ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হযরত মু’আয (রাদি.)

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৬ মার্চ ২০১৫

হযরত মু’আয (রাদি.)

হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহ্ তা’আলা আন্্হু মদীনার খায্্রাজ গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের হজ মৌসুমে মদীনার (তদানীন্তন ইয়াসরেব) বনূ খায্রাজ ও বনূ আউসের যে ৭৫ জন প্রতিনিধি হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে গোপনে মক্কার আকাবা নামক স্থানে সাক্ষাত করে বায়’আত হন এবং প্রিয়নবী (সা.)-কে তাঁদের জন্মভূমি ইয়াসরেব যাওয়ার জন্য দাওয়াত দেন সেই প্রতিনিধি দলে সর্বকনিষ্ঠ যে সদস্য ছিলেন তিনিই হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর। তাঁর প্রতিভাদীপ্ত উজ্জ্বল চেহারা, অপূর্ব চাহনী এবং শান্ত, অমায়িক ও ভদ্র স্বভাব দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। তিনি যখন কথা বলতেন সবাই তাঁর কথা আগ্রহ ও মনোযোগ সহকারে শুনতেন। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি এবং কণ্ঠস্বরের মধুরতা সবাইকে অভিভূত করে ফেলত। আকাবায় অনুষ্ঠিত সেই বায়’আতের রাতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর মধ্যে তেজোদীপ্ততা ও বুদ্ধিমত্তার উপস্থিতি অবলোকন করেন। বায়’আতে আকাবা বা আকাবার শপথ অনুষ্ঠান ইসলামের ইতিহাসে এক টার্নিং পয়েন্টের পথ উন্মোচন করে দেয়, হিজরতের জন্য একটি উপযুক্ত জনপদের নিশ্চয়তা বিধান করে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যে খেজুর বাগানওয়ালা জনপদে হিযরত করার প্রত্যাদেশ ইতোপূর্বে লাভ করেছিলেন সত্যি সত্যি তা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে গেল। হজ শেষে অন্যদের সঙ্গে হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.) মদীনায় ফিরে গেলেন অন্তর গভীরে নবী দর্শনের এক অনন্য আনন্দ অনুভব নিয়ে। এর আগের বছরেও মদীনার কিছু লোক এসে এই আকাবাতে হজ মৌসুমে প্রিয়নবী (সা.)-এর কাছে বায়’আত হয়েছিলেন। তাঁদের সংখ্যা ছিল বারো। এই আকাবার বায়’আতকে দ্বিতীয় আকাবা বলা হয়। তার আগের বছর অর্থাৎ ৬২০ খ্রিস্টাব্দে ওই একই মৌসুমে মদীনার ছয়জন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি বায়’আত হয়ে মদীনা ফিরে গিয়েছিলেন। এটাই আকাবার প্রথম বায়াআত বা শপথানুষ্ঠান। তৃতীয় আকাবা বা শেষ আকাবার শপথে মদীনার ৭৩ জন পুরুষ ও দু’জন মহিলা ছিলেন। এই দলেই হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.) ছিলেন। জিলহজ মাসের শেষের দিকে প্রিয়নবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গোপনে একজন, দু’জন করে মদীনায় হিযরত করতে বললেন। সাহাবায়ে কেরাম হিযরত করতে লাগলেন। ওদিকে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন আহলে মদীনা বা মদীনার বাসিন্দাগণ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রাদি.) তাঁর আম্মা হযরত উম্মু আবদ রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হাকে নিয়ে মদীনা গেলে হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.) তাঁদের মেহমান হিসেবে নিজ বাড়িতে স্থান দিলেন। প্রিয়নবী (সা.) এরই কিছুদিন পরে রবিউল আউয়াল মাসে হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাদি.)-সহ মদীনায় হিযরত করেন। হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্যে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ মোতাবিক দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমাদানে সংঘটিত বদর যুদ্ধে তিনি শরিক হন। এই সময় তাঁর বয়স মাত্র ২০ বছর। এরপর প্রিয়নবী (সা.)-এর সেনাপতিত্বে যতগুলো যুদ্ধ (গাথ্্ওয়া) বা অভিযান পরিচালিত হয়েছে তার প্রায় সবকটিতেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসে মক্কা বিজয় হলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কিছুদিন এখানে অবস্থান করেন এবং মক্কা মুকাররমায় ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করেন। এটাই ছিল মক্কা মুকাররমায় প্রথম ঈদ-উল-ফিতর। তিনি খবর পান একদল বিদ্রোহী হুনায়নে সমবেত হয়ে মক্কা আক্রমণ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। তিনি প্রায় ১৪ হাজার মুজাহিদের এক বাহিনী নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য হুনায়ন অভিমুখে রওনা হন। এই সময় তিনি হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুকে মক্কা মুকাররমায় রেখে যান তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। মক্কার লোককে তিনি এই সময় ইসলামের নানা বিষয়ে তা’লীম দেন। ৬ সওয়াল হুনায়নে যুদ্ধ হয়। অতঃপর বিজয়ী বেশে প্রিয়নবী (সা.) হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.)-কে ইয়ামানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.)-কে ইয়ামানে পাঠানোর পূর্বে তাঁকে কিছু নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই সব নির্দেশনার মধ্যে ছিল লোকজনের সঙ্গে কোমল আচরণ করবে, তাদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করবে না। তাদের সুসংবাদ শোনাবে, ভয়ভীতি প্রদর্শন করবে না (বুখারী শরীফ)। হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.)-কে ইয়ামান অভিমুখে রওনা করে দেয়ার সময় তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, মু’আয! তুমি কিভাবে বিচারকার্যাদি সম্পন্ন করবে? মু’আয (রাদি.) বললেন : আমি বিচার-আচার করব আল্লাহ্্র কিতাব অনুযায়ী। হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : যদি আল্লাহ্্র কিতাবে কোনো সমস্যার সমাধান না পাও? হযরত মু’আয (রাদি.) বললেন, তখন আমি রসূলুল্লাহর সুন্নতের অনুসরণ করব। হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : যদি আল্লাহর রাসূলের সুন্নাতে না পাও? হযরত মু’আয (রাদি.) তখন বললেন : আমার বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে ইজ্তিহাদ করব। এ কথা শুনে হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) দারুণ খুশি হলেন এবং হযরত মু’আয (রাদি.)-এর বুকে মৃদু করাঘাত করে বললেন : যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ্্র যিনি রসূলুল্লাহর দূতকে তওফীক ইনায়েত করেছেন (মিশ্্কাতুল মাসাবীয়, তিরমিযী শরীফ)। এখানে উল্লেখ্য যে, শরী’আতের কোন ব্যাপারে সুষ্ঠু জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে সর্বাঙ্গীন বিচার-বিশ্লেষণ ও চেষ্টা করার নামই ইজ্তিহাদ। হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.)-এর উপরিউক্ত কথাগুলোর মধ্যেই ইজ্তিহাদের তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইসলামের পূর্ণতা দান করে তাঁর রফীকুল আ’লা আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহুর একান্ত সান্নিধ্যে চলে গেলেন। এই সময় হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহ তা’আলা আন্্হু ইয়ামানে ছিলেন। কয়েক দিন পর তিনি এই খবর পেয়ে দ্রুত মদীনা মনওয়ারায় আসেন। তখন খিলাফতের দায়িত্বে সমাসীন হযরত আবুবকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.) সম্পর্কে বলেছেন : হালাল-হারাম সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী হচ্ছেন মু’আয ইবনে জাবাল (তিরমিযী শরীফ)। হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহুর কাছে লোকজন বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানলাভ করার জন্য আগমন করতে থাকে। জানা যায়, তিনি একটি মাদ্রাসা স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে থাকেন। হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহু ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আমীরুল মুমিনীন খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ফারুক (রাদি.) হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহু কুরআন ও হাদিসের ইলম, বিদ্যা-বুদ্ধি এবং ইলমে ফিকহ সম্পর্কিত পর্যাপ্ত জ্ঞানের জন্য তাঁর পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করতেন। তিনি বলেছেন : কারও যদি দ্বীন ও ফিকাহ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের আগ্রহ জন্মায় সে যেন মু‘আয ইবনে জাবালের কাছে যায়। হযরত আবু হুরায়রা (রাদি.) বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদিসে আছে যে, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : মু‘আয ইবনে জাবাল উত্তম লোক (তিরমিযী শরীফ)। হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : তোমরা কুরআন শিক্ষা করবে ইবনে মাস’উদ, উবাই ইবনে কা’ব, মু’আয ইবনে জাবাল এবং আবূ হুযায়ফার আযাদকৃত দাসি সালিমÑ এই চারজনের কাছ থেকে (তিরমিযী শরীফ)। হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.) প্রিয়নবী (সা.)-এর নিকট ওহী নাযিল হলে যেসব সাহাবী প্রিয়নবী (সা.)-এর কাছ থেকে শুনে তা লিপিবদ্ধ করতেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন। হযরত উমর (রাদি.)-এর সময় পারস্য ও রোমানদের বিরুদ্ধে যেসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং এলাকার পর এলাকা জয় হয়েছে সেসব যুদ্ধে হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু বিশেষ অবদান রাখেন। প্রধান সেনাপতি হযরত আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহু মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.)-কে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু তিনিও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৭ বছর কয়েক মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি দায়িত্ব দেন হযরত আমর ইবনুল আস (রাদি.)-কে। হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদি.)-এর মাযার রয়েছে জর্দানের আসওয়াস অঞ্চলে ও আল কাসীরুল মু’আয়নীতে। তাঁর থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ১৫৭। লেখক ঃ পীরসাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
×