ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাটুরিয়ায় লঞ্চডুবি

২২ ঘণ্টা পর লঞ্চ উদ্ধার ॥ ৬৯ লাশ হস্তান্তর

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

২২ ঘণ্টা পর লঞ্চ উদ্ধার ॥ ৬৯ লাশ হস্তান্তর

নিজস্ব সংবাদদাতা, মানিকগঞ্জ ও কুষ্টিয়া, ২৩ ফেব্রুয়ারি ॥ রবিবার মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট থেকে দৌলতদিয়া যাওয়ার পথে সার বোঝাই কার্গোর ধাক্কায় ডুবে যাওয়া যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মোস্তফাকে ২২ ঘণ্টা পর সোমবার সকাল ১০টার দিকে উদ্ধার করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস আনুষ্ঠানিকভাবে লঞ্চ উদ্ধার কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। নারী, শিশু-পুরুষসহ ৭০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ৬৯টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ডুবে যাওয়া লঞ্চ ও আটককৃত কার্গোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা তিনি জানিয়েছেন। বিকেলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী দুর্ঘটনাস্থল ও লঞ্চটি পরিদর্শন করেন। গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। রবিবার রাত সাড়ে ১১টায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম পাটুরিয়া ঘাটের দুর্ঘটনা স্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। রাত ৪টার দিকে ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকে পাটুরিয়া ঘাটের দুই কিলোমিটার ভাঁটিতে (দড়িকান্দি) এলাকায় নিয়ে পদ্মার কিনারে ভিড়িয়ে রাখা হয়। এ সময়ে ২৩টি লাশ উদ্ধার হয়। সকাল ১০টার দিকে লঞ্চটিকে পুরোপুরি পারে তোলা হলে ভেতর থেকে সর্বশেষ আরও ৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার কাজে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী ও বিআইডাব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড ও মানিকগঞ্জ রেডক্রিসেন্টের কর্মীরা অংশ নেন। এরপর ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী ও বিআইডাব্লিউটিএর তিন জন উদ্ধারকারী ভিতরে ঢুকে শেষ তল্লাশি করে এসে তাদের কর্মকর্তাদের জানান লঞ্চের ভিতরে আর কোন লাশ নেই। কমফোর্ট লাইন ও রাজধানী এক্সপ্রেস বাসের দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ যাচ্ছিল। সকাল সাড়ে ১০টায় পাটুরিয়া ঘাটে জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমে জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও বিআইডাব্লিউটি-এর কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে লঞ্চ উদ্ধার কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তবে তিনি জানান, আরও কোন নিখোঁজ লাশ ভেসে উঠে কিনা এজন্য আরও কয়েক দিন উদ্ধারকারী তিনটি দল পাটুরিয়া ঘাটে অবস্থান করবেন। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে ৬ জন নিখোঁজের কথা জানা গেছে। এরা হলেনÑ মোস্তফা মাহফুজ কদমতলী ঢাকা ব্র্যাক কর্মকর্তা, আবুল হোসেন তেওতা শিবালয় মানিকগঞ্জ, মারুফা খাতুন দলিলপুর ঝিনাইদহ, জুয়েল রানা ভাংগা ফরিদপুর, সোরহাব দাসকান্দি শিবালয় মানিকগঞ্জ, লিপি কুমারখালী কুষ্টিয়া। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকজনকে দেখা গেছে যারা তাদের কোন খোঁজ পায়নি। এদিকে দুর্ঘটনার পর পাটুরিয়া নৌ-পুলিশ কার্গোটি আটক করে চালক ইকবাল ও তিন কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে। এদের বিরুদ্ধে দ-বিধি ২৮০ ও ৩০৪ এর ‘ক’ ধারায় শিবালয় থানায় মামলা হয়েছে। লঞ্চচালক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও একই ধারায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। তবে লঞ্চচালকের কোন পরিচয় এখনও জানা যায়নি। ২৪.৮ মিটার লম্বা, ৫.৩০ মিটার প্রস্থ ও ১.৭০ মিটার গভীরতার লঞ্চটির ধারণ ক্ষমতা ১৪০ থাকলেও বহন করছিল অতিরিক্ত যাত্রী। ডুবে যাওয়া লঞ্চটির বেঁচে যাওয়া কয়েকজন যাত্রী জানিয়েছিলেন, লঞ্চটিতে দেড়শ’ এর উপরে যাত্রী ছিল। নিহত যাত্রীরা কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর জেলার অধিবাসী। নিহত ৭০ জনের মধ্যে ২৭ জন পুরুষ, ৩০ জন মহিলা ও ১৩ জন শিশু রয়েছে। সোমবার দুপুর পর্যন্ত পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৬৯ জনের মরদেহ তাদের স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে বয়সী নারীর লাশের এখনও দাবিদার আসেনি। এরা হলেন, কুষ্টিয়া জেলার মধুসূদন সাহা (৩০), নাছির হোসেন (৪০), মেহেদি হাসান বাপ্পী (৩০), মোস্তফা খাতুন (৩৩), বিথী খাতুন (১৫), আসাদুল (২০), ইনামুল হক (১৮), ইমামুল (১৮), মদিনা (৭০), রাইছান হক (২), ডলি খাতুন (৩৪), গোলাম মোস্তফা (৫৫), নবনীতা পাল (২৮), নায়না (৬), ফাতেমা (২), শরিফুল ইসলাম (২৪), শরিফ (২৪), বানেজ আলী (৫৫), সাগু (২৫) রয়েছে। রাজবাড়ি জেলার নবিজান (৬৫), হালিমা বেগম (৪৫), অসিমা রানী (৪০), নাসিমা আক্তার (৩৬), রহমান (৫৪), ইনামুল (১৪), নুশরাত (১৮ মাস), মনজিলা বেগম (৪৫), রতœা আক্তার, উৎসব (৭), সাফেরা (৫০), ফাতেমা (২), রেখা রানী হালদার (৪৭), হালিমা বেগম (৪৫), মঞ্জিলা বেগম (৪৪), হলিমা বেগম (৪৪), রুমা (২৫), উৎস (৭), সাফেরা বেগম (৫০), রেখা মালাকার (৪৭), জয়নাল শেখ (৫০)। মানিকগঞ্জ জেলার লতা (২২), আবুল কাশেম (৪৫), অঞ্জলী সূত্রধর (৬০), ইমরান, সেলিম (২২), হোসাইন মোল্লা (১৮ মাস), রতন সরকার (১৮)। গোপালগঞ্জ জেলার নোয়াব শেক (১৩ মাস), শাহানাজ (৪৫), রীনা বেগম (২৭) ও নড়াইলের আমেনা বেগম (৩৫), হাফসা (৮), হোসাইন কবির (২৮), কেয়া মনি আদুরি (৭), নীলফামারীর রিয়া মনি (৩), পাবনার ফজলুর রহমান (৫৪), শেরপুরের লিটন মোল্লা ((৩০)। ফরিদপুর জেলার পাপন (৫), রতন সরকার (৩৪),স্বপন সরকার (৫০), চম্পা রানী (৫৮), অর্চনা মালো, নারগীস আক্তার, শারমিন (২৫), মারজানা (০৬), দেবনাথ মালো (৫৫), অনিমা মালো (৪৫), মমতা বেগম (৪৭) রয়েছে। ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার, সুফিয়া (২৮), ফারজানা স্মৃতি (৪৫ দিন), কুমিল্লার আবুল হাসেম। এর আগে ২০০৫ সনে পাটুরিয়ার উজানে আরিচা ঘাট এলাকায় লঞ্চডুবিতে ৬৫ জন মারা গিয়েছিল। মা-মেয়ের লাশ দাফন ॥ সংবাদদাতা, বোয়ালমারী, ফরিদপুর থেকে জানান, পদ্মায় লঞ্চডুবির ঘটনায় গতকাল সোমবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের ধর্মহাটি গ্রামের মোঃ মুরাদের স্ত্রী শারমিন আক্তার (৩০) আর মেয়ে মারজানা সুলতানাকে (৭) সোমবার জোহর নামাজ বাদ জানাজা শেষে ভীমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে দুপুরে লাশ এসে পৌঁছালে এ সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। রবিবার পদ্মায় লঞ্চডুবির ঘটনায় মা মেয়ের একসঙ্গে সলিল সমাধির এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে মারজানার পিতা ওই দিনই ছুটে যান পদ্মার পাড়ে। তাদের সঙ্গে থাকা মারজানার মামা এনামুলও মারা যায়। তাঁর লাশ দাফন করা হয় বালিয়াকান্দি উপজেলার বেতেজ্ঞা আরকান্দি গ্রামের নিজ বাড়িতে।
×