজ মানুষের তৈরি যুগোপযোগী আইন দ্বারা নয়! চ. ‘মুরতাদ’ হিসেবে যাদের ফারাবীর মতো নিকৃষ্ট খুনীরা চিহ্নিত করে, তাদের খুন করা ‘ইমানী’ দায়িত্ব! রাজীব হত্যাকারী নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূর্খ-নির্বোধ খুনীরা রাজীব হত্যাকে তাদের ‘ইমানী দায়িত্ব’ আখ্যা দিয়েছিল! ছ. হত্যাকা- সমাপ্ত করতে গিয়ে বলা হয় ‘বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ’। জ. মুক্তিযুদ্ধপন্থীরা অইসলামিক, সুতরাং, মুরতাদ বা কাফের কতলযোগ্য! ঝ. ব্লগাররা যারা মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, তারা ধর্মহীন, ইসলাম ও আল্লাহ বিরোধী! সুতরাং ওরা মুরতাদ অথবা কাফের! কিন্তু মুক্তবুদ্ধির ব্যক্তিদের মুরতাদ ও হত্যার জন্য চিহ্নিত করে নিজেরা ধর্মান্ধ, আধুনিক জ্ঞানে অশিক্ষিত, অশুদ্ধ ভাষায় হত্যার হুমকিদাতা জঙ্গী খুনী ব্লগাররা হলো ধার্মিক, ইসলামী ও ইসলামের রক্ষক! উপরোক্ত শিক্ষা তাদের শেখায় কাছে ইসলামী ব্যক্তি কোনক্রমেই মানবিক হতে পারে না। অর্জিত শিক্ষা শেষে এরা বর্বর হবে, জঙ্গী হবে, চাপাতি, ছুরি হবে এদের অস্ত্র, এরা বিতর্কে, যুক্তিতে বিশ্বাস করে না, এদের মূলমন্ত্রÑ হত্যা, মানবতাবাদী, উদার মুক্তমনাদের হত্যা! এরা প্রবলভাবে নারী স্বাধীনতার বিরোধী, বিরোধী নারী-শিক্ষার এবং নারীর কর্মজগতে অংশগ্রহণ, আয়-উপার্জন, পুরুষের পাশাপাশি কাজ করা! এমন কি, বাঙালী নারীর হাজার বছরের পরিধেয় বস্ত্র-পোশাক-শাড়ি এদের কাছে পছন্দ নয়, এরা পছন্দ করে পাকিস্তানী সেলোয়ার, কামিজ, ওড়না, সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যীয় মাথা ঢাকা, নাক মুখ ঢাকা হিজাব! দলে দলে বাঙালী নারীও স্বামীর পছন্দ অনুসরণে, কেউ বা নিজ পছন্দে নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যীয় সজ্জায় সাজিয়ে তুলছেন! দৈনন্দিন পরিচ্ছদ হিসেবে তরুণীরা সেলোয়ার-কামিজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেÑ তা যুগের কর্মজগতের কারণে বোধগম্য, তবে এর সঙ্গে উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যীয় ‘হিজাব’ একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাস্থ্যকর- এত বলাবাহুল্য! তবে, মুক্তমনা, মুক্তিযুদ্ধপন্থী ব্লগারদের উপলব্ধি করতে হবেÑ তাদের শত্রুপক্ষ ‘ব্লগে’ হাওয়াই লড়াই করে না, এরা চাপাতি-ছুরি দিয়ে হত্যায় শত্রুপক্ষকে বিনাশে বিশ্বাসী! এরা অন্ধকারের বাসিন্দা। এরা কখনও যুক্তিতে বিশ্বাস করে না। যুক্তিবোধ আর যাই হোক, মাদ্রাসার বন্দী জীবনে, নারী-স্বাধীনতা বিদ্বেষী শিক্ষকদের যুক্তিহীন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী শিক্ষায়, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা--আনন্দ-বিনোদনহীন পরিবেশে, এমন কি, শিক্ষকের স্নেহের উষ্ণতা বর্জিত কঠোর অনুশাসন-শাস্তির ভীতিকর পরিবেশে গড়ে উঠতে পারে না। বরং এখানে অনেক মাদ্রাসায় যা ঘটছে, বোমা-গ্রেনেড বানিয়ে, অস্ত্র চালনা শিখে, পেট্রোলবোমা বানিয়ে তা ছুড়ে নিরীহ মানুষ হত্যার শিক্ষা গ্রহণ করছে! এরাই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধনীর গৃহে বেড়ে ওঠা মূল্যবোধহীন তরুণদের মগজ ধোলাই করে হত্যার মতো বর্বর কাজে টেনে আনছে! উল্লেখ্য, সম্প্রতি পাকিস্তান জঙ্গীত্ববাদ হ্রাস করতে দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা সীমিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা খুবই যুক্তিযুক্ত। তবে, একই পাকিস্তান আবার পাশাপাশি বাংলাদেশ ধ্বংসে এখনও জামায়াত-বিএনপি নেত্রী-নেতাদের ব্যবহার করে আমাদের দেশে জঙ্গী-মৌলবাদ প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে! দু’মাসের ওপর হলো জামায়াত-বিএনপি নেত্রী পেট্রোলবোমা, ককটেল দিয়ে মানুষ হত্যা করে চলেছে যে বর্বর অপরাধের কোন কঠোর নিন্দা, প্রতিবাদ মাদ্রাসা পরিচালক-শিক্ষকরা করেনি! কেন তারা এত বর্বরতা দেখেও নীরবতা অবলম্বন করে চলেছে- এ এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন! আসলে, মাদ্রাসাগুলো গড়ে উঠেছিল প্রধানত টোলের বিপরীতে ইসলাম ধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে। পরে ব্রিটিশ আমলে এর আধুনিকায়ন করা হয় নিউ স্কীম মাদ্রাসা হিসেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ’৭১-এর স্বাধীনতার পর পর মাদ্রাসাগুলোকে মাধ্যমিক স্কুলে রূপান্তরিত করার কাজটি বঙ্গবন্ধু শুরু করতে গেলে সে সময়ের উচ্চশিক্ষিত সুশীল সমাজ বিশাল একটি শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হবেÑ এ কথা বলে তাঁকে বিরত করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সব আমলে মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত নেতারা তাদের পক্ষে মগজধোলাইয়ের কাজটি অব্যাহত রাখতে, হাজার হাজার অনুসারীর জন্ম দিতে মাদ্রাসার পরিসর বৃদ্ধি করেছে আর ইসলাম প্রচারের নামে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে লক্ষ, কোটি টাকা আনবে ঢালাও ব্যবস্থা থাকায় মাদ্রাসা পরিচালকরা ধনে-সম্পদে শক্তিশালী হয়েছে। এর সুবিধা ভোগ করেছে- ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, সাঈদী প্রমুখ! দরিদ্রের সন্তানদের মাদ্রাসা শিক্ষার নামে জঙ্গী, মৌলবাদী হওয়ার পথ রোধ করা দরকার বৈষম্য ও এ পথেই রোধ করা সম্ভব হবে। লেখক : গবেষক, শিক্ষাবিদ
×