ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পেট্রোলবোমায় পুড়িয়ে হত্যা অপরাধ ॥ বিচার চায় এ্যামনেস্টি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

পেট্রোলবোমায় পুড়িয়ে হত্যা অপরাধ ॥ বিচার চায় এ্যামনেস্টি

বিডিনিউজ ॥ অবরোধে গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড’ বলে নাশকতাকারীদের বিচারের দাবি জানিয়েছে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। মানবাধিকার সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক আব্বাস ফয়েজ বলেছেন, “এগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। যারা একবার এগুলো করছে তারা অপরাধী (ক্রিমিনাল) এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।” মঙ্গলবার লন্ডনে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেন আব্বাস ফয়েজ। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলমান বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধে সহিংসতায় হতাহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানান তিনি। গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা মনে করি এইসব হামলা বা হামলার প্ররোচনার পেছনে কিছু রাজনৈতিক নেতার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।” নাশকতার সময় হাতেনাতে গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই বিএনপি কর্মী উল্লেখ করে ‘আগুন হামলা’ থেকে কর্মীদের বিরত রাখতে বিএনপিকে আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেয়ার কথা তুলে ধরেন আব্বাস ফয়েজ। তিনি বলেন, তাদের উচিত গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ থেকে কর্মীদের বিরত রাখা এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ডে কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করা। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় এ্যামনেস্টির এই কর্মকর্তা বলেন, গত বছর সেপ্টেম্বর-আগস্টের দিকে বাংলাদেশে ‘গুম’সহ অন্যান্য নির্যাতন কমে এসেছিল। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব সদস্যদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ ছিল ইতিবাচক। তবে সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আবারও ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে উদ্বেগ জানান তিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তিনি বলেন, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চায়। তবে তারা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইরান ও সার্বিয়ায়ও মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে তারা বিবৃতি দেন জানিয়ে আব্বাস ফয়েজ বলেন, তাই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে এ্যামনেস্টির যে সমালোচনা হয় তা ঠিক নয়। বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার ও কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার, ব্যবসায়ী ও কারখানা মালিকদের মতো পশ্চিমা ক্রেতাদেরও দায়িত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। পশ্চিমা ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাক কারখানা থেকে পোশাক নিয়ে অনেক অর্থ আয় করলেও তারা শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে ততটা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাসে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে মন্তব্য করেন আব্বাস ফয়েজ। বাংলাদেশে গণমাধ্যমও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন তিনি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ॥ বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতন এবং তার বিচার না হওয়ার কথা বলেছে। বিশ্বের ১৬০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে এ্যামনেস্টির এই প্রতিবেদনে। সেখানে মূলত ২০১৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং ২০১৩ সালের মানবাধিকার-সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় এসেছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির আলোচনায় বলা হয়েছে, কয়েক ডজন মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে, নারীর প্রতি সহিংসতা এখনও বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্যাতন চালিয়ে দায়মুক্তি পাচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তা না থাকায় কারখানা শ্রমিকরা এখনও ঝুঁকিতে রয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপীলের কোন সুযোগ না দিয়ে অন্তত একজনের দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও অনেকের মতে বাংলাদেশে ৮০ জনের বেশি মানুষকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করা হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে অপহৃত ২০ জনের মধ্যে নয়জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, ছয়জন কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর বাড়ি ফিরেছেন এবং বাকি পাঁচজনের কোন খবর পাওয়া যায়নি। গত বছর এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে ধরে নিয়ে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে এতে জড়িত র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিচারের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে। এ্যামনেস্টির ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের পর এই প্রথম বাহিনীটির সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত বছর পাস হওয়া তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার সমালোচনা করে এ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, এতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, সুব্রত অধিকারী শুভ, মশিউর রহমান বিপ্লব ও রাসেল পারভেজ এবং ‘অধিকার’র আদিলুর রহমান ও নাসিরুদ্দিন ইলানের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা এখনও বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলেছে- সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শুধু ২০১৪ সালের অক্টোবরেই ৪২৩ জন নারী ও মেয়ে শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ১০০ জন ধর্ষিত হয়েছেন, ধর্ষিতদের ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে; যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় ৪০ জনের বেশি নারীকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে, যাদের ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নারী ও শিশুরা ঘরের মধ্যে নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি এসিড হামলার শিকার হয়েছে। পাচারও হয়েছেন অনেকে। এ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। পেটানো, ঝুলিয়ে রাখা, বৈদ্যুতিক শক দেয়ার এসব নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ে পুলিশ হেফাজতে অন্তত নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিক অধিকার নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, কারখানা এবং অন্যান্য কর্মস্থলে নিরাপত্তার মান বিপজ্জনকভাবে খারাপ। রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু এবং তাজরিন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের যে সহায়তা দেয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয় বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
×