ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাসন্তী রঙে সারাবেলা ছেয়েছিল বইমেলা, ধুম কেনাকাটা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বাসন্তী রঙে সারাবেলা ছেয়েছিল বইমেলা, ধুম কেনাকাটা

মোরসালিন মিজান ॥ এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে,/ মনের ভেতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মর...। বসন্ত শুরুর দিনে শুক্রবার বইমেলাজুড়ে এই মর্মর শোনা গেছে। মেলা শুরুর পর প্রথম বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এদিন সকাল থেকেই উন্মুক্ত ছিল মেলা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে লোকসমাগম। যেটুকু বাকি ছিল, পূর্ণতা পায় বিকেলে। এ সময় সব পথ এসে মিশে মেলায়। স্রোতের মতো আসতে থাকে মানুষ। বাসন্তী রঙে সেজে আসা তরুণ-তরুণীরা এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ঘুরে বেড়ানো। বিভিন্ন বয়সী পাঠকের উপস্থিতিতে মুখর হয়ে ওঠে মেলা। পরিসর বৃদ্ধির সুফলটাও এদিন পেয়েছেন লেখক পাঠক-প্রকাশকরা। সহনীয় ভিড় ঠেলে সবাই বই দেখেছেন। আশাবাদী হওয়ার মতো ছিল বিক্রিও। সব মিলিয়ে ১৩তম দিনটি খুব ভাল গেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার। শুক্রবার সকাল দশটায় খুলে দেয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। এ সময় শিশু প্রহরের আয়োজন থাকায় ভিড় করে ক্ষুদে পাঠক। বাবা-মা অভিবাবকের হাত ধরে বাংলা একাডেমি চত্বরে এসেছিলেন তারা। সকালে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে ক-শাখার ১৭৯ প্রতিযোগী ‘দেশাত্মবোধক, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা-আন্দোলন’ বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। খ-শাখায় ছিল ১৩০ প্রতিযোগী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেনÑ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শমী কায়সার। বিচারকম-লী ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব এসএম মহসীন, আবৃত্তিশিল্পী বেলায়েত হোসেন, রেজিনা ওয়ালী লীনা প্রমুখ। প্রায় একই সময় মেলায় আসতে শুরু করেন বিভিন্ন বয়সী পাঠক। বিশেষ করে চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত উৎসবে যোগদান শেষে সকলেই মেলায় প্রবেশ করেন। দেখতে দেখতে মেলার দুই ভেন্যু বাসন্তী রঙের হয়ে ওঠে। বিকেলে সেই ভিড় বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলা একাডেমি চত্বর যেন উপচে পড়ছিল। সে তুলনায় স্বস্তির ছিল সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মেলা। এরপরও প্রবেশ দ্বারের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। নতুন করে খুলতে হয়েছে বের হওয়ার পথ। বসন্তের দিনে একেবারে সব স্টলেই পাঠকের উপস্থিতি চোখে পড়েছে। একটু আনাচে-কানাচে স্থান হওয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের মুখে দেখা গেছে নির্ভেজাল হাসি। অনিন্দ্য প্রকাশ নামের একটি স্টলকে মেলার অনেকটা বাইরে মনে হতো। বসন্ত বরণের দিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায় বইপ্রেমীদের ভরপুর উপস্থিতি। প্রকাশক আফজাল হাসিমুখ করে বললেন, পাঠকইতো মেলার প্রাণ। অনেক দিন পাঠকের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। বলা যায় আজ সেই অপেক্ষার অবসান হলো। বই দেখেছেন যারা, কিনেছেনও। কী ধরনের বইয়ের আজ বেশি চাহিদা? এমন তথ্যের খোঁজ করতে গিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানা গেলো না। তবে বিক্রিতে এগিয়ে ছিল উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ। অনন্যা’র প্যাভেলিয়ন ঘিরে রেখেছিল অপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা। স্টলের দ্বায়িত্বে থাকা কিরণ জানান, প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস বেশি বিক্রি হয়েছে। গেছে নাসরিন জাহানসহ আরও কয়েকজনের উপন্যাস। পাশেই অনন্যা’র প্যাভেলিয়ন। এখানেও আছেন হুমায়ূন। টাটকা নতুন এসেছে মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আনিসুল হকের বই। এই স্টলকে বিভিন্ন বয়সী পাঠক এমনভাবে ঘিরে রেখেছিলেন যে, বাইরে থেকে ভেতরের কোন দৃশ্য চোখে পড়ছিল না। এভাবে ছোট বড় ও মাঝারি আকারের ভিড় লেগে ছিল অন্য স্টলগুলোতেও। অটোগ্রাফ শিকারীদের কবলে জাফর ইকবাল ॥ ভিড় ঠেলে এদিন মেলায় এসেছিলেন শিশুদের অত্যন্ত প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তার বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অনন্যা ও তাম্রলিপির কাছে একটি খোলা জায়গায় চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন তিনি। প্রিয় লেখককে এ সময় চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল শত শত ছেলেমেয়ে। জাফর ইকবাল কাউকে নিরাশ করেননি। বরং তাদের সকলকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলে আপন মনে অটোগ্রাফ দিয়ে যান। ৩১১ নতুন বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৩তম দিনে শুক্রবার মেলায় নতুন বই এসেছে ৩১১টি। নজরুল মঞ্চে এদিন ২০টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘কবি আবুল হোসেন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. তারেক রেজা। আলোচনায় অংশ নেন বায়তুল্লাহ কাদেরী, অনু হোসেন ও হিমেল বরকত। সভাপতিত্ব করেন মনজুরে মওলা। প্রাবন্ধিক বলেন, সময় ও সমাজের অন্তর্গত অবয়ব উন্মোচনের উদ্দেশে নির্মিত আবুল হোসেনের কবিতাসমূহ নানা কারণে বিশেষ গুরুত্ববহ। স্বাধীন বাংলাদেশের একটি কালখ-ের রাজনৈতিক বাস্তবতা তার কাব্যপাঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে কথাটি সোজা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব হয় নি, তা প্রকাশের জন্য বাঁকা পথের শরণ নিয়েছেন তিনি। আবুল হোসেনের কবিতায় কবি-মনের স্পর্শে প্রকৃত সত্য ও বাস্তব ঘটনার শরীরে যুক্ত হয় ভিন্নতর আস্বাদন। সমসাময়িক দেশকালের নানা অভিঘাতকে তিনি আবুল হোসেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে শেষ কাব্যগ্রন্থ পর্যন্ত যে ভ্রমণ সম্পন্ন করেছেন, তাতে তাঁর স্বকালগ্নতারও একটি ধারাক্রম মুদ্রিত হয়েছে। সমাজ ও রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন মানুষের সঙ্গে বিরোধও প্রবল হয়ে ওঠেÑ এই বোধ তাঁর মধ্যে বরাবরই সক্রিয় ছিল। আলোচকরা বলেন, আবুল হোসেন কবিতা ও জীবনকে অদ্বৈতরূপে অন্বেষণ করেছেন। বাংলা কবিতাকে অলঙ্কারের বাহুল্য থেকে মুক্তি দিয়ে মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার বিরল কৃতিত্ব তাঁর। পঠন-পাঠনের ব্যাপক অভিজ্ঞতায় বাংলা কবিতার শরীরে তিনি যোগ করেছেন নতুন লাবণ্য। সমাজ-রাজনীতি তাঁর কবিতায় অনিবার্য উপাদান হিসেবে এসেছে। কিন্তু কখনোই আরোপিতভাবে নন। সভাপতির বক্তব্যে মনজুরে মওলা বলেন, কবিকে তাঁর বিশুদ্ধ মনোলোকের অবস্থান থেকে বিবেচনা করতে হবে। আবুল হোসেন যে বিশেষ সময় ও সমাজে কবিতা লিখে গেছেন তার ছাপ কখনোই কবিতার শৈল্পিক মানদ-কে ছাপিয়ে যায়নি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নববসন্ত’র নামের মতোই বাংলা কবিতায় বাসন্তী উত্তাপ যুক্ত করেছেন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও আয়েশা হক শিমু। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টসের কণ্ঠশিল্পীরা। একক গান করেন শিল্পী দীনাত জাহান মুন্নী, নাসিমা শাহীন ফেন্সি, জয় শাহরিয়ার, দিপক দে, রাজু আহমেদ, শামীমা সুলতানা এবং সঞ্জয় দাস।
×