ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কেনী কুইয়া

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১ মার্চ ২০১৫

স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি দিন

অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম আমার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিকথা লিখব। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। আমরা পাঁচ ভাইবোন এবং বাবা-মা। ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় আমি। থাকি চট্টগ্রামের জামালখান লেনের আবুল কাশেম চৌধুরী সাহেবের বাসায়। গলির সামনেই ডিসি হিল। পেছনে একটা ক্লাব ছিল, খুব সম্ভবত ন্যাভাল অফিসারদের ক্লাব। দিনটা ছিল ২৫ মার্চ, ১৯৭১। মধ্যরাত, সবাই ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ হাতে একটা হ্যাঁচকা টান লাগল। ঘুম ভেঙ্গে গেল। চেয়ে দেখি বাবা হাত ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। তখন শুনতে পেলাম বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে দেখলাম যেন আতশবাজি পোড়ানো হচ্ছে। পরে জেনেছি ওগুলো ছিল ফ্লেয়ার। বাবা সবাইকে খাটের নিচে পাটি বিছিয়ে শুইয়ে দিলেন। একটু পরেই কে যেন দরজায় প্রচণ্ড জোরে আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে বলছিল, ‘দাদা, দরজাটা খুলেন, দরজাটা খুলেন।’ বাবা গিয়ে দরজাটা খুলতেই আমাদের গলির সামনের বড় মুদির দোকানের মালিক ও তাঁর পরিবারের সবাই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন ঘরে। উনারা হিন্দু ধর্মালম্বী ছিলেন। খুবই অমায়িক ছিলেন পরিবারের সকলে। দুই পরিবারের সব ছেলেমেয়ে খাটের নিচে আর বড়রা খাটের সামনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। বড়রা সবাই সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলেন। প্রচণ্ড ভয়ে বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা ধুঁকপুক করে লাফাচ্ছিল। কিভাবে যে রাত কেটে ভোর হয়েছিল জানি না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরপর সবাই চাল, ডালসহ অন্যান্য মজুদযোগ্য খাবারদাবার কিনে রেখেছিল সামনের দিনগুলোর জন্য। সবাই মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য। একটা থমথমে কিন্তু সাংঘাতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চারদিকে। ২৬ তারিখ সকালে রেডিওতে শুনলাম ঢাকার অবস্থা। পাক হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। চট্টগ্রাম তখনও মুক্ত। আমি এবং খোকন (বাড়িওয়ালা কাশেম সাহেবের ছেলে, আমার সমবয়সী) বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক দৌড়ে গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। তখন সকাল ১০টা কী ১১টা হবে। রাস্তা লোকে লোকারণ্য। জায়গায় জায়গায় জটলা পাকিয়ে আলোচনা হচ্ছে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। প্রচণ্ড উত্তেজনা সবার মধ্যে। দেখি গলির মুখের বড় রাস্তার ওপরের রেস্টুরেন্টের সামনে একটা ট্রাক দাঁড়ানো। ট্রাকটা বোঝাই করা হচ্ছে নান রুটি আর ভাজি/তরকারি দিয়ে। নিয়ে যাওয়া হবে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রাখা লাখো মানুষের জন্য। সেকি উত্তেজনা! আরেকটু এগিয়ে গেলাম জামালখান রোড ধরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের দিকে। হঠাৎ মমিন রোডের দিক থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা ট্রাক এসে থামল আমাদের সামনে। আমাদের সঙ্গে আরও অনেক মানুষ ছিল। ধপাধপ করে ৮-১০টা গুলির বাক্স আর কয়েকটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল ফেলে দিল রাস্তার ওপর। ‘এগুলো দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ভাইয়েরা’ বলে উঠলেন একজন সৈনিক। বলেই সাঁ করে চলে গেল ট্রাকটা। একটা ছেলে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আন্দরকিল্লাত বন্দুকর দোয়ান লুট অর (আন্দরকিল্লায় বন্দুকের দোকান লুট হচ্ছে)।’ এ কথা শোনামাত্র আমরা যারা ওখানে ছিলাম প্রায় সবাই দিলাম দৌড় আন্দরকিল্লার দিকে। মাত্র মাইলখানেক দূরে ওখান থেকে। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। এলাকাটা গিজগিজ করছে লোকজনে। দেখলাম শুধু বন্দুকের দোকানই নয়, আশপাশের প্রায় সমস্ত দোকানই লুট হচ্ছে। সমস্ত জেল খুলে দেয়া হয়েছিল, তাই প্রচুর কয়েদিও দেখলাম লুট করছে। চারদিকে প্রচণ্ড উত্তেজনা। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। দুই বাক্স রাইফেলের কার্তুজ নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। বেশ ভারি বাক্সগুলো। কাশেম সাহেবের (বাড়িওয়ালা) বন্দুক ছিল। যতদূর মনে পড়ে দুটো বন্দুক, একনলা এবং দোনলা। ওনার বন্দুকের জন্যই কার্তুজগুলো আনা। ইতোমধ্যে পাড়ার অনেক পরিবার দেশের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় আমাদের বসার ঘরে আমার বাবা, কাশেম সাহেব, আরেক ভাড়াটিয়া সার্কেল অফিসার এবং আরও তিন-চারজন মিলে রেডিওতে বিবিসি আর কলকাতার আকাশবাণীর খবর শুনছিলেন মনোযোগ দিয়ে। আমিও বসার ঘরের ভেতরের দিকের দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছিলাম ঢাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের কথা। ঘরের ভেতরে দম বন্ধ করা একটা টানটান উত্তেজনা। আমরা সবাই যেন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গিয়ে খবরের প্রত্যেকটা শব্দ গিলে খাচ্ছিলাম। খবর শোনার পর সবাই কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে যার যার বাসায় চলে গেলেন। পরদিন ২৭ মার্চ। শহরের মানুষ এখনও বাক্স-পেটারা নিয়ে স্রোতের মতো গ্রামের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। গতকালের মতো আজও শহরের হোটেল-রেস্তরাঁগুলো ট্রাকভর্তি করে খাবার পাঠাচ্ছে ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রাখা জনতার জন্য। তখন বিকেল বেলা। আমরা ছেলেমেয়েরা ঘরের সামনের উঠোনের মতো জায়গাটাতে কেউ খেলছিলাম, কেউবা গল্প করছিলাম। বড়রা বারান্দায়, ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। হঠাৎ ব্রাশ ফায়ারের প্রচণ্ড ঠাঠাঠাঠা শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠল। সঙ্গে আরও নানারকম গুলির কানফাটা আওয়াজ। উঠোনের এক পাশের বড় কাঁঠাল গাছটার উপরিভাগে মনে হলো মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আসলে কিছু গুলি গাছটার ওপরের অংশের পাতা ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বড়দের কেউ চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘সবাই ঘরে ঢুকো, সবাই ঘরে ঢুকো জলদি।’ এক দৌড়ে সবাই যার যার ঘরে ঢুকে পড়লাম। ঘরের দরজা বন্ধ করে সবাই খাটের নিচে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের-মধ্যেই গুলির প্রচণ্ডতা কমে এলো। মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ। যখন গুলির শব্দ নেই তখন চারদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা। কেমন যেন ভুতুড়ে থমথমে অবস্থা। প্রায় আধা ঘণ্টা পরে খুব সাবধানে ইতিউতি তাকিয়ে আস্তে আস্তে সবাই যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কাশেম সাহেব এবং অন্য ঘরের পুরুষরা আমাদের বসার ঘরে এসে বসলেন। সবার আলোচনার বিষয় হলো পরবর্তী করণীয় নিয়ে। একজন বললেন, বঙ্গবন্ধু ২৫ তারিখ রাতেই নাকি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি নাকি ঘোষণার সাইক্লোস্টাইল করা লিফলেটও দেখেছেন। এরই মধ্যে একজন খবর নিয়ে এলো আমাদের গলির সামনে বড় রাস্তায় ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী নাকি মরে পড়ে আছে গুলি খেয়ে। কয়েকটা গাড়ি করে তারা মমিন রোড ধরে যাচ্ছিল কোথাও। একেবারে সামনাসামনি পড়ে যায় পাকিদের। ঘরের মধ্যে একজন আমাদের মারফি ট্রানজিস্টার রেডিওটা নিয়ে বিভিন্ন স্টেশন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর শোনার চেষ্টা করতে লাগলেন। হঠাৎ একটা স্টেশন থেকে একজনের ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। যিনি রেডিওর নবটা ঘোরাচ্ছিলেন তিনি বলে উঠলেন, ‘সবাই চুপ করেন, সবাই চুপ করেন।’ ঘোষণাটা আরও একবার প্রচারিত হলো, ইংরেজীতে। “On behalf of our great national leader, the supreme commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, do hereby proclaim the independence of Bangladesh…|” কে একজন বলে উঠলেন, ‘এই মেজর জিয়াটা আবার কে?’ ‘আরে বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নিশ্চয়ই’ আরেকজন উত্তেজিত এবং খুশি হয়ে বলে উঠলেন। সবাই নিচু গলায় কিন্তু উত্তেজিত স্বরে কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন। আমি সরে গেলাম ওখান থেকে। পরদিন সকাল বেলা নাস্তা খাওয়ার পর বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা কয়েক বন্ধু এক দৌড়ে বড় রাস্তার ওপর এসে উঠলাম। সারা রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাধারণ মানুষের লাশ। ছেলে, বুড়ো, মহিলা, শিশু, কেউ বাদ যায়নি। (চলবে)
×