ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সরদার সিরাজুল ইসলাম

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ভাষা আন্দোলন  ও বঙ্গবন্ধু

১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য দুটি আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। সে সুবাদে বাঙালী মুসলমানদের প্রত্যাশা ছিল স্বাধীন পূর্ববাংলার এবং সে জন্য ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলার জনগণ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম লীগকে ভোট দেয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ বড়লাট ভারত বিভাগ এবং পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে এক পাকিস্তানের পরিকল্পনায় পূর্ববাংলা মুসলিম ছাত্র সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সে অবস্থায় তা রোধ করার কোন উপায় ছিল না, কেননা তখন ধর্মপ্রাণ সাধারণ বাঙালী মুসলমানরা ছিল পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর। দেশ বিভাগের পূর্বে ছাত্রদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৭ সালের আগস্টে এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মাত্র একুশ দিনের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর কমরুদ্দিন আহাম্মদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নুরুদ্দিন আহম্মদ, আবদুল অদুদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হয়। এর কারণ ছিল বাঙালীর ভাষা, কৃষ্টির প্রতি সম্ভাব্য হামলার প্রতিরোধ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা। এরা আগেই অনুমান করেছিলেন মুসলমানদের জন্য দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসবে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বদলে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে। উল্লেখ্য যে, কলকাতায় ছাত্রদের দুটি গ্রুপ ছিল। একটি শেখ মুজিব, অপরটি শাহ আজিজের নেতৃত্বে। ঢাকায় এসে শাহ আজিজ গ্রুপ সরকার সমর্থক হয়ে যায়, কিন্তু শেখ মুজিবের অংশ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক সভায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে পুনর্গঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’-এ লিখেছেন, ‘ওই সভায় শেখ মুজিব উপস্থিত না থাকলেও তাঁকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করা হয়। শেখ মুজিব তা শুধু মেনেই নেননি, বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।’ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক জন্মের আগেই এবং তা ১৯৪৭ সালের ১৮ মে প্রকাশ্যে লাহোরে হায়দ্রাবাদে উর্দু সম্মেলনে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের ঘোষণা ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা’ (দৈনিক আজাদ, ১৮ মে ১৯৪৭)। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর মর্নিং নিউজ পত্রিকায় এক সংবাদে প্রকাশ করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ করা হয়। কায়েদে আযম সকাশে জমিয়ত প্রতিনিধিদের স্মারকলিপিতে ‘পূর্ববঙ্গের জনগণ উর্দুর সমর্থক বলে দাবি করা হয়’ (দৈনিক আজাদ, ২৬ মার্চ ১৯৪৮)। বাঙালী প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নির্দেশে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে একটি পত্র লেখেন। তাতে বলা হয়, ‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা বাংলা ভাষায় উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করতে চান এবং এর জন্য তাঁর সাহায্য পেলে তাঁরা উপকৃত হবেন।’ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চিঠির জবাব দেননি এবং তাঁর মর্ম সংবাদপত্রে প্রেরণ করেনÑ যা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তৎকালীন প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার প্রাদেশিক পরিষদে ৮ এপ্রিল ১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলায় সরকারী অফিস ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষা চালুর বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং বাংলা আরবী হরফে লেখার পক্ষে জোর প্রস্তাব রাখেন। (বশির আল হেলাল প্রণীত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃঃ ৬১৯)। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভায় ভাষার দাবিতে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বানে সম্মিলিত এক বিবৃতিতে সই করেন শেখ মুজিব, নইমুদ্দিন আহম্মদ, আবদুর রহমান চৌধুরী। ওইদিন পিকেটিং করেন শামসুল হক, শেখ মুজিব, অলি আহাদ প্রমুখ এবং সে সময় তাঁরা বন্দী হন। কিন্তু প্রতিবাদ মিছিল বের হয় বেলা দুটোর দিকে। ১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমন উপলক্ষে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ১৫ মার্চ ১৯৪৮। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নেন, এমনকি নিজ হাতে লিখে নিম্নলিখিত শর্ত যোগ করেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা জেলখানায় বন্দী নেতাদের দাবিগুলো দেখান এবং তাঁদের অনুমতিক্রমে গ্রহণ করেন। এসব দাবিতে ছিলÑ ১। অদ্য পাঁচ ঘটিকায় সকল রাজবন্দীর মুক্তি। ২। ইত্তেহাদ, স্বাধীনতা ও অন্যান্য খবরের কাগজের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওইদিনই তুলে নেয়া। ৩। আজই ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে। ৪। আজই ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অনুমোদনসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে। ৫। পুলিশী নির্যাতনের জন্য ইনকোয়ারি কমিশন করা এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। ৬। যে সকল গু-া শ্রেণীর লোক আন্দোলনে ছাত্রদের মারপিট করেছে তাদের শাস্তি দেয়া হবে। ৭। এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কোন ছাত্র বা অন্য কাউকে ‘ভিকটিম’ করা হবে না। উপরোক্ত দাবিগুলো ছাত্রদের আগেই তৈরি করা ছিল। আলোচনার সময় আরও যে নতুন দাবি ওঠে তা খাজা নাজিমুদ্দিন নিজ হাতে লিখে ৮ নম্বর শর্ত বলে মেনে নেন। ৮। সংগ্রাম পরিষদের সহিত আলোচনার পর এই মর্মে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যেÑ এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই চুক্তি ছিল ভাঁওতাবাজি। জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমনকে নিষ্কণ্টক করাÑ যাতে ওই সময় কোন আন্দোলন না হয়। কিন্তু জিন্নাহ সাহেবকে বাংলা ভাষার ব্যাপারে তাঁর ওই চুক্তির কথা খাজা নাজিমুদ্দিন হয় কিছু বলেননি, না হয় তাঁকে রাজি করাতে পারেননি। এমনকি খাজা নাজিমুদ্দিন যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখনও উর্দুর পক্ষে ওকালতি করেন। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এসে রেসকোর্স ময়দানে সদম্ভে ঘোষণা করে বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহ সাহেব একই কথার প্রতিধ্বনি করেন ২৪ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন উৎসবে। জিন্নাহ সাহেবের সে উক্তির যথাযথ প্রতিবাদ করেন সমবেত ছাত্র-জনতা। তাঁর সেই উক্তি বাঙালী জনগণের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি কেঁপে ওঠে এবং আন্দোলনের ধারা তীব্রতর হয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের চুক্তি মোতাবেক ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিব প্রমুখরা মুক্তি পান। ওই সময় অন্যান্য বন্দী রণেশ দাশগুপ্ত, ধরণী রায় প্রমুখের অন্য মামলার অজুহাতে মুক্তি দিতে সরকার অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বন্দীরা বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে চাপাচাপি করলে ১৫ মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত ও ধরণী রায়কে বন্দীদের সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়। (বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসÑমোহাম্মদ হান্নান, পৃঃ ৪২)। পরদিন ১৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভা হয়। সভায় ১৫ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তার কিছুটা সংশোধন করা হয়Ñ ১। ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি করাÑ ২। পরিষদে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব রাখার জন্য দিন ধার্যÑ ৩। সংবিধান সভায় উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হইলে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করা। প্রস্তাবগুলো পাস করার পর তা অলি আহাদকে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সভায় শেখ মুজিব জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন। সেদিন কোন মিছিল করার কর্মসূচী না থাকলেও ‘চলো চলো এ্যাসেম্বলি চলো’ বলে শেখ মুজিব এক বিরাট মিছিল নিয়ে এ্যাসেম্বলি হলের দিকে অগ্রসর হন। তখন পরিষদের অধিবেশন চলছিল। পরবর্তী ব্যবস্থাগুলোতে ১১ মার্চ যথাযথ মর্যাদায় পালিত হতে থাকে। আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ববঙ্গে জুলুম প্রতিরোধ হিসেবে পালিত হয় ধর্মঘটের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় ময়দান সভায় নইমুদ্দিন আহম্মদ সভাপতিত্ব করেন এবং বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিব, আঃ রহমান চৌধুরী প্রমুখ। পরে ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সমর্থন করায় শেখ মুজিবসহ ২৭ শিক্ষার্থীর ওপর বহিষ্কারাদেশসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। শেখ মুজিব তখন আইনের ছাত্র। তাঁর শাস্তি হয় মুচলেকা এবং ১৫ টাকা জরিমানা, না হয় চূড়ান্ত বহিষ্কার। শেখ মুজিব মুচলেকা দেননি, তাই বহিষ্কার এবং ছাত্রজীবন শেষ। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দানের সময় শেখ মুজিব বন্দী হন এবং মুক্ত হন ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে। তবে এ সময় তাঁর মুক্তির দাবিতে পোস্টার, সেøাগান, লিফলেট, স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে (তখনও দৈনিক হয়নি) ‘কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমান’ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন রয়েছে। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের সভায় অবিলম্বে নিরাপত্তা বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য বন্দীর মুক্তি ও নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ রহমতুল্লাহ ক্লাবে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায়ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহম্মদ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ আমরণ অনশন শুরু করেন। তখন অসুস্থতার কারণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করা হয় তাঁদের। বন্দী অবস্থায় অবশ্য সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দেন। এ সময় ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ইত্তেফাকে এক প্রতিবেদনেÑ পাকিস্তান সংগ্রামের জঙ্গী কর্মী, ছাত্র-যুব আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক ‘শেখ মুজিবুর রহমানের বিনা বিচারে কারাবাস ও বন্দী দিনগুলোর নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে জীর্ণ স্বাস্থ্যের জন্য উৎকণ্ঠা ও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলিয়া প্রদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ প্রদেশের সকল কর্মী বিশেষ করিয়া শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনের আশুমুক্তির জন্য আবেদনপত্র পেশ করিয়াছেন।’ আবেদনপত্রে মওলানা ভাসানী বিশিষ্ট ছাত্রনেতাসহ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা সই করেন। মানবতার নামে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনের মুক্তির আবেদন জানিয়ে মওলানা ভাসানী একটি পৃথক বিবৃতি দেন, যা ২৪ জানুয়ারি ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রাজবন্দী মুক্তি কমিটির সভায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে প্রস্তাব নেয়া হয় এবং পোস্টার দেয়া হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদে আনোয়ারা খাতুন একটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে নিরাপত্তা বন্দী বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী মুজিবুর রহমান অনশন করছেন, জনগণ তাঁর অবস্থা সম্বন্ধে উদগ্রীব। মওলানা ভাসানী ২৩ ফেব্রুয়ারি এক তারবার্তায় শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহম্মদের প্রতি অনশন ভঙ্গ করার আবেদন জানিয়ে বলেন, তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। এ সংবাদ দৈনিক ইনসাফে প্রকাশিত হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে। ২৭ ফেব্রুয়ারি রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে, বিখ্যাত নিরাপত্তা বন্দী মুজিবুর রহমান খানকে (ভুলক্রমে শেখের বদলে খান বলা হয়েছিল) গতকাল (অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি) মুক্তিদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাক ৫ মার্চ ১৯৫২ তারিখে শেখ মুজিবের চিত্র সংবলিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেÑ ‘পূঃ পাক আঃ লীগ জয়েন্ট সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমান বিগত ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। কয়েক মাস যাবত তিনি হৃদরোগে ভুগছিলেন। কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে স্থানান্তর করে কিন্তু সরকার টাকার অজুহাতে তাকে পুনরায় জেলে প্রেরণ করে। কারা প্রাচীরের অন্তরালে তিলে তিলে জীবন বিসর্জন দেয়ার অপেক্ষায় আমরণ অনশন শ্রেয় মনে করে মি. রহমান বিগত ১৬ ফেব্রুয়ারি হতে অনশন শুরু করেন। দেশময় ইহার দরুন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করিয়া সরকার জনাব রহমানকে মুক্তি দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর স্বাস্থ্য খুব খারাপ। ফরিদপুর জেলগেটে দু’হাজার ছাত্র-জনতা নেতা মুজিবুরকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। মুক্তি পাইয়া জনাব রহমান আওয়ামী লীগ অফিসে তারযোগে খবর পৌঁছান এবং ঢাকায় শোচনীয় (একুশে) দুর্ঘটনার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্মেলন হয় আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে। অপরাহ্ণ আড়াইটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত। আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রহে মওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাশিম ও অন্যান্য কর্মী আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই, ভাষা চাই। রাষ্ট্রভাষার ওপর গণভোট দাবি করে শেখ মুজিব বলেন, ‘মুসলিম লীগ, লীগ-সরকার আর মর্নিং নিউজ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলাভাষা চায়। এ সম্মেলনে মোট ২২টি প্রস্তাব নেয়া হয়। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ৫ ডিসেম্বর ১৯৫২ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সভা-সমিতির মাধ্যমে বন্দীমুক্তি দিবস হিসেবে প্রতিটি শাখাকে পালনের জন্য সম্পাদক শেখ মুজিব নির্দেশ দেন। ওইদিন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে বিরাট জনসভা পরিষদের সভাপতি আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিব বলেন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে মওলানা ভাসানীসহ বহুকর্মী বিনাবিচারে জেলে আটক আছেন। ভাষার দাবিতে গুলিগোলা চলে কিংবা এরূপ বন্দী করা হয় এই দুনিয়ার ইতিহাসে এটাই তার প্রথম নজির। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন ছাড়াও জনতার দাবি নিয়ে যারা সংগ্রাম করছিলেন তাঁদের অনেককে সরকার ইতোপূর্বে বিনাবিচারে আটক রেখেছেন। অবিলম্বে সকল দেশবাসীকে মুক্তি না দিলে দেশব্যাপী গণআন্দোলন সৃষ্টি হবে। তিনি দেশবাসীর স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দাবি করেন। উপসংহারে বলেন, ‘মওলানা ভাসানী ও সহকর্মীরা জেলে পচে মরলে আমরা বাইরে থাকতে চাই না।’ ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে যে কর্মসূচী নেয় তা পালনের জন্য আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিব নির্দেশ দেন। ওইদিন সকাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সাইকেলে করে গোটা ঢাকা শহরে টহল দিয়ে বেড়ান এবং মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। পরে আরমানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভায় শেখ মুজিব বক্তৃতা দেন। তাঁর অনুরোধে গাজীউল হক নিজের লেখা প্রথম গানটি ‘ভুলবো না....’ পরিবেশন করেন। সভায় অন্যান্য সেøাগানের মধ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ ইত্যাদি এবং চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মার্চ মাসে। যুক্তফ্রন্টের জনপ্রিয়তা তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং সে সুবাদে একুশে ফেব্রুয়ারি যাতে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত না হতে পারে তার জন্য লীগ সরকার নির্যাতন তীব্রতর করে। ছাত্রীসহ অনেক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। যার বিরুদ্ধে শেখ মুজিব তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ওই বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ নক্সা তৈরি এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে বঙ্গবন্ধু এবং অন্যদের আটক করেন। ১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের প্রবল বাধা সত্ত্বেও রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। ভাষা আন্দোলন মূলত ছিল একটি সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ফসল, যার ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা ও এই ভূখ-। এ প্রসঙ্গে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে ঢাকায় পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী দিবসে সভাপতির ভাষণে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু না মুসলমানÑ এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য আমরা বাঙালী। এটা কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন, তা মালা-তিলক-টিকি কিংবা লুঙ্গি-টুপি-দাড়িতে ঢাকার জো নেই।’ এই সত্যকে সামনে রেখে ভাষা আন্দোলন। এ কথা সত্য, ভাষাকে নিয়ে যে আন্দোলন ১৯৪৭ সালে শুরু হয় তার ক্লাইমেক্স ছিল বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। যে দিন আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্য আগেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ছাত্ররা মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে, যার বিয়োগান্ত পরিণতি বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার প্রমুখের সরকারী গুলিতে হত্যা। যদিও আন্দোলন শুরু ১৯৪৭ সালে, কিন্তু ১৯৪৯ সালের শেষার্ধ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, এ সময় শেখ মুজিবসহ আরও কিছু নেতৃস্থানীয় ছাত্র-যুবকর্মী বন্দী ছিলেন। সে সময় ছাত্রদের উৎসাহিত করে সরকারবিরোধী একমাত্র রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ; যার সবচাইতে আকর্ষণীয় তরুণ নেতা শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিটি প্রাধান্য পায়। এ কথা আরও সুস্পষ্ট যে, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব প্রমুখ বাঙালী জাতিসত্তাকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য পাকিস্তান উপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠার পশ্চিমা মোড়ল এবং তাদের বাংলাভাষী দোসরদের ষড়যন্ত্র পুরোপুরি আঁচ করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে ৬ সেপ্টেম্বর ৮৫ সংখ্যা সাপ্তাহিক ছুটিতে সয়ফুল ইসলাম ‘ভাসানীর ভারত প্রবাসে নয় মাস’ প্রবন্ধে লিখেছেন- শুধু নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে লক্ষ্য অর্জিত হবে না, এ চিন্তা প্রথমাবধি ছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে মওলানা ভাসানী যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয় আলোচনা করেন। মধুপুরগড় এলাকায় সরকারবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনাও করেন। এমআর আখতার মুকুল সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে ৬ সেপ্টেম্বর ৮৫ সংখ্যায় লিখেছেন যে, ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার সময় এসপি শামসুদ্দোহা বাধা দিলে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি-ধস্তাধস্তি এমনকি দু’জনে মল্লযুদ্ধ এবং রাস্তায় গড়াগড়ি যায়। তাই সে আন্দোলনকে সামনে রেখে মূলত প্রতিরোধ আন্দোলনের শুভসূচনাÑ যা চুয়ান্নর নির্বাচনে একুশ দফা রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তুঙ্গে ওঠে। রাজনৈতিক শাসন দাবি মানতে শাসকরা রাজি না হওয়ায় আন্দোলনের তীব্রতা বাড়িয়ে শেখ মুজিব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেনÑ যা বৃহত্তম গণআন্দোলনের সৃষ্টি করে এবং তার অনুকূলে জনগণ ভোট দেয় এবং ঐক্যবদ্ধ হয়। ছয় দফা দাবিও স্টিমরোলারে নিষ্পেষণের চেষ্টা চলে এবং শেখ মুজিবকে হত্যার জন্য আগরতলা স্বড়যন্ত্র মামলা দেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। কিন্তু ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে প্রবল ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতন, জেনারেল ইয়াহিয়ার শাসনকাল সত্ত্বেও ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী মুজিব একদফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ২৬ মার্চ ১৯৭১। তারপর বিজয়। ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২:০১ মিনিটে শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যথেষ্ট রক্ত দিয়েছি। আর আমরা শহীদ হওয়ার জন্য জীবন উৎসর্গ করব না- এবার আমরা গাজী হব। সাত কোটি মানুষের অধিকার আন্দোলনের শহীদানদের নামে শপথ করছি যে, আমি নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গ করব।’ ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে বাংলাভাষা চালু প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশে সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয় তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে (শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশিদুল হাসানের ডায়েরি থেকে)। বাংলাভাষা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ আসে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিজয়ের মধ্য দিয়ে। শাসনতন্ত্র তৈরি হয় বাংলায়। জীবনের সর্বস্তরে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য শাসনতন্ত্রে বিধান রাখা হয়। অফিস-আদালতে বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় যেন কাজ না চলে। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর কাছে ইংরেজী লেখা কোন ফাইল পাঠাতে কেউ সাহস করত না। বাঙালী জাতির মনমানসিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নয়া শিক্ষানীতি প্রণীত হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্য তা বাস্তবায়নের সময় হলো না। তবে অসম শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন- কিন্ডার গার্টেন ব্যবস্থা বাতিল এবং ক্যাডেট কলেজ ব্যবস্থাও পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন এবং এটিই ছিল বাংলায় জাতিসংঘের প্রথম ভাষণ। ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু চীনে শান্তি সম্মেলনে বাংলায় ভাষণ দেন (সূত্র : মুজিববাদ-খোন্দকার ইলিয়াস পৃঃ ৫৩১) এবং এটিই ছিল বিশ্বের দরবারে প্রথম বাংলা ভাষণ। ১৯৪৭ সালে ভাষার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তা ১৯৫৬ এবং ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালে শর্ত ছিল যে, বাংলাভাষা চালুর সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি করা হবে। উক্ত কমিটি ১০ বছর পর ১৯৭২ সালে একটি রিপোর্ট দেবে যে কবে নাগাদ বাংলাভাষা চালু করা সম্ভব হবে অর্থাৎ এটি ছিল বাংলাভাষা উপেক্ষার একটি ভাঁওতা। দেশ স্বাধীন না হলে বাংলাভাষা আজ কোথায় থাকত কে না জানে। উল্লেখ্য, আইয়ুব দশকে উর্দু হরফে বাংলা লেখা ‘লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা’র ষড়যন্ত্র, রবীন্দ্রনাথকে রেডিও, টিভিসহ সর্বত্র নিষিদ্ধ করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। আরও উল্লেখ্য যে, আইয়ুব খান তথাকথিত বাম সাংবাদিকদের নিয়ে দৈনিক বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সংহতির নামে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক ক্ষতি করেন। এ সময় অনেক নামী-দামী কবি, প্রফেসর, সাংবাদিক আইয়ুবের পদলেহন করে পাকিস্তানী খেতাব এবং ধনদৌলতের মালিক হন। এদের অনেকেই অবশ্য ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীর খাতায় নাম লিখিয়ে এখন বরণীয় হয়ে আছেন। একটি কথা এ প্রসঙ্গে না বললেই নয় যে, বাংলা ভাষার বিরোধী খাজা নাজিমুদ্দিনের কবর হয়েছে শেরেবাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাজারে। কাজটি করেছিলেন আইয়ুব খান। আর নূরুল আমীন ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর দোসর হয়ে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সে দেশের ক্ষণকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর কবর হয়েছে জিন্নাহ মাজার কমপ্লেক্সে। পাকিস্তানীরা তাঁকে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে রেখেছিলেন। এরশাদ সবুর খানকে ১৯৮২ সালে কবর দিয়েছেন সংসদ প্লাজায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। আবার ২০০০ সালে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার গভীর আগ্রহে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করে। আর শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে চলেছেন (সর্বশেষ ২০১৪) পিতার মতোই। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ’৭১ ও ’৭৫-এর ঘাতকরা এখনও শহীদ মিনার ভাঙছে, পুড়ছে জাতীয় পতাকা, পেট্রোলবোমায় হত্যা করছে বাঙালীদের। তবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। ১৩/০২/২০১৫
×