ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কঠিন হবে না দানব দমন

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কঠিন হবে না দানব দমন

কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলাম- ইচ্ছে ছিল ফেব্রুয়ারির ওপর একটা ফরমায়েসি লেখা লিখব। এ সময় আমাদের পরিবারের গৃহকর্ম-সহযোগী কওসর বিষণœ মুখে এসে দাঁড়াল সামনে। তার দিকে তাকাতেই বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলল যে, দু’জন অত্যন্ত নিকটাত্মীয় জামায়াত-বিএনপির জঙ্গীদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় ঝলসে ঘটনাস্থলেই প্রাণত্যাগ করেছেন। পেট্রোলবোমাটি মারা হয়েছে বরিশালগামী ট্রাকে। ট্রাকচালক এজাজুল তার শ্বশুর মোতালেবকে নিয়ে যাচ্ছিলেন বরিশালে। মোতালেব তাঁর জামাতাকে অনুরোধ করেছিলেন বরিশালে কোনো ট্রিপ পেলে তাঁকে সেখানে পৌঁছে দেয়ার জন্য। মোতালেব চেয়েছিলেন বরিশালের বাবুগঞ্জ থেকে তাঁর শাশুড়িকে নিয়ে আসবেন। ভোর পাঁচটার দিকে হঠাৎ জঙ্গীরা সেই ট্রাকে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারে। ফলে ট্রাকের তিনজনই নিহত হন। তার মধ্যে দু’জন আমাদের কওসরের নিকটাত্মীয়। সেই দু’জন মোতালেব এবং এজাজুল। জামায়াত-বিএনপি জঙ্গীদের নৃশংস হামলার সর্বশেষ শিকার। খালেদা জিয়ার তথাকথিত আপসহীন চরিত্রের হিংস্র সিদ্ধান্তের কারণে গত সোয়া এক মাসে এই নিয়ে সম্ভবত ৬০টি প্রাণ নিঃশেষ হলো। আমি কওসরের মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। দুুপুরের দিকে কওসরের ভগ্নিপতি সাজ্জাদ এলেন। তিনি যাচ্ছেন বরিশালে দগ্ধীভূত মরদেহ দুটি নিয়ে আসতে। কাঁদতে কাঁদতে সাজ্জাদ বললেন, এই মোতালেবই তাকে তার তিন মাস বয়েস থেকে লালনপালন করে বড় করেছেন, জীবনে দাঁড় করিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মোতালেব মিয়া এবং যুবক এজাজুলকে যে প্রাণ দিতে হবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারছিলেন না। স্তব্ধ হয়ে শূন্য অসহায় দৃষ্টিতে সাজ্জাদ আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তাঁর চোখে প্রত্যাশার চিহ্ন ছিল না; কিন্তু তারপরেও আমি কুণ্ঠিত হচ্ছিলাম। নিজেকে প্রচ-ভাবে অপমানিত, লাঞ্ছিত এবং বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। সাজ্জাদ আমাদের বাসা থেকে রওনা দিচ্ছেন একজোড়া আগুনে পোড়া মানুষের লাশ আনতে। আর আমি যেন অনুভব করছি পেট্রোলবোমার আগুনে আমার রোমকূপ পুড়ছে, আমার সমস্ত শরীরের চামড়া পুড়ে যাচ্ছে, মাংস চর্বি গলে যাচ্ছে। স্বল্পভাষী কওসর শুধু অস্ফুট স্বরে বলল, যদি পঞ্চাশটা পেট্রোলবোমা মারতে পারতাম খালেদা জিয়ার বাড়িতে তাহলে সেটাই করতাম। তার এই নিষ্ফল আক্রোশের প্রতি সমর্থন দিতে পারছিলাম না বটে, কিন্তু অনুভব করতে পারছিলাম-তার ভেতরকার বেদনা ক্রোধ হয়ে ঝরে পড়ছে এভাবেই। ॥ দুই ॥ একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি, যিনি দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আসনের নামকরা মানুষও বটে, আমার সঙ্গে দেখা হলো একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে। তিনি বেশ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, অবস্থা তো দিনের পর দিন খারাপই হয়ে যাচ্ছে। এখন সমাধানটা কী? বললাম, আপনি কীভাবে সমাধান হওয়ার কথা ভাবছেন? তিনি বললেন, হয় সরকারের উচিত আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, না হলে উচিত সরে যাওয়া। -অর্থাৎ তারেক রহমান বিদেশ থেকে যে কথা বলছে, সেটাই করা উচিত? -কঠোর ব্যবস্থা না নিতে পারলে আর উপায়ই-বা কী? আমি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘অর্থাৎ প্রতিদিন পেট্রোলবোমা মেরে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে হত্যা করলে ক্ষমতায় যাওয়া যায়? যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নিরপরাধ মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে, তারা ক্ষমতায় বসলে কী করবে, কী ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হবে- সেটা কি ভাবতে পারবেন আপনি?’ এবার তিনি একটু থতমত খেলেন। বললেন, কথাটা তো ঠিক, কিন্তু কী করা উচিত কিছুই তো বুঝতে পারছি না। বললাম, ‘একাত্তরে পাকবাহিনী আর আলবদর রাজাকাররা তিরিশ লক্ষ মানুষ মেরেছে, তখন জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, এখন ষোলো কোটি। সেই অনুপাতে কত মানুষ খুন হবে, কত গণকবর হবে, কত মা-বোনের সম্ভ্রম লুট হবে সেটাও তো মাথায় রাখতে হবে এমনভাবে বিকল্প কল্পনা করলে।’ সেই বিদগ্ধ মানুষটি আমার কথায় সায় দিলেন মনে হয় তাঁর নিজের পরিণতির কথা চিন্তা করে। এটা শুধু তাঁর একার নিরীহ ভাবনা নয়, আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত উচ্চ-মধ্যবিত্ত একটি অংশের ভেতরেও এই ভাবনা পল্লবিত হচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে, যারা বেপরোয়া পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ খুন করে চলেছে, তাদের রক্ষাকবচ। এই চিত্তদৌর্বল্য দুর্বৃত্তদের অধিকতর বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর হওয়ার সুযোগ করে দেয়। একাত্তর সাল সম্পর্কে যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে এবং যাঁরা একাত্তরের বীভৎসতার ভেতর দিয়ে গেছেন, তাঁদের স্মৃতি উসকে দেয়ার জন্য বলব, একাত্তরে কিন্তু অনেকেরই আত্মসমর্পণ করেও সম্পদ, সম্ভ্রম কিংবা জীবনরক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অনেক আত্মসমর্পণবাদীর জীবন গিয়েছে, সম্পদ গিয়েছে। এটাও একাত্তরের ইতিহাসের আর এক অধ্যায়। ॥ তিন ॥ একাত্তরের প্রসঙ্গটি এখানে টেনে আনতে হলো, কারণ, এই বেপরোয়া নৃশংসতার পেছনে সুবিশাল পরিকল্পনা এবং গভীরতর ষড়যন্ত্র রয়েছে। সরকার কিংবা সরকারি দল নেতৃত্বাধীন জোটের নেতৃবৃন্দ যদি মনে করে থাকেন এটা কেবলমাত্র জামায়াত-বিএনপির ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ, এবং তার জন্যই এতকিছু- তাহলে সেটা পূর্ণ সত্য হবে না- ক্ষুদ্রাংশিক সত্য হবে মাত্র। বাস্তব চিত্র হলো, জামায়াত-বিএনপিকে অবশ্যই ক্ষমতায় আনার চেষ্টা হচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই- বিশেষ করে বাংলাদেশের শাসনভার জামায়াতের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে তালেবান-আইএস অধ্যুষিত এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-নিয়ন্ত্রিত সরকার এখানে চাপানোরই চেষ্টা হচ্ছে। যত ধরনের হামলা, যত ধরনের নীলনকশা, সব রকমের ষড়যন্ত্র এখন সবই করছে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের একমাত্র লক্ষ্য একাত্তরে অর্জিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলা। এই অপচেষ্টা যে এখনই শুরু হয়েছে, তা কিন্তু নয়। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা ২০০৫-এর গোড়ার দিকে জামায়াত নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামি অত্যন্ত দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘জামায়াত একদিন বাংলাদেশ শাসন করবে, সেজন্য একশ’ বছর অপেক্ষা করলেও করতে হবে।’ যখন তিনি এই দম্ভোক্তি করেছিলেন তখন তিনি খালেদা জিয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং জামায়াত-বিএনপির নির্ভরযোগ্যতম নেতা হিসেবে ততক্ষণে তাদের স্থান স্পষ্ট করে ফেলেছে। অতএব আজ জামায়াত-শিবিরের যে অ্যাকশন প্রোগ্রাম আমরা দেখছি, এটা কোন আকস্মিক ব্যাপার নয়, এবং এটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার একটি অংশ। পাঠক এবং বাংলাদেশের ঘটমান পরিস্থিতির পর্যবেক্ষকরা যদি মুক্তদৃষ্টি নিয়ে ঘটনাবলী অবলোকন করেন তাহলে নিশ্চয়ই তাদের মনে পড়বে কতকগুলো বিষয়- এক. জামায়াত সব সময় একটি কথার ওপর জোর দিয়ে আসছে, তা হলো, একাত্তরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, তা ছিল গৃহযুদ্ধ এবং তার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদ বাংলাদেশ সৃষ্টি করে এই অঞ্চলকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে; দুই. একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, হয়েছে পাক-ভারত সংঘর্ষ, যা ছিল মুসলমানদের ওপর একটা প্রচ- আঘাত; তিন. একাত্তরে জামায়াত যা করেছে তা দেশ এবং ধর্মের জন্য সঠিকই ছিল; চার. জামায়াতের ওপর কোনো আঘাত এলে দেশে গৃহযুদ্ধ বাধবে; পাঁচ. জামায়াত একদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো। একাত্তরের পর থেকে পাকিস্তান কিংবা জামায়াতে ইসলাম কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও বসে থাকেনি। বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করার জন্য তারা এখনও পর্যন্ত নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের পর বাংলাদেশবিরোধী যাবতীয় চেষ্টায় জামায়াত ছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সবচাইতে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। জামায়াত পাকিস্তানকে তাদের সকল কর্মকা-ের ঘাঁটি বানিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে থাকে এবং সর্বক্ষেত্রে তাদের একটাই স্থির লক্ষ্য। আর তা হলো, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা এবং বাংলাদেশে নানা ধরনের নাশকতা-অন্তর্ঘাতমূলক কাজ সংগঠিত করা। এক্ষেত্রে সৌদি আরবের নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলোর অধিকাংশই জামায়াতকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে এবং এখনও দিয়ে চলেছে। ॥ চার ॥ আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও পাঠকের স্মৃতি নাড়িয়ে দেয়ার জন্য বলে রাখি, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে ’৭৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ১১৬টি দেশ। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেয় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে। ঐ একই দিনে স্বীকৃতি দেয় ইরান এবং তুরস্ক, এর ৬ দিন পর দেয় নাইজেরিয়া এবং ১০ দিন পর দেয় কাতার। যদি কেউ এভাবে ভাবতে চান তাহলে এমনটি ভাবতে পারেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার পর পাকিস্তান অতি দ্রুত তার ভূমি পাকাপোক্ত করার জন্য এই কৌশলী স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর সৌদি আরবকে স্ট্যান্ডবাই রেখেছিল ’৭৫-এর পটপরিবর্তনকে আনুষ্ঠানিকতা দেয়ার জন্য। আর তাই আমরা দেখি ১৯৭৫-এর ১৬ আগস্ট অর্থাৎ জাতির জনককে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পরের দিনই সৌদি আরবের স্বীকৃতি আসে এবং ৩১ আগস্ট চীন স্বীকৃতি দেয়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরপরই সাহায্যের ঝাঁপি নিয়ে আসে পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলো। এ থেকে খুব সহজে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের হ্নত জমি পুনরুদ্ধারের জন্য পাকিস্তান কী পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করেছিল। পঁচাত্তরের পর তারা বিলম্ব করেনি তাদের অর্জনকে গুছিয়ে আনতে। তাদের সবচাইতে বড় শিকার ছিল একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী মেজর জিয়া। চট্টগ্রাম বেতারে তাঁকে উপস্থিত করানোর ফলে তাঁর ভেতরে নেতৃত্বের যে স্পৃহা তৈরি হয়েছিল, তাতে পরবর্তী পর্যায়ে সামগ্রিক বিবেচনায় তিনি প্রার্থিত অবস্থান না পাওয়াতে সংক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর এই মানসিক প্রতিক্রিয়া এমন একজন টের পেয়েছিলেন যিনি সে সময় পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তাঁর গোপন মিশন হিসেবে তথাকথিত স্বপক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, অ্যাকটিভ সার্ভিসের লোক হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে না গিয়েও তিনি সে সময় মুজিবনগর সরকারের কেন্দ্রস্থলে অবস্থান গ্রহণ করেন। সামরিক পরামর্শক হিসেবে প্রবাসী সরকারের আস্থা অর্জন করার পাশাপাশি সঙ্গোপনে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে তাঁর ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবেই পালন করেন। যদি এমন সন্দেহ করা হয় যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সামরিক বাহিনীর অফিসারদের ভেতরে সে সময় যে অদৃশ্য বিভাজন এবং পারস্পরিক সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল, আর প্রবাসী সরকার ও যুব নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল সেটার পেছনে ঐ ব্যক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল, তাহলে বোধহয় তা অমূলক হবে না। কাজেই পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠার পেছনে জিয়াউর রহমানের নিজের কৃতিত্বের চেয়ে তাদেরই কৃতিত্ব অধিকতর যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সর্বাংশে যুদ্ধ চালাচ্ছে। জিয়া ছিলেন তাদেরই পুতুল। তাই তিনি তাঁদের ক্রীড়নক হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী-রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন, একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা বধ করেছেন, রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য অসম্ভব করে দেওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে তিনি একাত্তরের ঘাতক ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছেন, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধার তকমা থাকায় তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট অংশকে বিভ্রান্ত করার। তাঁকে এভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য ইনাম হিসেবে তিনি সেই মুখোশধারী আইএসআই এজেন্টকে মন্ত্রীর মর্যাদা প্রদান করতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। জিয়া তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায়। জিয়া থেকে শুরু করে তার পরবর্তী একুশ বছরের ইতিহাস বাংলাদেশের রাজনীতি সমাজজীবন কিংবা অর্থনীতিতে একাধিক্রমে পাকিস্তানীকরণের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন ধ্বংস করার ইতিহাস, জামায়াতে ইসলামের অবাধ শাখা-প্রশাখা বিস্তারের ইতিহাস, সাম্প্রদায়িকতা উত্থানের ইতিহাস, জঙ্গীবাদ চাষের ইতিহাস। ॥ পাঁচ ॥ সুদীর্ঘ একুশ বছর পরে হঠাৎ করে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আইএসআই-এর প্রশ্রয়ে লালিত রাজনীতি চমকে গেল বটে কিন্তু হতোদ্যম হলো না। কারণ পুরো একুশ বছর ধরেই তারা নিরাপদে এবং নির্বিঘেœ গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের মতো করে সাজিয়েছিল। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি একুশ বছর পর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার এলো বটে, কিন্তু সমগ্র পরিস্থিতি রইল তাদের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি শাখা-প্রশাখার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা মুখোশগুলো অকস্মাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল। তারা মোটামুটি তাদের কর্মপরিকল্পনার ছক কেটে ফেলল। যেমন- প্রথমত, তারা প্রশাসনে তাদের প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করে তাদের ছাঁটাই করার ব্যবস্থা করল; দ্বিতীয়ত, তারা নিজেদের শক্তি সংহত করার উদ্যোগ গ্রহণ করল এবং বিভিন্ন স্তরে নিজেদের খাস-বাহিনী মোতায়েন করার গোপন ব্যবস্থা গ্রহণ করল; তৃতীয়ত, তারা ধর্মভিত্তিক ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকে সমন্বিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করল এবং জঙ্গী স্কোয়াড গঠন করে তাদের ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষিত করতে থাকল যাতে সময় এবং সুযোগমতো দেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো যায়। তারা এমন একটা পরিস্থিতি ঘটানোর চেষ্টা করেছে যাতে আর কখনও এবং কোন দিনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না পারে-তার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা; চতুর্থত, স্বাভাবিক উপরিকাঠামো দৃশ্যমান করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠানকে চিরন্তর করার জন্য ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে ব্যাপক জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটানো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ভোটব্যাংক তছনছ করে দেয়া; পঞ্চমত, বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ ঘটানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, এজন্য ব্যাপক অস্ত্রভা-ার গড়ে তোলা, বিভিন্ন ঘটনার ভেতর দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তা ও অস্তিত্বের প্রমাণ রাখা মানুষকে প্রবল অনিশ্চয়তার আবর্তে নিক্ষেপ করে সন্ত্রস্ত ও শক্তিহীন করে তোলা, ষষ্ঠত, ভারতের অভ্যন্তরে নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং জঙ্গী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক ও বেসামরিক শক্তিকে ব্যস্ত রেখে বাংলাদেশের ভেতরে জঙ্গীবাদের অবাধ চারণভূমি গড়ে তোলা। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশকে নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ জঙ্গীস্তান গড়ে তোলার পেছনে তিনটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ কারণ আছে বলে অনুমান করা যায়- এক. কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। মিয়ানমার, নেপাল এবং বঙ্গোপসাগর আর ভারত পরিবেষ্টিত এই ভূখণ্ড চীন-ভারত-মিয়ানমার-নেপাল-এর ওপর নজরদারির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; দুই. বাংলাদেশের মুসলমান সংখ্যাধিক্য এবং মাত্রাতিরিক্তভাবে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের প্রবণতা এই দেশে জঙ্গীবাদ চাষের সহজ সুযোগ করে দেয়। বিশেষ করে ’৭৫-এর পর থেকে এই দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়; তিন. পাকিস্তানের অংশ থাকার কারণে আইএসআই ভেবেছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান-অধ্যুষিত এই অঞ্চলটির ওপর তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে। একাত্তরে এই অংশটি তাদের হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় তারা প্রবলভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে এই ভূখণ্ডটি যেহেতু ভারতের অখণ্ড মানচিত্রকে বিপন্ন এবং বিপর্যস্ত করার জন্য সবচাইতে সুবিধাজনক স্থান, সেই হেতু আইএসআই তাদের লালিত সন্তান জঙ্গীবাদকে এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সদাসক্রিয়। এই পটভূমি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমান ঘটনাবলী অর্থাৎ এই ক্রমাগত নিরীহ মানুষ হত্যা, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর উপর্যুপরি হামলা, দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করা, মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে ফেলা, সমাজের প্রতিটি স্তরকে অনিশ্চয়তা এবং শঙ্কা ও ভীতির পক্ষে নিমজ্জিত করা এর পেছনে অনেক বড় লক্ষ্য হিসেবে কাজ করছে। আমরা যদি নাইজেরিয়ার দিকে তাকাই, ইরাক-সিরিয়া-লিবিয়া-আফগানিস্তান-পাকিস্তানের দিকে তাকাই, যদি এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের অশান্ত অঞ্চলগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিÑতাহলে কিন্তু একই চিত্র দেখতে পাবো। দেখতে পাবো তালেবানের হিংস্রতা, আইএসআই জঙ্গীদের নৃশংসতা, বোকোহারাম জঙ্গীদের বর্বরতা। একই সঙ্গে যদি বাংলাদেশে একাত্তরের ঘটনা মেলাই, ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর তা-বের ঘটনাবলী মেলাই, যদি ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী ধ্বংসযজ্ঞের বাংলাদেশকে মেলাই তাহলে বুঝতে বিলম্ব হবে না যে, জঙ্গীবাদের সন্ত্রাসযাত্রার পথটি এখন বাংলাদেশের ভূমিস্পর্শ করেছে। যদি একে এখনই রুখে দেয়া না হয়, তাহলে আমরা জানি না এর চেহারা কার মতো হবে। পাকিস্তানে যেভাবে মসজিদের ভেতরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়, শিক্ষাঙ্গনে হত্যালীলা চালিয়ে একশ’ তিপ্পান্ন শিশু-কিশোরকে গুলি করে খুন করা হয়, এ দেশের চেহারা কি তেমনটি হবে? আফগানিস্তানের ইরাকের লিবিয়ার জর্দানের কিংবা নাইজেরিয়ার চেহারা পরিগ্রহ করবে আমাদের এই সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা সোনার বংলাদেশ? আজ একথা স্বীকার করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পর প্রয়োজনীয় যে কাজটি করা উচিত ছিল-তা হলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির যেখানে যতটুকু শিকড় ছিল তা পূর্ণাঙ্গভাবে নিঃশেষ করা। কিন্তু সেটা করা হয়নি। কখনও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা ভেবে, কখনও ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে, কখনও অজ্ঞতাবশত, আবার কখনও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ফলে স্বাধীনতার শত্রুরা অনায়াসে বংশবৃদ্ধি করতে পেরেছে। শত্রু এবং অগ্নির চিহ্নমাত্র রাখতে নেই- এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যটি বিস্মৃত হওয়ার কারণে এ দেশের যে সর্বনাশটি ঘটে গেছে তার খেসারত কিন্তু এই দেশ এবং জাতিকে বড় মর্মান্তিকভাবে দিতে হয়েছে। আজকের এই পেট্রোলবোমার ভয়ঙ্কর আস্ফালন, এই জীবনযাত্রাকে অনিশ্চিত করে ফেলা, এ সবই সেই একাত্তর-উত্তর শৈথিল্যের পরিণতি। সেই শৈথিল্যকে তুলনা করা যেতে পারে অর্গলবিহীন কক্ষের সঙ্গে। দুর্বৃত্ত এবং স্বাধীনতার শত্রুদের অবাধ যাতায়াতের কারণেই পঁচাত্তরের পর সেই কক্ষটির দখল চলে গেছে স্বাধীনতা-বিরোধীদের কব্জায়। এর ফলে দানব-দমনের কাজটি ক্রমাগত কঠিনই হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে শেখ হাসিনাকে জোয়ান অব আর্কের মতো মনে হয়। সেই পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে ফরাসী কিশোরী জোয়ান অব আর্ক যেভাবে পুরুষের বেশ ধারণ করে পলায়নপর এবং বিপর্যস্ত সৈন্যদের সংহত করে পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সৈন্যকে পরাজিত করেছিলেন, ঠিক তেমন করেই যেন শেখ হাসিনা একাকী লড়ছেন এবং দেশটাকে শত্রুমুক্ত করার চেষ্টা করছেন। জোয়ান অব আর্ক পেরেছিলেন, তবে এর পরিণতি তাঁর জন্য সুখকর হয়নি। তাঁর শৌর্য-বীর্য-মেধা এবং সাহস তাঁর স্বপক্ষের কাছে ঈর্ষার উদ্রেক করেছিল। তাই মাত্র উনিশ বছর বয়সেই তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় ডাইনি অপবাদ দিয়ে। কারণ পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা জোয়ান অব আর্ক-এর অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং সাহসকে নারীর মধ্যে থাকার কথা ভাবতে চায়নি। আমি শেখ হাসিনার সেই পরিণতি কল্পনা করি না। কারণ এটা একবিংশ শতাব্দী। জোয়ান আব আর্ক যেমন ব্রিটিশরাজকে পরাস্ত করে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিলেন, শেখ হাসিনাও তেমনি অর্ধশতাব্দীব্যাপী তিল তিল করে বেড়ে ওঠা স্বাধীনতা-বিরোধীদের পরাস্ত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। জোয়ান অব আর্ককে পুড়িয়ে মেরে ফরাসীরা অবশেষে তাঁকে দেবীর মর্যাদায় সন্ত সাজিয়েছিল। শেখ হাসিনা জয়ী হোন এবং মানুষই থাকুন, তাঁর ওপর দেবত্ব আরোপিত হোক- কামনা করি না কখনও। তাঁকে যারা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে চিত্রিত করতে চান, তাঁদের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি না। তবে শুধু এটাই প্রত্যাশা করি, যাঁরা ট্রয়ের কাঠের ঘোড়া বহনের বন্দনা করছেন তাদের ব্যাপারে তিনি সতর্ক থাকুন। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×