ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তবু বসন্ত

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

তবু বসন্ত

কবি-শিল্পীদের কথাই আলাদা। তাঁরা সব অমৃতের বরপুত্র। বসন্ত তাদের মনের জানালা খুলে দেয়। আর তাঁরাও বসন্তকে বর্ণময় করে তোলেন শব্দে ও রেখায়, চিত্রকল্পে ও বাহারি বর্ণচ্ছটায়। তবে শুধু কবি-শিল্পীদের কথা কেন। কার মনে না লাগে রং এই বসন্তে? বসন্তের রূপ, রস, গন্ধ আলোড়ন তোলে সবার মনে। যদি সে হয় বঙ্গসন্তান, মানব সমাজের প্রতিনিধি। বসন্তের বারতা কে অগ্রাহ্য করে! ফাল্গুনের আহ্বানে কে না সাড়া দেয়, শুধু প্রাণহীন পাষ- ছাড়া! একুশে ফেব্রুয়ারি আবার এসেছে। একসময় আটই ফাল্গুন হিসেবেও উল্লেখ করা হতো বাংলার যুগপৎ শোক ও অহঙ্কারের এ দিনটিকে। বরকত, রফিক, জব্বার, সালাম Ñ থোকা থোকা এই বিষণœ নাম ফুলে ফুলে ঢেকে দেয় বাংলার প্রতিটি ফাল্গুন। ফাল্গুন রক্তরঞ্জিত হয়েছিল কি কেবল বাহান্নতে? আবার এক রক্তস্নাত বসন্ত এসেছিল স্বাধীন দেশে, এই মহানগরীতেই। ঘটানো হয়েছিল পিলখানা ট্র্যাজেডি। দেশপ্রেমিক সৈনিকদের হত্যা করা হয়েছিল নৃশংসভাবে। আর ক’দিন পরেই তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আরেক ফাল্গুন এসেছে এবার। পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। রাজনীতির নামে সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করছে নববসন্ত। রোদনভরা বসন্তের গভীরে তবু জীবনোৎসবেরই অনুরণন। আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, তবু জীবন অশেষ-অনিঃশেষ। দ্রোহের ফাল্গুন জ্বলে উঠেছে এবার ভিন্নভাবে। লাখ লাখ মানুষ বসন্তকে স্বাগত জানাতে নেমে এসেছে পথে, খোলা আকাশের নিচে। মেতে উঠেছে তারা উৎসবে। বইমেলায় নেমেছে উদ্যমী-উৎসাহী মানুষের ঢল। ভালবাসা দিবসে রাজপথ উপচে পড়েছে নবীন-তরুণদের প্রাণোচ্ছলতায়। মনে পড়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় এসেছিল নববর্ষ। বৈশাখের রুদ্র জামায় আচ্ছাদিত হয়ে যুদ্ধে যেতে চেয়েছিল অস্ত্র হাতে একাত্তরের যোদ্ধা। আর ২০১৫ সালের ফাল্গুনে বসন্ত সাজে ফাগুন উৎসবে যোগ দিয়েছে একাত্তরের বিরুদ্ধ শক্তিরই প্রতিপক্ষ; আগুন নিয়ে মারণ খেলায় যারা মত্ত তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে এই সম্মিলিত মানুষ, এ দেশের উৎসবমুখর গণমানুষ। এতেই প্রমাণিত, দেশবাসী অন্যায় অন্যায্যকে নস্যাত করে দিতে জীবনের মঞ্চে দাঁড়িয়েছে। এবারের বসন্ত কতই না রূপদর্শী। এই বসন্তেই সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় টাইগাররা দারুণ লড়ছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বিজয় ছিনিয়ে আনতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আফগানিস্তানের সঙ্গে দুরন্ত জয় ছিনিয়ে এনে ফাল্গুন উৎসবকে আরও বেশি রাঙিয়ে দিয়েছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। সবার ওপর জীবন সত্য। জীবনের দাবি সবার আগে। সে দাবিকে দাবিয়ে রাখা যায় না। মৃত্তিকায় হায়েনা, আকাশে শকুনÑ তবু জীবন সুন্দর ও সৃষ্টিশীল। মানুষ মূলত জীবনবাদী। জীবনের ছোট ছোট বিষয়ও মানুষকে আন্দোলিত করে। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সুখ ও দুঃখে ভেসে যায় হৃদয়ের একূল-ওকূল। এই যে উন্মাদ ষাঁড়ের ততোধিক উন্মত্ত শিংয়ের গুঁতোর মতো হঠাৎ হঠাৎ হরতালের আস্ফালন, এই যে ককটেল ফুটিয়ে, বোমা ছুড়ে মানুষকে অস্থির, ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলার নেতিবাচক অপপ্রয়াসÑ এটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ঋতুরাজ বসন্তের গান ও কবিতায় নিজের নির্ভয় কণ্ঠ মেলানোর সপ্রাণ উন্মুখতা; একেই বলতে পারি জীবনের জয়-পতাকা। এটিকে বিপন্ন করতে যারা তৎপর তারা সব কুৎসিত কূপম-ূক। বসন্ত হলো সুন্দর অনুভূতি, সুললিত গান আর সুরভিত সাম্রাজ্য। মানবিক বোধসম্পন্ন বিপুল মানুষ জীবনের আনন্দ এবং প্রকৃতির বর্ণাঢ্যতাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করে, সমর্থনও জানায়। কাল একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতেও মানুষ এসে দাঁড়াবে উত্তরাধিকার নিয়ে সমৃদ্ধকামী আগামীর মোহনায়। সন্ত্রাসের বিপরীতে সুন্দরের দৃষ্টিনন্দন সমাহার। এরই অপর নাম বসন্ত!
×